বিপজ্জনক মানিক

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 2 Jul 2020

1275 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সময়টা ১৯৫৬ সালের ৩০ নভেম্বর জ্ঞান হারালেন তিনি। ২ ডিসেম্বর কলকাতার নীলরতন হাসপাতালে পৌঁছালো তার সজ্ঞাহীন শরীর। অচৈতন্য শরীরের ডান হাতটা বারবার শূন্যে উঠে যাচ্ছিলো। কিছু কি লেখার চেষ্টা করছিলেন? বেঁচে থাকার এক আবছায়া উপত্যকার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে তখনও কি লেখার চেষ্টা করছিলেন তিনি? না লিখলে যে বাঁচা যাবে না তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানতো! তারপর আর একটি দিনের অপেক্ষা। ৩ ডিসেম্বর বাংলা সাহিত্যের অসামান্য মানুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুক্তি দিলো জীবন।

লিখে লিখে ক্ষয় করে ফেলেছিলেন তিনি একটা জীবন? একটা মোমবাতির দুদিকে আগুন জ্বেলে দেখতে চেয়েছিলেন কতোটা উজ্জ্বল হয়ে পোড়া যায় ভ্যানগঁগের মতো, র‌্যাবোর মতো?বাংলা সাহিত্যের দরবারে রাজার মুকুট মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় উঠেছে মৃত্যুর পরে। ধূমকেতুর মতোই তাঁর আগমন। বাজি ধরে গল্প লিখে লেখক হয়েছিলেন। একের পর এক লিখেছেন পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্যের মতো উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের জমিনে যেন অ্যাসিড ঢেলে দিলেন প্রাগঐতিহাসিক, হারানের নাত জামাই, ছোট বকুলপুরের যাত্রী‘র মতো গল্প লিখে। আবার ১৯৫৪ সালের শেষ দিকে এসে নিজেই পুতুলনাচের ইতিকথা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বললেন, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা একটা ন্যাতপেতে সেন্টিমেন্টাল লেখা’।

এমনই বিপজ্জনক ছিলেন লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যক্তিজীবন, লেখকজীবন দারিদ্র্যের আঘাতে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কিন্তু সেই ছাই আবার নির্মাণ করেছে অতুলনীয় অন্য এক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে।

বাংলা সাহিত্যের এই অসামান্য লেখককে নিয়ে এই সংখ্যা প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো, ‘বিপজ্জনক মানিক’।

‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসে কুবের জানতে পারে তার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে। এই সংবাদ আনন্দ বয়ে আনে না জেলেপাড়ায়। কুবের ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে, ‘পোলা দিয়া করুম কী, নিজেগোর খাওন জোটে না, পোলা!’

কিন্তু তাঁর লেখকের ডায়েরি পৃষ্ঠা উল্টালে কয়েকটা লাইনে চোখ আটকাবেই-‘বাচ্চা মরে যাওয়ায় ডলি অখুশি নয়। অনেক হাঙ্গামা থেকে বেঁচেছে। বললো, বাঁচা গেছে বাবা, আমি হিসেব করেছি বাড়ি ফিরে মাসখানেক বিশ্রাম করে রাঁধুনি বিদায় দেবো। অনেক খরচ বাঁচবে।’

ডলি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী। সন্তানের জন্মে খুশি হয়নি উপন্যাসের কুবের চরিত্র। আর পাশাপাশি সন্তানের মৃত্যুতেও সংসারে অনেক হাঙ্গামা থেকে বাঁচার কথা বলছেন তাঁর স্ত্রী। জীবনের এই ব্যথার ছন্দ করুণ কবিতার মতো বেজেছিলো মানিক বাবুর জীবনে।

অভাব তাঁর পৃথিবীকে শাসন করেছে বড় কঠিন হাতে।কিন্তু অভাবের সেই ঝুঁটিকে শক্ত হাতে ধরে পাল্টা আঘাত করেছিলেন তিনি। আর সেই আঘাত ছিলো তার লেখার শক্তি। নিজের জীবনের মতো তাঁর উপন্যাস অথবা গল্পের চরিত্রগুলোও হয়ে উঠেছিলো ভয়ঙ্কর। গল্পের চরিত্র কোনোদিন সমুদ্র না দেখার যন্ত্রণা ভোলে নিজের কান্নার স্বাদ জিব দিয়ে চেটে নিয়ে, ভয়ঙ্কর ভিখু মরতে মরতে বেঁচে থাকে, ভিক্ষা করার জন্য পায়ের ঘা বাঁচিয়ে রাখা পাঁচীকে তুলে নেয় পিঠে, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের চরিত্রে আনন্দ প্রেমহীন, অসুস্থ জীবন সহ্য করতে না পেরে নগ্ন হয়ে ঝাঁপ দেয় আগুনে।আসলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের পৃথিবীটাকেই বদলে দিতে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন গতানুগতিকতার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক আগন্তুক।তিনি নির্মোহ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন বাস্তবতাকে, যৌনতার উন্মোচনে তাঁর কলম ছিলো কুন্ঠাহীন, আবার স্বেচ্ছায় প্রবেশ করেছিলেন সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বলয়ে।

