ফেরা…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 31 Oct 2024

2175 বার পড়া হয়েছে

Shoes

প্রয়াত কবি অরুণাভ সরকারের কবিতার কয়েকটা লাইন হঠাৎ মনে পড়ে গেলো।
                   যাওয়া বলে কিচ্ছু নেই, সবই ঘুরেফিরে আসা
                   শূন্যতায় মাথা কুটে ফিরে আসে সমস্ত সংলাপ
                   সব শীৎকার চিৎকার…

কে ফিরতে চায় না যখন মিলনই মৌলিক? প্রাচীন গোধূলীর মতো সব পাখিও ফিরে আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। ফেরার জন্য কী গভীর আয়োজন থাকে প্রকৃতির অন্তরাত্মায়। কিন্তু ফেরা কি হয়? মানুষ কোথায় ফেরে? দিন শেষে তারও প্রয়োজন হয় কর্পোরেশনের দাগ-নম্বর দেয়া একটা ঠিকানা। সবুজ কাঠের দরজা দেয়া একটা ঘর, হয়তো কখনো দিনান্তে ক্লান্তিকর সিঁড়ি, একঘেয়ে লিফট, গলির গায়ে হেলান দেয়া গলি। কিন্তু সবার তো ফেরা হয় না। কেউ কেউ ফিরতেও চায় না। কেনো চায় না? এই সন্তপ্ত সংসার কি তাদের প্রত্যাখ্যান করে?
এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ফেরা না-ফেরার গল্প নিয়ে ‘ফেরা’।

জীবনানন্দ দাশ কি ট্রাম রাস্তায় অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে জানতেন আর ফিরবেন না, তার আর ফেরা হবে না? অনেক কমলা রঙের রোদ ভেঙে কোথায় ফিরতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ? মাঝ রাস্তায় মানুষের ঠিকানা বদল হয়ে যায়। জীবনের মাঝ পথে এসে কখন যে পাল্টে যায় পৌঁছানোর ঠিকানা। কেউ কেউ তা টের পেয়ে যায়। কেউ কোনোদিন তা বুঝতেও পারে না। কখনো মনে হয়, পূর্বজন্মে দেখা পাওয়া এক লোকালয়ে ফিরে গেছি হয়তো। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, সবুজ রঙ করা একটা দরজা। কড়ায় ঝুলছে তালা। বারান্দায় অপেক্ষায় বসে আছে বাদামি রঙের একটা কুকুর। কোনো কোনো দিন এমন হয় যে ভাবি, সবুজ চা বাগানের গিয়ে বসে আছি। লেবুর ঘ্রাণে উতরোল হাওয়ায় পাতা ঝরে পড়ছে; আমার কোথাও আর ফেরার নেই। মফফসলের ছোট বাগান-শহর; সন্ধ্যা হলে বাতি নিভে যায় ঘরের। দু‘একটা রিকশার চলাচল, গলির মাথায় কোথাও একা চাপকল জেগে থাকে আর থাকে পাহারাওয়ালার বাঁশি। পথে নেমে মনে হয়, বহুদিন আগে, জন্মেরও আগে শহরটা দেখেছি আমি। এই ভাবনাটা কখনো কখনো ফিরতে দেয় না কাউকে। ভাবি, আমিও যদি আটকে যেতে পারতাম ঘোরের এমন চক্করে! ছোট শহরের গানে বোকা স্বপ্ন বুনতাম মাকড়সার মতো কোনো একটা বইয়ের আলমারির পেছনে। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠে চেনা ঘর আর চেনা বিছানার ঠিকানার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে হতো না।
তবুও ফেরা শব্দের মাঝে একটা পথের সন্ধান লেগে থাকে।
ফেরা মানেই তো চেনা পথ ধরে ফেরা। দুই শীতের মাঝখানে এরকম ফিরে আসার গল্প লেখে পাখিরা। মানুষ কি তা পারে? পারে নিশ্চয়ই। তা না হলে এত লোক প্রতিদিন ঘরে ফেরে কেমন করে? তাদের কাছে পূর্বজন্ম বলে কিছু নেই। বহুকাল আগে পরিত্যক্ত কোনো ঘর নেই। সেই ফেরা নিয়ে তাদের মনে বিশেষ কোনো গল্পও নেই। ফেরা শব্দের সুন্দর একটা ইংরেজি আছে---রোড ব্যাক। এরিখ মারিয়া রেমার্কের বিখ্যাত একটা উপন্যাস আছে এই নামে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ঘরে ফেরা সৈনিকদের নিয়ে অসামা্য এক কাহিনি। আমরাও তো আহত, রক্তাক্ত হয়ে ঘরে ফিরি দিন শেষে। ফেরার ক্লান্তি ঢাকতে চায়ের দোকান, পুরনো খবরের কাগজে চর্বিত চর্বন কখনো আচ্ছন্ন করে রাখে। কেরানী জীবনের কল্ঙ্করেখা মেনে ফিরে আসা। তখন গ্রিসের কোনো বন্দরে হয়তো বিকাল নামছে। আকাশের গায়ে তুলে দেয়া মাস্তুলে অজানা মেঘরাশি। হয়তো পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ ওঠে ক্যাঁচক্যাঁচ। অজানা সমুদ্রের নুন মেখে জাহাজগুলো ডাকে নাবিককে। সবাই সে ডাক শুনতে পায় না।
ফেরা চিরকালই মনে হয় না-ফেরার জটাজালে জড়িয়ে থাকে। অদ্ভত এক টানাপোড়েন। ফিরে এসে কেউ কেউ কিছু কিছু পায়। কবি আর প্রেমিক হলে সমূহ হারায়। অভ্যস্ত জীবনের ভিতরে না ফেরা অন্য এক বাস্তবতা। নিখোঁজ সংবাদের মতো যা ঝুলে থাকে পত্রিকার পাতায়। কতকাল সেই নিখোঁজ মানুষের আর দেখা মেলে না। একটা সময়ে সে-ও পুরনো খবর হয়ে যায়। হারানো জীবনের খবর কে আর রাখে?

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199