যৌনতায়, বিদ্রোহে তাঁরা...

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 1 Aug 2019

1175 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে’। সাহিত্যের বিষয় হিসেবে নারীকে দেখতেই বেশি অভ্যস্ত আমরা। পাঠক নারী বা পুরুষ যে-ই হোন তাকে আমোদ দেবে, বিনোদন দেবে নারীর এই বিষয়-মূর্তিই। এটাই পুরুষ শাসিত সমাজের সহজ ছক। নারী পুরুষের লেখার প্রেরণা, তার আকাংক্ষার বিষয় , সম্ভোগের বস্তু, হাসিল করার পণ্য । পুরুষের কলমে যৌনতা সাহিত্যের বিষয় হয়ে উঠেছে পুরনোকাল থেকেই। নারীর শরীর, তার কামনার অবয়ব, তার ডুবে যাওয়া, ভেসে ওঠা-সবকিছুই পুরুষের রচিত সাহিত্য নিজের মতো করে ফুটিয়ে তুলেছে, খ্যাতি দিয়েছে, নিমজ্জিত করেছে অখ্যাতির অন্ধকারে।      

কিন্তু নারী যখন নিজেই কলম ধরেন? তার রচিত সাহিত্যে যৌনতা অথবা যৌন চেতনাকে ফুটিয়ে তোলেন ভিন্ন বোধে,   উন্মোচিত করেন অন্য এক বাস্তবতাকে?  সে দেখার ভঙ্গীটুকু কিন্তু একান্তই নারীর দৃষ্টিভঙ্গী যা পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক ১৮০ ডিগ্রি দূরে অবস্থিত। 

সাহিত্যের পৃথিবীতে যৌনতা বিষয়টি নিয়ে কলম ধরেছেন বহু নারী লেখক। সেই প্রাচীন সময়েও সাহসের সঙ্গে পুরুষের সমাজে দাঁড়িয়ে তারা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ প্রতিষ্ঠার জন্য।এই ধারা এই একবিংশ শতাব্দীতেও প্রবাহমান। এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো তেমনি কয়েকজন নারী লেখককের কথা‘ যৌনতায়, বিদ্রোহে তারা’।

প্রাচীন গ্রিসের কবি স্যাপহো।গীতিকবিতা রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন এই নারী। তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কিন্তু তাঁর কবিতার ভাষা এবং বিষয় পরবর্তী সময়ের সাহিত্যের পাঠক এবং আলোচকদের বিষ্মিত করেছে। নারী ও পুরুষের প্রতি শরীরী প্রেমের অনুভূতি স্যাপহোর কবিতায় স্পষ্ট। ‘ফ্র্যাগমেন্ট- ৩১’ নামে কবিতায় কবি লিখেছেন,-

‘তোমার দিকে তাকালে বাকরুদ্ধ আমি/ অনঢ় জিব/শরীরের ত্বকের তলায় বয়ে চলে এক উত্তাপের প্রবাহ/ আমার দৃষ্টি আর কিছুই অবলোকন করে না।’

যিশুখ্রিস্টের জন্মেরও আগে একজন নারীর কবিতায় শরীরের চেতনার স্পষ্ট প্রকাশ চমকে দেয় এখনকার পাঠককেও।

দ্যুঁফন দ্য মরিয়ারের জন্ম ফ্রান্সে ১৯০৭ সালে। নাটক ও উপন্যাস ছিলো তাঁর লেখার বিষয়। ১৯৩৮ সালে মরিয়ারের লেখা ‘রেবেকো’ উপন্যাসটি ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা লাভ করে। অতিপ্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট উপন্যাসটির বিষয়। কিন্তু পাশাপাশি যৌন চেতনা এবং কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন নারীর যৌন অনুভূতিকে তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরেছেন। উপন্যাসে রেবেকা নামের মেয়েটির বিয়ে হয় সদ্য স্ত্রী বিয়োগ হওয়া এক ফরাসী পুরুষের সঙ্গে। স্বামীর সঙ্গে তার গ্রামের বিশাল বাড়িতে চলে আসে রেবেকা। কিন্তু সেখানে এসে সে বুঝতে পারে তার স্বামীর জীবনের উপর গভীরভাবে ছায়াপাত করে আছে সেই মৃত স্ত্রী। এক অদ্ভুত রহস্য আর অনুভূতির জগতকে উপন্যাসে নির্মাণ করেছেন মরিয়ার। তিনি লিখেছেন,‘এই রমণীটি ভেলভেটের পোশাকে অপূর্ব। পোশাক থেকে আলাদা সুবাস ভেসে আসছে।সে পোশাকটি খুলে রেখেছে সদ্য। সেটা তোমার নাকের কাছে তুলে ধরো। ঘ্রাণ পাচ্ছ?’

