স্মৃতি পিপীলিকা…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 28 Dec 2023

3835 বার পড়া হয়েছে

Shoes

স্মৃতি পিপীলিকা শব্দটা মনের পর্দায় অগনিত পায়ে চলাচলের একটা ছবি ফুটিয়ে তোলে। পিঁপড়ার মতো ধারাবাহিক এবং নিরন্তর এক চলাচল তার সার্বিক গতি নিয়ে এগিয়ে আসছে অথবা পিছিয়ে যাচ্ছে।পিঁপড়ার এই চলনের সঙ্গে কবি সুধীন দত্ত তাঁর কবিতায় জুড়ে দিয়েছিলেন স্মৃতি শব্দটা। তাঁর কবিতার পরের চরণেই তো আছে মৃত মাধুরীর কণা সঞ্চয়ের কথা। সেই মৃত মাধুরী ব্যথার অথবা আনন্দের।হাহাকার অথবা কোনো প্রাপ্তির। সুধীন দত্ত অবশ্য তাঁর ওই নির্দিষ্ট কবিতাটিতে স্মৃতি পিপীলিকার সঙ্গে মৃত মাধুরীর সঞ্চয়ন যুক্ত করে হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার বেদনার তীব্র আক্ষেপকেই ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু স্মৃতি তো সর্বদা দুঃখের হয় না। স্মৃতি আনন্দ নিয়েও জেগে থাকে আমাদের মনের বাড়িতে।

স্মৃতির ভিতরে বহু অলিগলি। সেখানে অনেক ঘরবাড়ি। কোনো বাড়ির নম্বরও ভুলে যাই, কিছু মনে গেঁথে থাকে। সেই বাড়িটার ভিতরের আবহ, মানুষ ভেসে থাকে চিন্তার প্রবাহে। জমিয়ে রাখি কখনও।খুইয়ে ফেলি আবার। কবির মতো মনের মধ্যে বারবার বলি, ‘সে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে/ আমি ভুলিব না, কভু ভুলিব না।কিন্তু মনে থাকে কি?

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো স্মৃতি নিয়ে ‘স্মৃতি পিপীলিকা’।

একটা হ্যারিকেন দেখে টুক করে মনের পুকুরে ভেসে ওঠে শেষবার হ্যারিকেন জ্বালবার স্মৃতি। মাথার ভিতরে আবার সেই পিপীলিকাদের চলাচল শুরু হয়। দলবদ্ধ হয়ে মাথার ভিতরে হেঁটে আসে কবে সময়ের এক ফুঁয়ে নিভে যাওয়া সময়ের নানান আবহ। অন্ধকারে ফসলের মাঠ, হিজল গাছের ছায়া, গ্রামের ঘর, কাচের চিমনির ঘেরাটোপে মৃদু নড়তে থাকা আগুনের শিখা সামান্য আলো ফেলে রেখেছে টেবিলে; জানালা দিয়ে ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে…ব্যাস, কয়েক সেকেন্ড পরেই পুরো ছবিটা আবার নির্বাপিত। এই স্মৃতি গেঁথেই আছে হয়তো মনের মধ্যে। স্মৃতি পিপীলিকা কোন রন্ধ্রে জমিয়ে রাখে এইসব মৃত মাধুরীরর কণা কে জানে? উত্তর জানে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের কাছে এই মনে পড়া-না-পড়ার ব্যাখ্যা আছে। কেন আমরা ভুলে যাই, কেন মনে রাখতে পারি এসব নিয়ে মনবিজ্ঞানীদের অনেক গবেষণা।কিন্তু মানুষের মন কি গবেষণার অভিসন্দর্ভের কাছে পুরোটা নির্ভরশীল? ঘাসের চেয়েও দ্রুত সঞ্চরণশীল মানুষের মন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়, স্মৃতির বইয়ের কোন পৃষ্ঠা পলকে উল্টে আবার পলকেই বন্ধ করে ফেলে তার খবর বিজ্ঞানের কাছেও হয়তো নেই। কত স্মৃতি জোর করে ভুলে যেতে চায় মানুষ। কত ঘটনার কবর তার মনের মধ্যে খোঁড়া আছে! আবার কত স্মৃতির চিতা পুড়ছে তো পুড়ছেই। চাইলেও ভুলতে পারা যায় না। কিন্তু মানুষ ভুলে যায়। জন্মের স্মৃতি আমার মনে নেই। অসুখের ঢেউ এসে মনের ভিতর থেকে একটু একটু করে সরিয়ে নিয়ে যায় জমিনের নিশানা; গতকালের স্মৃতিটুকুও তখন আর মনে পড়তে চায় না। চিকিৎসকরা এ অসুখের নাম দিয়েছেন ডিমেনশিয়া। পৃথিবীর বহু মানুষই এখন স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ার এই রোগে ভুগছে এখন। মনের দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে কিছু স্মৃতি ফিরে পাবার কী অসহায় চেষ্টা! দাগগুলো ছিলো, মানুষের মুখ ছিলো, শব্দ, সম্পূর্ণ বাক্য, ভালোবাসা সব ছিলো। সবকিছুর পৃথক পৃথক স্মৃতি সাজিয়ে রাখা ছিলো প্রকষ্ঠে। কিন্তু সব ক্ষয় হয়ে মুছে গেছে। ফেলে যায়নি মনে করবার সূত্রটুকুও। পৃথিবীতে এখন মানুষের এই বিস্মৃতির অসুখ প্রবল ভাবে রাজত্ব করছে। লোপাট করে দিচ্ছে আমাদের সব মনে রাখাগুলো।