অভাব একটি ছোট অথচ আগুনে শব্দ। নিজের দাদা টাকা পাঠানো বন্ধ করার পর থেকেই অভাবকে নিয়ে তাঁর সংসার করার শুরু। ঘর বলতে ছিলো ছোট্ট একটা বাড়িতে অনেক লোক গাদাগাদি করে থাকা। কিন্তু এ অবস্থার মাঝেই ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘পদ্মানদীর মাঝি’ আর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’। এই দুটি উপন্যাস বদলে দিয়েছে বাংলা গদ্য সাহিত্যের দিগন্ত। অথচ এই দুটি উপন্যাস এই মানুষটির জীবনীশক্তি কেড়ে নিয়েছিলো। তাঁর চিঠিতে পাওয়া যায়,‘‘এই কয়েকটি বই লিখতে গিয়ে মেতে উঠে যখন আমি নিজেও ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা শরীর আছে এবং আমার পরিবারের মানুষরাও নিষ্ঠুর ভাবে উদাসীন হয়ে গিয়েছিলেন।তখন একদিন হঠাৎ আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। একমাস থেকে দু’তিনমাস অন্তর এটা ঘটতে থাকে। তখন আমার বয়স ২৮/২৯, ৩/৪ বছরের প্রাণান্তকর সাহিত্যসাধনা হয়ে গেছে।’’

প্রচণ্ড শারীরিক-মানসিক ধকলে ১৯৩৫ সালের দিকে ধরা পড়ে তাঁর মৃগীরোগ। তবু লেখা থামেনি। তিনি লিখেছেন, ‘‘আজ এখন অষুধ খেয়ে ঘুমালে কাল হাঁড়ি চড়বে না।’’ ওই অবস্থাতেও রাজ্য সরকারের সাহায্য ফিরিয়ে দেন তিনি। কারণ তিনি কমিউনিস্ট। মুড়ির ঠোঙ্গায় গল্প লিখেও পাঠিয়েছেন পত্রিকা অফিসে। পার্টিও তখন তার পাশে দাঁড়ায়নি। অভিযোগ অথবা অভিমানে লিখেছিলেন ডায়েরিতে যে, সবাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছে।

বাঁশি বাজাতে ভালোবাসতেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শিশুদের সঙ্গে সময় কাটানোটা ছিলো প্রিয় অভ্যাস। কিন্তু সব কিছুই বন্ধ হয়ে যায় অসুখের সেই কঠিন সময়ে। প্রয়োজন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, কিন্তু তিনি কিছুতেই তা করতে রাজি নন। শেষে সুহৃদদের অনেকের চেষ্টায় এবং অনুরোধে ভর্তি হন তিনি। ডায়েরিতে লেখেন-‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মানুষের মন বোঝে না।’

হাসপাতালে সুস্থ হয়ে উঠছিলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো তাকে হাসপাতালে আটকে রেখে মদ ছাড়ানোর চেষ্টা চলছে।ব্যাস, একদিন তুমুল বৃষ্টির মধ্যে ডাক্তার-নার্স কারো কথা না-শুনে বাড়িতে চলে আসেন তিনি। ‍তারপরই আবার অবস্থার অবনতি ঘটে। ডাক্তার বাড়িতে এসে তাকে দেখে বলেন, তার প্রধান সমস্যা মৃগীরোগ। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া আটকানোর জন্য আগে থেকেই মদ খেয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টা করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ জন্যই মদ খাওয়া বন্ধ করতে পারছেন না তিনি। তাকে মানসিক হাসপাতালে রেখে মৃগী রোগটা সারাতে পারলেই মদ্যপান বন্ধ হয়ে যাবে।

আবার হাসপাতাল পর্ব শুরু হলো। কিন্তু রোগ সারলা না মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নিজেই চিকিৎসাশাস্ত্রের বই ঘেঁটে ঠিক করলেন, নিজের চিকিৎসা নিজেই করবেন। মদ্যপানও শুরু করলেন আবার। আর তাতে শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করলো। ক্যালেন্ডারের পাতায় ২ ডিসেম্বর। অচৈতন্য বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।কলকাতার নীলরতন হাসপাতালে পৌঁছালো তার দেহ। শেষদৃশ্যের ওপর তখনও যবনিকা পড়েনি। একদিনের ব্যবধানে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি। ৩ ডিসেম্বর চিরকালের মতো সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাঁর শেষযাত্রায় খাটিয়ার ওপর উপচে উঠেছিলো ফুলের মালা। শবযাত্রায় ভিড় করেছিলো বহু মানুষ। দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, ‘পালঙ্ক শুদ্ধ ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা, একটা বন্ধ। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে আছে। সামনে পিছনে, দুইপাশে বহু মানুষ। সর্বস্তরের মানুষ। মোড়ে মোড়ে ভিড়।...কিন্তু কাল কেউ ছিলো না, কিছু ছিলো না...জীবনে এত ফুল তিনি পাননি।’

তথ্যসূত্রঃ বঙ্গদর্শন পত্রিকা
ছবিঃ গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199