১৯৩৮ সালের বদ্ধ সমাজে বসে একজন নারী লেখকের লেখায় নারী ও পুরুষের শারীরিক সম্পর্কের এমন প্রকাশ দ্যুঁফন দ্য মরিয়ারের রচনাকে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে দেয়।

‘মেয়েটি চোখ বন্ধ করলে টের পায় অনেকগুলো হাত তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করছে, অনেক ঠোঁট আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে, দাঁত স্পর্শ করছে শরীরের মাংসল অংশ।’

লাইনগুলো ফরাসী লেখিকা অনায়েস নিনের লেখা।  অনায়েস নিনের জন্ম ১৯০৩ সালে ফ্রান্সে। বাবা ছিলেন কিউবার নাগরিক। মূলত স্মৃতিকাহিনীর লেখক ছিলেন নিন। কিন্তু পাশাপাশি লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ। ১১ বছর বয়স থেকেই আনায়েস নিন জার্নাল লিখতে শুরু করেন। তাঁর লেখা জার্নালের বিষয় ছিলো ব্যক্তিগত জীবন। বিয়ে, বিচ্ছেদ এবং গভীর যৌনতা।দুজন পুরুষ এসেছিলো তাঁর জীবনে। তাদের সঙ্গে যাপিত জীবনের বহু ছবির পাশাপাশি উঠে এসেছে শারীরিক সম্পর্কের একান্ত কথাও। নিজের লেখায় যৌনতা এবং যৌন অনুভূতির এই স্পষ্ট প্রকাশ চমকে দিয়েছিলো বিংশ শতাব্দীর পাঠকদের। যৌনতাকে নির্ভর করে নিন অনেকগুলি গল্প লেখেন। ১৯৪০ সালে সেই গল্পগুলো জায়গা করে নেয় ‘ডেল্টা অফ ভেনাস ও লিটল বার্ড’ নামে গ্রন্থে।

জার্নাল ও গল্পের পাশাপাশি নিন উপন্যাসও লিখেছিলেন। কিন্তু তার যৌনতা নির্ভর লেখার আড়ালে উপন্যাস পলাতক। সাহিত্যের সমালোচকরা বলছেন, সেই সময়ে এ ধরণের ‘এরোটিকা’ একজন নারীর কলম থেকে বের হয়ে আসা ছিলো সাহসের ব্যাপার।

অনায়েস নিন ১৯৭৭ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় মারা যান।

দ্বিতীয় বিশ্বযদ্ধের আগুনে তখন পুড়ছে গোটা পৃথিবী। তখন ১৯৪২ সালে আমেরিকায় জন্ম নেন এরিকা জং।বর্ণাঢ্য জীবন এই মার্কিন লেখিকার। দু’হাতে লিখেছেন উপন্যাস, কবিতা আর বিদ্রুপাত্নক রচনা। বহু সাহিত্য পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন।

এরিকা জং-এর লেখালেখির শুরু ষাটের দশকের শেষার্ধে। ১৯৭২ সালে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘ফিয়ার অফ ফ্লাইং’ হৈচৈ ফেলে দেয়। সত্তরের দশকে নারীর প্রেম, শরীরের ভাষা আর স্বাধীন যৌন ইচ্ছার পক্ষে কলম ধরে সমালোচিতও হন এরিকা। এরপর ১৯৮৭ সালে ‘সাইলকস ডটার’ নামে তাঁর উপন্যাসটিও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়।

বাংলাদেশ এবং ভারতেও নারী লেখকদের কলম সমাজের আড়ষ্ট চেতনাকে ভাঙতে সরব হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। বাংলাদেশের সাহিত্যিক ও চিকিৎসক তসলিমা নাসরিন। আশির দশকে সাহিত্য জগতে তাঁর উত্থান। তেরো বছর বয়স থেকে তসলিমা কবিতা লেখা শুরু করেন। কলেজে পড়ার সময় ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেঁজুতি নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তসলিমার কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে ‘শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা’ নামে তাঁর প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ‘অতলে অন্তরীণ’, ‘বালিকার গোল্লাছুট’ ও ‘বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা’ নামে আরো তিনটি কাব্যগ্রন্থ; যাবো না কেন? যাবো ও নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প নামে আরো দুইটি প্রবন্ধসঙ্কলন এবং অপরপক্ষ,  শোধ, নিমন্ত্রণ ও ফেরা  নামে চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়। তসলিমা নাসরিনের লেখায় নারীর ওপর দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সামাজিক নির্যাতন ও যৌননিপীড়নের ভয়াবহ ছবি ফুটে উঠেছে। নিজের লেখা প্রবন্ধে তিনি ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এ ধরণের লেখার জন্য তাকে নব্বইয়ের দশকে দেশত্যাগও করতে হয়েছে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি ও ঔপন্যাসিকরাও এ ধরণের লেখা লিখে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত, সমালোচিত হয়েছেন। কবিতা সিংহ, মল্লিকা সেনগুপ্ত এদের মধ্যে অন্যতম। কবিতা সিংহ তাঁর কবিতায় লিখেছেন,-

কিছু কি আলাদা রাখো ?
শমীবৃক্ষে, রমণী হে একা?
সত্যকার এলোচুল, সত্যকার রমণীনয়ন
সত্যকার স্তন ?
খুলে রাখো নিজস্ব ত্রিকোণ ?

পুরুষের ফ্যান্টাসি, স্বপ্নকল্পনার উপকরণে নারী, যাকে অধিকার করতে হয়, ভোগ করতে হয়। উল্টোদিকে নারীর ফ্যান্টাসি বা স্বপ্নকল্পনাতেও কি পুরুষের ভোগ্যা হবার আশা আকাংক্ষা প্রকাশিত নাকি, এর মধ্য দিয়ে সূক্ষ্ম ফাঁক সৃষ্টি করে কখনো কখনো কি মেয়েরা তাঁদের লেখায় পালাতে পেরেছেন তাঁদের নিজেদের বিপরীত মুদ্রায়, যেখানে নিয়ন্ত্রণের রাশ তাঁর নিজের হাতে?

 

তথ্যসূত্র ও ছবিঃ হাফিংটন পোস্ট, উইকিপিডিয়া

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199