দহন

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 25 Apr 2024

3050 বার পড়া হয়েছে

Shoes

পুড়ছে। গ্রীষ্মের ড্রাগনের অগুনে নিঃশ্বাসে নগর পুড়ছে, গ্রাম পুড়ছে, বৃক্ষদল পুড়ছে , পাখি পুড়ছে, পুড়ছে মানুষের ঘরবাড়ি। বিজ্ঞানীদের গবেষষণায় পৃথিবীর উষ্ণতম জায়গা হিসেবে উঠে এসেছে ইরানের এক মরুভূমির নাম। আলোচনায় ঠাঁই পেয়েছে আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর নাম।  স্যাটেলাইটের পর্বেক্ষণ থেকে পাওয়া এই তথ্য জানে না বাংলাদেশের যশোর অথবা রংপুরের কৃষক। জানে না, রাজধানী ঢাকার রাজপথে তীব্র রোদে রিকশা টেনে চলা মানুষটা। তার কাছে এই তথ্যের চাইতে মাথার ওপর প্রতিদিনের সূর্যটাই সত্য।

ইংরেজ কবি টি. এস এলিয়ট সেই কবে লিখেছিলেন, ‘‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রয়েলেস্ট মানথ/ ব্রিডিং লাইলাকস আউট অফ দ্য ডেড ল্যান্ড...’’এই পৃথিবীতে এপ্রিল সত্যিই এক নৃশংস সময় হয়েই দেখা দিলো? এই ডেড ল্যান্ডের শরীরে ফুটবে না আর কোনো ফুল?  কাব্যে গ্রীষ্ম, রোদের দহন, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া আগুন উপমায় শরীর মুড়ে দেখা দিলে শুনতে বা পড়তে ভালোই লাগে। প্রয়াত কবি সমর সেন তাঁর কবিতায় লিখেছেন ‘‘উজ্জ্বল ক্ষুধিত জাগুয়ার যেন এপ্রিলের বসন্ত আজ।’’

কিন্তু যখন এই দুঃসহ তাপদাহে পুড়তে থাকে মানুষের জীবন প্রবাহ, যখন পোড়ে বৃক্ষদল, পাখি, নদীর ক্ষীণ জলরেখা, বিশুষ্ক আকাশের শুন্যতা থেকে ঝরে পড়ে প্রকৃতির ক্রোধ তখন বলতে ইচ্ছা করে, জল দাও আমার শিকড়ে।

তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে দেশজুড়ে। এই অসহনীয় গরম নিয়ে এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো, দহন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিল্প যুগের প্রাক-মুহূর্ত থেকে আমাদের এই গ্রহ খুব দ্রুত উষ্ণ হয়ে উঠছে। বলা হচ্ছে, ১৮৫০ সালের পর থেকে পৃথিবীর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা গড়ে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে।

এছাড়াও উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে গত চার দশকের প্রত্যেক দশকে তাপমাত্রা ক্রমাগতই বৃদ্ধি পেয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগৃহীত লাখ লাখ তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই উপসংহারে পৌঁছেছেন। বিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা বাড়ার আভাস দিয়ে চলেছেন। শূন্য আকাশ থেকে গাছপালার সবুজ মাথায় তৃষ্ণার্ত চিল ছায়া ফেলে উড়ে যাচ্ছে কোথাও পানির সন্ধানে। মনের মধ্যে স্মৃতির পর্দায় উড়ে আসে ১৯৭৮ সালের কোনো গ্রীষ্মের দুপুর। শাহবাজপুরের ভাঙা কাঠের সেতুর তলায় তিরতির করে অস্তিত্ব ঘোষণা করে সামান্য পানি। মাঠের গায়ে হেলান দিয়ে ছড়িছে গেছে মাঠ, তাতে সবুজ ফসল। হাওয়া নেই। গুমট বাতাসে ওড়ে কারো একরোখা ঘুড়ি। ভাঙা সেতুর নিচে সামান্য ছায়া। চারধারে রোদে পোড়া ঘাস যেন প্রেমিকার মতো সেই সামান্যতেই মুখ গুঁজে অমরত্ব পেতে চায়। কেউ শুকিয়ে যাওয়া খালের কাদায় জাল টেনে ভূতের মতোন উঠে আসে। রোদের দহনে পোড়া শরীর, তবুও মুখে হাসি। আজ চুলায় চড়বে সামান্য কয়েকটা মাছ। হঠাৎ গুমট ভেঙে হাওয়া দেয়। এমন বেলায় বাঁশ ঝাড়ে শান্তি আছে গিরগিটি জানে। নিঃশব্দে জিব বের করে সরীসৃপ। মানুষ কি জানে কোথায় শান্তি এই দহনকালের কবল থেকে?

বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ এখন অনেক বেশি। ঘাম ঝরছে অতিমাত্রায়। চিকিৎসকরা সুস্থ থাকার জন্য বলছে বেশি মাত্রায় তরল পান করতে।  রোদ থেকে নিজেকে যতোটা সম্ভব আড়াল করতে। সুচিন্তিত পরামর্শ সন্দেহ নেই। কিন্তু সে সুযোগ কোথায় খেটে খাওয়া মানুষের? এই তীব্র দহনের দিনেও তাদের বের হতে হয় পথে। কর্মজীবিকেও ছুটতে হয় দপ্তরে। পথে যানজট, ভিড়; মাথার উপর দস্যুর মতো পরোয়ানা হাতে তীব্র সূর্য পুড়ে যাচ্ছে সব এই দহনের কালে। কিন্তু কৃষ্ণচূড়া? গাছের মাথায় মূর্তিমান সন্ত্রাসের মতো অগ্নিবর্ণ হয়ে আছে চিরচেনা এই ফুল। এই তীব্র তাপদাহের মাঝে কৃষ্ণচূড়ার যেন শ্রান্তি নেই। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, লাল পতাকা দুলছে। পৃথিবী থেকে লাল পতাকার যুগ বিদায় নিয়েছে। এক সময় লাল পতাকার আন্দোলন রক্তের ভিতরে ভিন্ন স্পন্দন তৈরি করতো। শাসকরা ভয় পেতো এই পতাকাকে। তাই হয়তো আমাদের বিদ্রোহ, বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের সঙ্গে কৃষ্ণচূড়ার রঙের আগুন সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিলো। এখন সেই রঙের আগুন তাপদগ্ধ বৃষ্টিহীন শহরের পথে পথে উঁকি দিচ্ছে।  কিন্তু বিদ্রোহ? সে তো ফেরারী।

এই দহনের কাল শেষ হলে আবার হয়তো বৃষ্টি নামবে এই জনপদে। স্বস্তির বৃষ্টি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবার সেই স্বস্তি আসতে হয়তো বিলম্ব হবে। ভয় হয়, যদি বৃষ্টি ফুরিয়ে যায়! যদি আফ্রিকার বুরিকিনা ফাসো নামে দেশটার রোদ উড়ে এসে জুড়ে বসে এই দেশে! তাহলে ১৯৭৮ সালে শাহবাজপুরের সেই গ্রীষ্মকাল কি পালিয়ে যাবে কোথাও? কারণ তার তো আর পালিয়ে বর্ষাকালের কাছে যাবার সুযোগ থাকবে না। সেই দহনকালের আয়ু ভীষণ দীর্ঘ বলে শুনেছি। এই দহনের দিনে বাতাসে নাক টেনে নিমফুলের ঘ্রাণ টের পাই শুধু। আচ্ছা, নিমফুলের কি ঘ্রাণ থাকে? সুদূর অষ্পষ্ট ঘ্রাণ যা এই পোড়া শহরে মনের মধ্যে হঠাৎ স্বস্তি ডেকে আনে? শান্তি কোথায়, সব তো পুড়ছে এই দহনে?

ছবিঃ ফেইসবুক থেকে

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199