হাসপাতাল থেকে…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 23 Jun 2022

1650 বার পড়া হয়েছে

Shoes

কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসের এক সকালবেলা। হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বেড। সমস্ত শরীরে ব্যান্ডেজ জড়িয়ে শুয়ে জীবনানন্দ দাশ।মুখ বিকৃত ও স্ফীত। ওই অবস্থায় অস্পষ্ট উচ্চারণে কবি ও সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কাছে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও কলকাতার একটি হাসপাতালের বিছানায় জীবনের শেষ দৃশ্যে অচেতন অবস্থায় লেখার ভঙ্গিতে হাত নাড়ছিলেন। তখনও লিখতে চেয়েছিলেন তিনি? নাকি তাঁর ঘুমিয়ে থাকা মনের ভিতর থেকে কেউ বলে চলেছিলো-লেখো, লেখো তুমি, ওটাই তোমার কাজ। আঘাতে আঘাতে বিক্ষত জীবনে নিজের কাজকে কখনও থেমে যেতে দিতে চাননি বলেই ঋত্বিক কুমার ঘটক মানসিক হাসপাতালে মাথায় ইলেকট্রিক শক নিয়েও নাটক লিখেছিলেন।

এই হাসপাতালের দেয়ালে কবিতা লিখতেন বিনয় মজুমদার। হয়তো পৃথিবীর উন্মাদনা থেকে নিজেদের আড়াল করতে হাসপাতালে ঢুকে পড়েছিলেন এজরা পাউন্ড, সিলভিয়া প্লাথ, ডিলান টমান, কাফকা আর আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সৃষ্টিশীল মানুষদের হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা জীবনের গল্প ‘হাসপাতাল থেকে…’।

কবি বিনয় মজুমদার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এজরা ওয়ার্ডে ভর্তি থাকার সময় কাগজ না-পেয়ে ওয়ার্ডের সাদা দেয়ালকেই বেছে নিয়েছিলেন কবিতা লেখার খাতা হিসেবে। লিখেছিলেন দেয়ালে, ক্ষত সেরে গেলে ত্বকে/ পুনরায় কেশোদগম হবে না কখনও।সত্তরের দশকে তিনি ভর্তি গোবরা মানসিক হাসপাতালে। তখন তাঁর পাশের বেডে বসে ‘সেই মেয়ে’ নামে নাটকের স্ক্রিপ্ট তৈরি করছেন ঋত্ত্বিক ঘটকে  এই নাটিকটি-ই ছিলো ঋত্বিক ঘটকের জীবনে লেখা শেষ নাটক। ঠিক হয়েছে, সেই নাটকে অভিনয় করবেন হাসপাতালে ভর্তি অন্য রোগীরা। কিন্তু নাটকের প্রধান একটি চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কাউকে ঠিক করতে পারছিলেন না। শেষে সেই চরিত্রে অভিনয় করলেন হাসপাতাল-সঙ্গী কবি বিনয় মজুমদার।ওই নাটকের একটি সংলাপ ছিলো এরকম-মানুষ ব্যথা পায়, কষ্ট পায়, তরঙ্গে তরঙ্গে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ভাবে, মৃত্যু এলো বুঝি। কিন্তু মৃত্যুর ছদ্মবেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসে নবজীবন।মাথায় ইলেকট্রিক শক নিতে নিতেও জীবনের উত্থানের কথাই ভেবেছিলেন ঋত্বিক ঘটক।

মানসিক হাসপাতাল থেকে বাড়ির ফেরার জন্য গভীর আকুতি প্রকাশ করেছিলেন কবি। চিঠি লিখেছিলেন মহকুমা প্রশাসকের কাছে। সেবার বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন শূন্য বাড়িতে ডাকাতি হয়ে গেছে।

কবি এজরা পাউন্ড ১৯৪৫ সালে ইতালীতে আটক হন।তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো দেশদ্রোহীতার। আটক করার পর কবিকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আমেরিকায়। তাঁর জায়গা হয় এলিজাবেথ হাসপাতালে। চিকিৎসকদের অভিমত, এজরা পাউন্ড স্কিৎযোফ্রেনিয়ার রোগী। সেই হাসপাতালে তাঁরও স্থান হয় মানসিক রোগীদের জন্য বরাদ্দ ওয়ার্ডে। ১৩ বছর ওই হাসপাতালেই আটক থাকেন তিনি। কিন্তু কবিকে কিছুই আটকাতে পারে না। তিনি লিখে চলেন অবিরাম। সৃষ্টি হয় তাঁর ক্যান্টুস কবিতাগুলো।

