চশমার কাচে সমুদ্র

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 6 Jun 2024

1980 বার পড়া হয়েছে

Shoes

যদি বলি চা, পাপড় আর চানাচুরে বাঙালি তাহলে অনেকেই তেড়ে তর্ক করতে আসবেন।রাস্তায় যখন যানজটে নাকাল মানুষ, বাজারে পণ্য অগ্নিমূল্য আর আকাশ থেকে নেমে আসছে একটানা বৃষ্টি তখন বৃষ্টিমুখর দিনে বসে এই কথা লিখলে অনেকের ভ্রু কুঁচকে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কখনো চশমার কাচে উড়ে এসে পড়া বৃষ্টির ফোঁটাকেই সমুদ্র বলে ভাবতে ইচ্ছে করে না? কাচ পরিস্কার করতে করতে নাগরিক চোখ আকাশে ধূসর মেঘের ঘরবাড়ির দিকে তাকায় চকিতে। ভাদ্র মাস ফুরিয়ে যাবার মুখে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি দেখে রসনা বিলাসের খাতায় কেউ লেখে খিচুড়ি আর ইলিশের নাম। অফিস ফাঁকি দেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ আগ্রহটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে, মলিন তাস সজোরে ভেঁজে  কষে খেলার দিনগুলো তো কবেই অতিক্রান্ত। সমস্যায় আকীর্ণ এই নগরে এরকম ভাবনা তাই হয়তো বিলাসিতাই। তবুও বাঙালির মন বলে কথা!  বৃষ্টিতে সেই মন জেগে ওঠে। মনে পড়ে, কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ার সহজ দিনের স্মৃতি। লম্বা হাই তুলে বলতে ইচ্ছে করে, ‘আজ আর কোথাও যাবার নেই।’

খাতাকলমে ভাদ্র মাসের গল্প ফুরানোর দিনে হঠাৎ বৃষ্টির ডানায় চড়ে বর্ষা যেনো ফেরত এলো গত কয়েকদিনে। এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সেই অসময়ে বিপুল বৃষ্টি নিয়ে ‘চশমার কাচে সমুদ্র’। 

এবার আষাঢ় শ্রাবণ তো ছিলো রুক্ষ। বৃষ্টির জন্য মাথা চাপড়েছেন কৃষক থেকে শুরু করে রোমান্টিক কবি পর্যন্ত। লতা মুঙ্গেশকর চির বিদায় নিলেন। ছুটির দিনের হারমোনিয়ামও আর গাইলো না ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’। আকাশে মেঘের দখলের চেয়ে সূর্যের তেজের আগ্রাসনই ছিলো বেশি।

তাই এই অসময়ে টানা বর্ষণে গরমের ভুক্তভোগীদের মুখে একটু হাসি ফুটলো বৈকি। সমস্যার সমুদ্রে সাঁতার দিতে দিতেও কারো মনে গুনগুনিয়ে ফিরলো হয়তো পুরনো গানের কলি। কারো মন পড়ে রইলো বৃষ্টিমুখর দিনে কোনো আড্ডায়।

বৃষ্টির সঙ্গে বাঙালির জীবনে যেমন জুড়ে থাকে চা, পাপড়, চানাচুর তেমনি থাকে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা আর ইলিশ মাছ। এরকম দিনের সঙ্গে মিলিয়ে  খাবারের অনুষঙ্গ বাঙালি কোথায় আবিষ্কার করলো বলা মুশকিল।তবে এরকম খাবার, বিছানায় একটু গড়াগড়ি আর আড্ডা অলস বলে বিখ্যাত বাঙালির একটা বড় আত্মপরিচয় হয়েই থাকলো। নীরদ শ্রী চৌধুরীর আত্মঘাতী বাঙালি আর যাই জীবন থেকে ছেটে ফেলুক বৃষ্টিদিনের এই আলস্যকে বোধ করি কখনোই বাদ দিতে পারবে না।

ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা মাথায় মাছের আশায় পুকুরে ছিপ ফেলে বসে আছে ছায়ামূর্তি, বাইরের উঠানে মাধবীলতার ঝাড়ের তলায় একলা দাঁড়ানো রঙচটা সাইকেল-বৃষ্টির অলস দিনের ছবি আঁকে। বৃষ্টিতে এরকম সাইকেল চালিয়ে কে যায় গ্রামের বাজারে? চায়ের দোকান মুখ অন্ধকার করে থাকা দিনে একা বসে থাকে; স্টিমার আসেনি।ভুলে যায় ওষুধ কেনার কথা। তখন আকাশ থেকে নেমে আসা জলের চূর্ণকণা দেখতে ইচ্ছে করে শুধু।দিগন্তে টেনে দেয়া বৃষ্টির ধূসর পর্দার দিকে তাকিয়ে তখন অন্য কিছু ভাবতে ভালো লাগে না।দুধের ঘটি ঘুমিয়ে আছে ওষুধের দোকানের বারান্দায়। কয়েক আঁটি খড় ভিজছে সেখানে বৃষ্টির ছাঁটে। ইলিশ মাছ ভাজার ঘ্রাণ ছড়িয়ে না-পড়ুক এমন বৃষ্টির দিনে। তবুও বৃষ্টি কেমন অলস করে বসিয়ে রাখে অবেলার মানুষকে। সেই বসে থাকার ভঙ্গির ভিতর দিয়ে যেনো বয়ে যায় একটা জীবন। সে জীবনে চাওয়া নেই, জীবনের দৌড় নেই, পাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি নেই। বয়ে চলে অলস বৃষ্টির দিন আকাশে আকাশে।

শক্ত করে বাঁধা জীবন। আজকাল শহরের বাড়িতে থাকে না ভেন্টিলেটারও। সেই ফাঁকহীন জীবনে মানুষ তবুও খানিকটা আকাশ বের করে নিতে চায়। সে আকাশ বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া পথে বের হয়ে যেতে স্বপ্ন দেখায়। সে আকাশ বলে, আজ কোনো কাজ নেই। গুলতানি শব্দটা বোধ হয় একান্তই বাঙালির অভিধানে আছে। ইংরেজরা বলে, গসেপিং বা আরও আধুনিক করে, চিট চ্যাট। কিন্তু শব্দবন্ধে সাহেবীআনার চাল আছে কিন্তু মনটা অনুপস্থিত বলেই মনে হয়। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘরের মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে জমিয়ে চায়ের কাপে চুমুক, কাঁচা মরিচ আর সর্ষের তেলে মাখা মুড়ির মোহন আহ্বানে জমে ওঠা আড্ডা পৃথিবীর আর কোথায় পাওয়া যাবে? চুলায় যাক কাজ এই কথাটা সাহস করে বাঙালি ছাড়া আর কে বলতে পারে? অফিসে কাজের সমুদ্র থেকে কাউকে কিছু না-বলে কে খসে পড়তে পারে আলতো করে পাতা বিছানায়?

বৃষ্টির দিন বুক পকেটে এক‘শ একটা কাজের ফর্দ গোঁজা থাকতে পারে।  কিন্তু সে ফর্দের উদ্বাহু দাবিকে উপেক্ষা করার সাহস বাঙালির-ই আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বাংলা ভাষার বিখ্যাত সব সাহিত্যিক, কবিরা বৃষ্টি নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য লেখা। কবি আবুল হাসান তাঁর কবিতায় লিখেছেন এমন চরণ, বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হয় তোমার পায়ের পাতার শব্দ তখন বৃষ্টির সঙ্গে জুড়ে যায় অপেক্ষার দিনও।কবি আবিদ আজাদের কবিতায় বৃষ্টি নামে টাপুরটুপুর টাইপরাইটারের শব্দে বৃষ্টি নামে মতিঝিলে।

বৃষ্টি জানালার গায়ে স্নিগ্ধ ছবি আঁকে। সে ছবি দেখতে দেখতে কোনো নাগরিক ভুলে যায় জীবন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরছে শহরে। বৃষ্টি আসলে এমনি করেই ভুলিয়ে দেয়। সে বৃষ্টি ঝরুক ভাদ্রের শেষে অথবা আষাঢ়ের প্রথমে। বাঙালির মন চিরকাল মেঘের দিন দেখে কদম ফুলের কথা ভাবতে ভাবতে চশমার কাঁচে সমুদ্র দেখে।

ছবিঃ প্রাণের বাংলা, সালমান সিদ্দিক প্রত্যয়

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199