সিত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুরের একটি সংলাপ ছিলো,‘মনে…রেখে দেব’। কী গভীর প্রত্যয়, অস্পষ্ট ভালোবাসার কী ভীষণ টান সব ধরে রাখার। মনের মধ্যে সব ধরে রাখার আকুতি! নায়ক ছবিটি সেখানে শেষ হয়েছিলো মানুষের জীবনে হয়তো তারপরেও আরও খানিকটা গল্প সেখান থেকেই শুরু হয়। সে গল্পের পরিণতি অজানা। সিনেমার সেই চরিত্রটির সঙ্গে জীবনের পথে একা হয়ে থাকা অভিনেতারি আর দেখা হয়েছিলো? আমরা জানি না। কিন্তু আমরা ভাবতে ভালোবাসি, সেই নারীটি প্রখ্যাত অভিনেতাকে মনে রেখে দিয়েছিলেন।

আমরা স্বভাবগত ভাবেই ভাবতে ভালোবাসি। মনে রাখতে চাই অঙ্কের ফর্মূলা থেকে শুরু করে প্রেমিকার মুখ। কিন্তু সব তো মনে থাকে না। আমাদের মনেরও ধারণ ক্ষমতা আছে। তার বাইরে স্মৃতিগুলো মরে যায়। সুধীন দত্ত যাকে বলেছিলেন মৃত মাধুরীর কণা?

এই প্রযুক্তি নির্ভর পৃথিবীতে হ্যাকাররা হাতিয়ে নিচ্ছে মেমরি, গোপন তথ্যভাণ্ডার। কিন্তু মানুষের স্মৃতি? সেটাও কি চুরি করা সম্ভব হ্যাকারদের পক্ষে? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জিক্যাল সায়েন্সের নাফিল্ড বিভাগের গবেষক লরি পাইক্রফট বলছেন, "আগামী দশ বছরের মধ্যে যদি বাণিজ্যিকভাবে স্মৃতি পুন:স্থাপনের মতো বিষয় ঘটে তবে আমি মোটেও অবাক হব না।"

তার হিসেবে, আগামী ২০ বছরের মধ্যে প্রযুক্তি হয়তো এমন সুবিধা এনে দেবে যাতে করে মস্তিষ্কের সেই সব সংকেত ধারন করা যাবে যা স্মৃতি বা মেমোরি তৈরি করে।

আর এই শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও চলে আসবে বলে মনে করেন মি. পাইক্রফট। কী ভয়ংকর চিন্তাভাবনার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা! কৃত্রিম স্মৃতি তৈরি করার প্রয়োজন হয়তো একদিন পৃথিবীতে সৃষ্টি হবে। হারানো স্মৃতি ফিরে আসবে আবার। কিন্তু ততোদিন বেঁচে থাকার আগ্রহ জাগে না মনে। আমার থাকুক স্মৃতি পিপীলিকা, আমার সঞ্চয়ে থাকুক মৃত মাধুরীর কণা। হয়তো জীবনের সব স্মৃতি মনে রাখতেও চাই না আমি।


ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199