ঋত্ত্বিক ঘটকের বউ…

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 11 Jan 2024

2680 বার পড়া হয়েছে

Shoes

একুশ বছরের দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সুরমা ঘটক লিখেছেন, ‘একটা ভিড়ের দৃশ্যে সমীরণ দত্তের অনুরোধে একটুখানি অভিনয় করে দিয়ে আসি। রোগা, লম্বা চেহারার মানুষটি আমাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে আসেন।’ সেই সামান্য দেখা থেকেই রোগা আর লম্বা মানুষ ঋত্ত্বিক ঘটকের সঙ্গে ঘনিষ্টতার সূচনা হয়েছিলো। শিলং পাহাড়ের মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন অস্থির প্রাণ ঋত্ত্বিক ঘটক।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘ঋত্ত্বিক ঘটকের বউ’।

ঋত্বিক ঘটক তখন বসবাস করতেন কলকাতার বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়িতে। সঙ্গে থাকেন মা। আর সুরমা সেই সময়ে শিলং থেকে কলকাতায়, এম এ পড়তে মামার বাড়িতে।

ঋত্ত্বিক ঘটক সুরমাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন। প্রতিদিনই সেই মামার বাড়িতে মেয়েটিকে পড়াতে যান। বই কিনে দেন লেনিন, মার্ক্স আর প্লেখানভ! তখন সুরমার দৃষ্টিতে যুক্তিবান, প্রত্যয়ী এক মানুষ ঋত্ত্বিক ঘটক। ‘বিসর্জন’ নাটকের রিহার্সালেও তাদের দেখা হয়। অপর্ণার চরিত্র করছেন সুরমা। সেই একরোখা মানুষটা সুরমার সব যেন ওলোটপালোট করে দিলো। প্রেমে পড়লেন সুরমাও। দুজনের চোখেই তখন মুগ্ধতার হাওয়া। কোনো কোনো দিন সুরমা নিজেই চলে যান ঋত্ত্বিকের বাড়িতে। তাদের প্রেমের গল্প হাওয়ায় ওড়ে। ঋত্বিক পথে হাঁটতে হাঁটতে তাকে গল্প শোনান হাওড়বিলের। স্মৃতির পাতা উল্টে বলেন ময়মনসিংহ আর রাজশাহীর কথা। ওই সময়েই ঋত্বিক ঘটক সুরমাকে প্রথম নিবেদনে বলেছিলেন, ‘লক্ষ্মী! আমি তোমার জন্য সব করব।’

সুরমা ঘটক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বেকার যুবকের ঘর বাঁধার স্বপ্নের ছবি ছিলো ‘নাগরিক।’ গাঁটের কড়ি খরচ করে আমরা তুললাম জানো। ভূপতি নন্দী বাড়িটা মর্টগেজ দিলো। কে যেন প্রভিডেন্ট ফান্ড ভাঙলো। শেষ রক্ষা হলো না!

প্রথম প্রেমের চিঠিতে লক্ষ্মীকে ঋত্ত্বিক লিখছেন, ‘মাসিক একটা আয়ের সংস্থান করা প্রথম কর্তব্য। নইলে জীবনে স্নিগ্ধতা আসবে না।’ অবার কখনও অন্য চিঠিতে ঝরে পড়ছে তার করুণ আত্মপোলব্ধি, ‘...আমাকে অ্যাট অল কোন মেয়ের ভাল লাগে কি করে- আমার নোংরা পা, বিড়ি ও হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে বসাসমেত! ... আমি তোমার মোটেই উপযুক্ত নই, মিছিমিছি তোমাকে ডোবাচ্ছি। ‘লক্ষ্মী’ মহিলাটি জলে পড়লেন।’

দু’জন ঠিক করলেন বিয়ে করবেন! ১৯৫৫ সালের বৈশাখে চার হাত এক হয়েও গেলো। আর ওই সময়েই বম্বেতে চাকরির খবরও পান ঋত্ত্বিক।

কিন্তু ঝড়ের বাড়ির দরজায় যার ঠিকানা লেখা তাকে দিয়ে দশটা পাঁচটার চাকরি কী হয়? বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ ও ঋষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’-এর চিত্রনাট্য লিখতে লিখতেই সুরমাকে চিঠিতে লিখলেন, ‘দশটা-পাঁচটা গিয়ে বসে থাকতে হবে। ... দাঁতে দাঁত চেপে শুধু পয়সার জন্য এখন চেষ্টা করা।... দেখো লক্ষ্মী, এ জীবন আমাদের নয়। ... এসব ছেড়ে দেব। এ হবে না!’

আচমকা ছেড়ে দিলেন চাকরি! চূড়ান্ত অস্বাভাবিকতা নিয়েই চাকরি ছেড়ে একদিন শিলং-এ হাজির হলেন। শ্বশুরমশাইকে বললেন, সুরমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।এক হাজার টাকা দিতে হবে! এক নাগাড়ে ১৭ ঘণ্টা ‘পণ্ডিতমশাই’-এর গল্প লিখে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হ্যালিউসিনেশন! তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। সেই চরম দুঃসময়ে সময়ে পাশে ছিলেন উত্তমকুমার, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তম ‘বনপলাশীর পদাবলী’ করবার জন্য টাকাও দিলেন। কিন্তু তখন কোনও কাজে মন নেই ঋত্ত্বিক ঘটকের। বাড়িতে বসে সুর শুনে যাচ্ছেন। একের পর এক রেকর্ডে বেজে চলেছে  আব্বাসউদ্দিন কখনও শচীনকর্তা। আর প্রায়ই রবীন্দ্রসঙ্গীত।

‘রাস্তায় ঋত্বিকবাবু অজ্ঞান হয়ে গেছেন! মুখের ভিতরে একটা টাকার নোট!’