ঋত্বিক ঘটকও 'যুক্তিতক্ক আর গপ্পো' চলচ্চিত্রটি পরিচালনার পর আক্রান্ত হন স্কিৎযোফ্রেনিয়া রোগে । স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করে তখন। এছাড়াও শরীরে বাসা বাঁধে লিভারের রোগ।

১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি আবারও সেই হাসপাতাল। এবার ঋত্বিক ঘটক বিদায় নিচ্ছেন। কলকাতার শেঠ সুখলাল করোনারি হাসপাতালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে চোখ বন্ধ করলেন তিনি।

জীবনের একেবারে অন্তিমে পৌঁছে গেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। চেতনাহীন শরীর হাসপাতালের বিছানায়। কিন্তু স্বয়ংক্রিয় হাত উঠে গিয়ে লেখার ভঙ্গি করছে।লিখতে চাচ্ছেন বাংলা গদ্য সাহিত্যের অসাধারণ সেই পুরুষটি। তিনি তো জানতেন, না লিখলে ভাত জুটবে না!কিন্তু আর কলম ধরার জন্য ফিরে আসেননি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। হাসপাতাল থেকেই মহাকালের যাত্রী হয়ে গেলেন। প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো খাটিয়ায় শুয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলেন মানিক। চোখ বন্ধ, নিশ্চল হাত। শশী ডাক্তারের মতো তাঁরও তালবনে সূর্যাস্ত দেখার স্বাদ আর হয়নি জীবনে।

কবি আবুল হাসানও শুয়ে ছিলেন হাসপাতালের বিছানায়। ঢাকা শহরের পিজি হাসপাতালও এক ভোরে থামাতে পারেনি কবির মৃত্যু। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ৪ তারিখ আবুল হাসানকে ভর্তি করা হয় পিজি হাসপাতালে। শাহবাগ মোড়ের হাওয়া বোধ হয় জানতো কবি চলে যাবে এবার। চলে যাবে তাঁরই প্রিয় শীত ঋতুতে। শীত ঝরে পড়ছে বাইরে। আর আবুল হাসান একটি কেবিনে বুকের অসুখের সঙ্গে লড়াই করছেন। বাইশ দিন হাসপাতাল হাসপাতালের অক্সিজেনের নলে একটু একটু করে মৃত্যুর কুয়াশা জন্মে গাঢ় হয়ে ওঠে। কবির বন্ধু কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে মৃত্যুর সময় নিয়ে কথা বলেছিলেন আবুল হাসান। বলেছিলেন,‘আমার ভালো লাগে ভোরের দিকটা। শীতের সময়।’ বিদায়।২৬ নভেম্বর ভোরবেলা কবির জীবনের আলো নিভে যায়। শহরের রাস্তার আলোগুলোও সেদিন নেভে কবির সঙ্গে সঙ্গে। হাসপাতালের বিছানায় কবির নিথর শরীর।

জীবনানন্দ দাশও হাসপাতাল থেকেই বিদায় নিয়েছিলেন। কমলালেবু খেতে পেরেছিলেন কি না আর জানা যায়নি। কিন্তু ব্যান্ডেজে জড়ানো যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরে এসেছিলো অমোঘ মৃত্যু।

র‌্যাঁবো প্যারিসে ফিরে আসেন ডান পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। ১৮৯১ সালের ২৭ মে কবির চোখের সামনে হাসপাতালের সাদা দেয়াল। ডাক্তাররা কেটে ফেললেন তাঁর পা।রক্তে ভেসে যাওয়া হাসপাতালের মেঝে, ব্যান্ডেজ আর টিংচার আয়োডিনের অস্থির ঘ্রাণে শুয়ে আছেন র‌্যাঁবো। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর তার মন ফিরে যেতেও চাইছে ফেলে আসা আফ্রিকায়।সেখানে গিয়ে কি মুক্তি চেয়েছিলেন? সাঁইত্রিশ বছরে মৃত্যু এসে তাকে আর কোথাও যেতে দেয়নি। তাই কি ফরাসী কবি বোদল্যের লিখেছেন,

এই জীবন এক হাসপাতাল যেখানে প্রত্যেক রোগী বিছানা বদলাতে চায়।

হাসপাতালের দেয়াল, অষুধের ঘ্রাণ, মৃত্যুর যন্ত্রণা আর মানসিক উচ্ছন্নতা লেখক-কবিদের তাড়া করে ফিরেছে। তাদের অনেকের জীবনের ওপর পর্দা নেমেছে হাসপাতালে। কিন্তু তারা হাসপাতালের ঘেরাও ভেঙে যেন উড়ে গেছেন আরও দূরের পথে, জীবনের কাছে।

তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, বঙ্গ দর্শন পত্রিকা, ঘুমের দরজা ঠেলে, চিন্ময় গুহ
ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199