এত লোক জীবনের বলী…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 19 Dec 2024

3350 বার পড়া হয়েছে

Shoes

ঘরের ভিতরে মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি একটা পুরনো ভিক্টোরিয়ান টেবিলের ওপর রাখা সাদা কাগজ নিজের আত্মার মতো করে জ্বলছে। ঝুঁকে বসে লিখছেন টি এস এলিয়ট। চোখ বন্ধ করলেন একবার। পলকে দেখতে পেলেন লন্ডন ব্রিজ। হাজার হাজার মানুষ হেঁটে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন আশা, স্বপ্ন আর পরিচয়। এই জীবন্ত মানুষের মিছিলের ছবিটা পলকে মাথায় গেঁথে গেলো কবির। চমকে টেবিলে রাখা সাদা পৃষ্ঠাগুলোর দিকে স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। সেখানেও কি তিনি মানুষের বয়ে চলা স্রোত দেখতে পেয়েছিলেন? আর তাই লিখলেন সেই অমোঘ লাইন, আমি জানতাম না, এত লোক মৃত্যুর বলী!তাদের ভবিষ্যত ভেঙে বয়ে চলেছে মৃত্যু। তারা শুধু বেঁচে আছে নির্ধারিত মৃত্যুর জন্য।
কিন্তু এই জীবনের ভিতরেও কি আমরা মৃত নই? ঠাণ্ডা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে, অজানা ভবিষ্যতের দিকে শঙ্কিত যাত্রায় হাঁটিয়ে নিতে নিতে জীবন আমাদের মেরে ফেলে। শুধু অভ্যাসে বেঁচে থাকি সবাই খাতাকলমে।
এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো জীবন আর মৃত্যুর মিলে যাওয়া দিগন্ত রেখা নিয়ে ‘এত লোক জীবনের বলী’।

বেঁচে থাকতে চাওয়া মানুষের ভীষণ এক ধর্ম। উপাসনায় মন্ত্রের মতো শুধু উচ্চারিত হয় বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। মৃত্যু অবিচল, অকম্পিত আর অবধারিত জেনেও মানুষ জীবনের খোলসটাকে ত্যাগ করতে চায় না। জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলা পর্বে এলিয়টের চাইতেও আরও সরাসরি বলেছেন মৃত্যুর কথা ‘কোথাও চলিয়া যাবো’ কবিতায়...কোথাও চলিয়া যাব একদিন…তারপর রাত্রির আকাশ অসংখ্য নক্ষত্র লয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিবো না আমি।

মানুষের মায়া পড়ে যায় এই পৃথিবীর জন্য। জীবন অফুরান তাই জীবনের গান গাইতে চায় সবাই। কিন্তু সেই সফেন জীবনের গভীরে মানুষ কী আসলে বেঁচে থাকে? এই যে বয়ে চলা স্রোত আর  দৈনিকের ক্যালেন্ডারে উড়তে থাকা ক্লান্তি কি তাকে শান্তি দেয়? সকালের চা, ঝকঝকে পালিশ  করা জুতা, সেই একই শার্টের ভিতরে শরীর গলিয়ে দেয়া তারপর অফিস, বস, মিটিং, টেলিফোন, শেয়ার বাজারের আঁকাবাঁকা রেখা উঠে যাচ্ছে নেমে যাচ্ছে, যানজট, একটা হাতির বাচ্চা প্লেনে উড়ে যাচ্ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে, হাতের মুঠোয় ধরা গোলাপ শুকিয়ে যাচ্ছে, প্রেম মরে যাচ্ছে নানান ধুনবাজিতে…সময়, হে ধূসর সময় তুমি কাকে চাও? এই জীবনের পরিত্রাণ কোথায়!

‘‘আপনের মুখ ম্লান করে দেয়া ছাড়া আর কোনো প্রিয় সাধ নেই’’। এমন জীবন কি আমরা চেয়েছি?
পৃথিবী এখন আর সবুজ ঘাসের দেশ নয়। তাকে শ্রমশিবির বলে মনে হয়। মাথা নিচু করে চলা এক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি সবাই। টি এস এলিয়ট লন্ডন ব্রিজে বয়ে চলা জীবনের স্রোত দেখে চমকে উঠেছিলেন। এখন আমরা আর চমকেও উঠি না। কবি বিষ্ণু দে লিখেছিলেন এই ,
অভ্যাস হয়েছে তাই বেঁচে আছি। আমাদেরও অভ্যাস হয়েছে বলে আর চমকে উঠতে পারি না। জীবনানন্দের লাশকাটা ঘর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে;আমরা টেরও পাই না।
ম্যাকিয়াভেলির লেখা বিখ্যাত বই ‘দ্য প্রিন্স’। ম্যাকিয়াভেলি সেখানে লিখেছেন, মানুষ যত সভ্য হবে তত তার লোভ বাড়বে। তারা লোভী হয়ে উঠতে থাকবে। এই লোভ আর আকাঙ্ক্ষা যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের তার কাছে পৌঁছাতে দেয় না। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি প্রখ্যাত ব্যান্ড ইগলসের গাওয়া গান ‘হোটেল ক্যালিফোর্নিয়া’ দুনিয়া জুড়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিলো অন্তর্গত সারমর্মের জন্য। একটা হোটেলে চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে যাওয়া কিছু মানুষ ফেরার জন্য দরজা খুঁজে বেড়াচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না। জীবন খুন করেছে তাদের। আকাঙ্ক্ষার বলী হয়েছে তারা। আমরাও কি তাই নই?জীবন আমাদের কাছে কখনো কি মরুভূমির বুকে এক হোটেলবাড়ি হয়ে ওঠে না? সারি বাঁধা ঘর, লম্বা ছায়াচ্ছন্ন করিডোর, অসংখ্য চাবির বিচিত্র শব্দ আর আটকে পড়া রুদ্ধশ্বাস অনুভূতির ঢেউ ভূতের মতো তাড়া করছে। সেখানে সব আছে কিন্তু কিছুই নেই। রবীন্দ্রনাথ তো লিখে গেছেন সেই অসীম ঐশ্বর্য আর অনন্ত কারাগারের কথা।

রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির ফাঁকিটা সবাই বুঝি। বুঝতে পারি যে বন্ধনগুলোর ওপর ভিত্তি করে একটা সমাজ গড়ে ওঠে তা নড়বড়ে হয়ে গেছে। শুধু নিজের জন্য বাঁচা এখন একবিংশ শতাব্দীর নতুন শ্লোগান। সবকিছুকে বর্জন করাই নতুন শ্লোগান। এরকম একটি জীবন কে কবে চেয়েছিলো? কিন্তু সেই জীবনকেই সবাই আঁকড়ে ধরেছি। অতল গহ্বর সামনে জেনেও এগিয়ে চলেছি। অনিবার্য মৃত্যুর অস্তিত্বকে ভয় পেয়ে আবার সজীবনের শঙ্কার কাছে পরাভূত হচ্ছি নিজেদের অজান্তেই। কী অদ্ভুত এক পরিস্থিতির শিকার মানুষের মন! যাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে তারই ভূত তাড়া করে ফিরছে। বিংশ শতাব্দীর দুটি বিশ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধ্বসে পড়া অর্থনীতিও পৃথিবীর মানুষের মনকে অতটা বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়নি। যতোটা একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তির নির্ভর এক সমাজ করে ফেলেছে।
তবে কি জীবন আজ মৃত্যুর সমান? ছকে বাঁধা একঘেয়ে সময় আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে জীবিত মৃত্যুর পরিণতির দিকে?

ছবিঃ গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199