সুরমার সেদিন কলেজের শেষ ক্লাস। ছুটতে ছুটতে এসে তাকে এই খবরটাই দিয়েছিলো দুটি ছেলে। চারদিক অন্ধকার নেমে আসছে তখন সুরমার।  পাগলের মতো ছুটলেন স্বামীকে খুঁজতে। ভর্তি করা হলো ঋত্ত্বিক ঘটককে হাসপাতালে। অসংলগ্ন কথা বলছেন তখন তিনি, ‘দশটা টাকা হবে ডাক্তার? না খেলে সুস্থ হব কী করে! একটু তো খেতেই হবে, নাকি? পারছি না বিশ্বাস করুন। কাজ করতে পারছি না। মাথা কাজ করছে না তো! একটু বাইরে যেতে দিন!’

হাসপাতালে নেশা কিন্তু থেমে থাকেনি। বাথরুমের দেওয়ালের কয়েকটা ইট সরিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। সেখানে হেড সুইপার এক বোতল মদ রেখে যেতো। ঋত্ত্বিক ঘটকের ভাষায়, ‘আর খাওয়ার পর আবার ইট লাগিয়ে দিতাম।’ মদের টাকা জোগাড় হতো কোত্থেকে! আশ্চর্য চিহ্নের মতো উন্মাতাল ঋত্ত্বিক ঘটকের উত্তর, ‘কিছু ভিজিটর তো আসত নাকি! তারা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করত। কিছু টাকাও রেখে যেত। সে সময় উত্তম আর রমাও এসেছে।’

শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠলেন না সুরমা!

১৯৬৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান দিল। তাঁর মদ্যপানের মাত্রা যেন বেড়ে গেলো। কলকাতার দেশী মদের পাড়া বলে খ্যাত খালাসিটোলায় নিত্যসঙ্গী প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু।

ঘর ভাঙলো। পথ আলাদা হয়ে গেলো। হয়তো এরকমই হওয়ার কথা ছিলো। শেষ দৃশ্য আসন্ন এক ঝোড়ো সিনেমার।

চলে যাওয়ার আগে সুরমা ঘটক জানতে চান, ‘কোনও জিনিসের দরকার আছে?’

‘শুধু বই ও রেকর্ডগুলো থাক!’

ঋত্ত্বিক ঘটকের অনুরোধের উত্তরে সুরমা ঘটক বলেছিলেন, ‘বই ও রেকর্ডগুলো রেখে গেলেই বিক্রি করে মদ খাওয়া হবে। তাই ওগুলো দেব না। ছেলের জন্য যত্ন করে রাখব। বড় হয়ে পড়বে ও শুনবে।’

‘তা হলে শুধু পাখাগুলো থাক।’

সুরমা লিখছেন, ‘আমি রাজি হই। যদিও জানতাম, চলে গেলেই বিক্রি করে মদের বোতল আসবে।... চলে আসার সময় কী আকুল দৃষ্টি! তবু, এসে ট্যাক্সিতে উঠি। কী করব, আমি মা! তিনটি ছেলেমেয়েকে তো আমাকে রক্ষা করতেই হবে।’

৭১-এর ১ জানুয়ারি সংসার দু’ভাগ হয়ে গেলো। স্কুলে চাকরি নিয়ে সাঁইথিয়া চলে গেলেন সুরমা!

একা হয়ে গেলেন ঋত্ত্বিক ঘটক।

মাস পাঁচেক পরে বোম্বে থেকে সাঁইথিয়ায় চিঠি পাঠালেন। ২৫ বৈশাখ লেখা চিঠিতে স্ত্রীকে জানালেন, ‘আসছি। চার পাঁচদিন জ্বালাব। না, শান্তিনিকেতনে থাকব। একবার করে দেখে যাব। তারপর রামপালান পালাব। চিরকালের মতো। দেখি, পারি কিনা।’ চিঠির শেষে লেখা, ‘ঘৃণা-ঋত্বিক!’

পালিয়েই গেলেন তিনি।

‘প্লিজ আর খাবেন না!’ নিষেধ করেন ডাক্তার। কিন্তু মৃত্যু যে ডাকছে তাকে।

‘হয়নি, কিছু হয়নি। আরও একটু চাই।’

হাসপাতালের বেডে শুয়ে সারাক্ষণ স্মৃতির পথে হেঁটে চলেন। নিজেই লেখেন, ‘যখন ‘জ্বালা’ লিখেছিলাম, তখন জানতাম না কাশির সঙ্গে রক্ত কেমন করে ওঠে... আর আজ! আর বাঁচতে চাই না। এই শুয়োরের বাচ্চার দেশে বেঁচে লাভ কি?’


তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, সুরমা ঘটকের মুদ্রিত সাক্ষাৎকার
ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199