পথের মানুষ…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 3 May 2024

2070 বার পড়া হয়েছে

Shoes

পথের মানুষ কে? প্রতিদিন রাস্তায় পাশ ঘেঁষে চলে যাওয়া কোনো না কোনো একজন মানুষ যার দিকে কখনো মুখ তুলে তাকানোই হয় না? আবার কখনো হয়তো শুধু এক পলকের জন্য দৃষ্টি বিনিময়? তারপর স্মৃতি থেকে মুছে যায় সেই মানুষের স্মৃতি। মনে হয়, গভীর এক জলরাশির নিচে চলাচলকারী মাছের স্রোত। আশপাশ দিয়ে কে কোথায় যেন ভেসে চলে যাচ্ছে। মাছেরা কী সত্যিই একে অপরকে চিনতে পারে না? কিন্তু মানুষ পারে। সেই কবে ভিড়ে রুদ্ধশ্বাস বাসে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু‘একটা কথার বুদবুদ বিনিময়। হয়তো অনেক রাতে চায়ের দোকান থেকে উঠে পাশাপাশি হেঁটে যাওয়া, তিরিশ বছর আগে কোনো এক পানশালার খসখসে অন্ধকারে পাশের টেবিলে দেখা কোনো মুখ পলকেই আবার চিনে নেয়া সেই পথের ধারেই! কী আশ্চর্য স্মৃতি মানুষের। আঠারোর নামতা এত চেষ্টাতেও মনে থাক না অথচ মগজের নরম নির্জনে ঠিকই রয়ে যায় পথে দেখা মানুষের স্মৃতি। হঠাৎ আবার রাস্তায় দেখা হয়ে গেলে, ‘আরে, আপনি, আবার দেখা হয়ে গেলো!’

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সেই স্মৃতি বিস্মৃতির মানুষদের নিয়ে ‘পথের মানুষ’।

গ্রামের বুক চিরে চলে যাওয়া উঁচু সড়ক। কখনো কারুর বাড়ির পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া সরু আল পথ। কখনো খালের ওপর পুরনো কাঠের নড়বড়ে সেতু এলোমেলো হাওয়ায় কাঁপা। অনেক বছর আগে কত দূর থেকে হেঁটে আসে কেউ। সকালের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। বালতি অথবা দড়িতে ঝুলিয়ে বাঁধা ঘটি তার হাতে। দুধ ছলকায় ভিতরে। হয়তো মাথায় ছোট ঝাঁকা, তাতে কয়েক আঁটি লাল শাক, একটা লাউ অথবা মিষ্টি কুমড়া। ,বাজারে চলেছে পথের মানুষ।

‘কাকা, আড়ংয়ে যান?’

‘হ কাকা, আইজ হাট বার তো। গিয়া দেখি জিনিসটি বেচন যায় কি না।

তারপর হাঁটতে হাঁতে কথার পিঠে কথা। এবার বৃষ্টি কম, গরুটা দুধ কম দিচ্ছে অথবা লাল শাক তেমন মোলায়েম হয়নি। পথের মানুষের সঙ্গে কথা গড়িয়ে গড়িয়ে মানিক নগর বাজার। গ্রামের মানুষের ভাষায় বিরাট আড়ং। লঞ্চে করে আসে তেলের ড্রাম, পাউরুটি, বিস্কুট। বিক্রি হয় ছোট ট্যাংড়া, পাবদা, কোনোদিন বড় রুই। বিচালি আর ঘাস এক পাশে পড়ে থাকে। পথের মানুষদের সঙ্গে তখন অনেক কথার ভাঙা ভাঙা ছায়াপথ জেগে ওঠে। সাধনের মিষ্টির দোকানে উড়তে থাকা মাছির ঘন ঝাঁকও যেন শুনতে পায় তাদের কথা।

‘অনেক রইদ পড়সে কাকা। সাধনের ছাতিটা নিয়া বাড়ি যান। সাধন ফিরনের সময় বৈঠকখানায় থুইয়া দিয়েন, সাধন নিয়া নিবো নে।’

বৈশাখ মাসের তপ্ত রোদ আর উল্টোপাল্টা হাওয়া মাথায় করে সাধনের ছাতা বাড়ি পৌঁছে দেয় যত্ন করে। আশ্চর্য সাধনের ছাতায় লেগে থাকা গুড়ের ঘ্রাণ আজও বেঁচে আছে মনে! সাধন ছাতাটা নিতে এসেছিলো  তো?

দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ শুরু হয়েছে। রক্তে ভেজা, আগুনে পোড়া এক শহর পেছনে ফেলে পলাতক মানুষ নিয়ে মেঘনা নদীতে ভেসেছে একটা লঞ্চ। আলোহীন লঞ্চ অসীম জলরাশি ভেঙে সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে। পেছনে কাদের গানবোট? তাড়া খাওয়া পশুর মতো পালাতে থাকে লঞ্চটা। কোথায় গিয়ে থেমে যায় এক চরে। ঝড় উঠছে তখন। গাছপালা নুয়ে পড়ছে বাতাসের ধাক্কায়, আকাশকে কেটে ফেলতে চাইছে বিদ্যুতের ধারালো ফলা। ধূলার জাল ভেদ করে পথ চেনা দায়। অন্ধকারে মৃত্যুর আশঙ্কা নিয়ে যাত্রীরা নেমে পড়ে অচেনা এক ভূগোলে। কিন্তু তখনও মানুষ ছিলো,পথের মানুষ। আশ্রয় হয়ে ওঠে তাদের ছন দিয়ে ছাওয়া ঘরবাড়ি। সামান্য খাবার আর আশ্রয় সেই বিপজ্জনক রাতে মানুষগুলোর জীবন বাঁচিয়েছিলো। কেঁপে কেঁপে ওঠা কুপির আগুনের শিখায় অস্পষ্ট মানুষের মুখ। ভুলে যাওয়া নাম। তবু পথের মানুষের স্মৃতি আজও চমকে দেয়।

পথের মানুষের কোনো কুল থাকে না, কিনারাও না। ঝটিতে দেখা হয়েই সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। শেষ হয় হয়তো আবার দেখা হবে বলে। কোনো একদিন পথ চলতে হঠাৎ হাত আঁকড়ে ধরে সেই কোনকালে নিয়মিত দেখা হওয়া চায়ের দোকানী, রেস্তোরাঁর বেল বয়, সিগাটেরে টং দোকানের মালিক। কত গল্প তখন তাদের সঙ্গে। পুরনো সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সামনে এসে দাঁড়ায়। জলে গড়িয়ে যেতে থাকে স্মৃতির ধারা।

বাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে এক হাতে রড ধরে কথা বলছিলো লোকটা বেশ নিচু স্বরে।মুখে দাড়ি, পায়ের কাছে প্যান্টটা অনেকখানি গোটানো। ঘাড়ে ঝুলছিলো চামড়ার ব্যাগ। অকারণেই মনে আটকে গিয়েছিলো মানুষটা। আবার অনেকদিন পর ভিড়ের বাসে সেই একই মানুষকে একইরকম কন্ঠস্বরে কথা বলতে শুনে চমকে ওঠাই তো স্বাভাবিক। সেই ব্যাগটাই ঝুলছে কাঁধে। সেই একইরকম করে প্যান্টটা গোটানো।

‘আরে, আপনি! কতদিন পরে আবার দেখা হলো বলেন? কোথায় যাচ্ছেন?’

এভাবে চমকে দিয়েও দু‘জন পথের মানুষ ফিরে আসতে পারে। তাদের ছোটখাট কথার চিনাবাদাম ভাঙতে থাকে সামনের স্টপেজ পযর্ন্ত। তৃতীয়বার আর দেখা হবে না জেনেও তারা গল্প করে ভীষণ আন্তরিক গলায়। ওই যে লিখলাম পথের মানুষের কুল থাকে না, কিনারাও না।  কোত্থেকে উঠে আসে তারা? বাজারে প্রতিদিন বহু মানুষের সঙ্গেই দেখা হয়। কিন্তু কখনো কারো সঙ্গে কথা বাড়তে বাড়তে একটা নদী হয়ে যায়।

পথের মানুষ হাত ধরে। পথের মানুষ চিনে রাখে। গলির মাথায় সিগারেটের দোকানী অনাবশ্যক রাত জাগে পরিচিত খদ্দেরের ফিরে আসতে রাত হলে। বাহন থেকে নেমে মানুষটা তো তার দোকানেই আসে। সিগারেট কেনে। এটা সেটা কত গল্প গড়ায় রাতের আকাশের নিচে।

হাজার দুয়ারী মানুষের মন। একদিক দিয়ে মানুষ ঢোকে, অন্যদিক দিয়ে বের হয়ে যায়। পথের অচেনা মানুষের গল্প রয়েই যায় মনের গভীরে।

ছবিঃগুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199