দু’রকম ডালবাটা মিশিয়ে উচ্ছেপাতার বড়া

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 7 Dec 2023

2495 বার পড়া হয়েছে

Shoes
স্মৃতি ভদ্র

 

কড়কড়ে দুপুরে রোদের তেজ যত বাড়ে গাছের মাথায় কালো কাকটার একঘেয়ে ডাক তারসঙ্গে পাল্লা দিয়ে  বাড়ে।  উঠোনের মাটিতে খড়ার মানচিত্র জেঁকে বসতেই আকাশ থেকে মুছে যায় জলহীন মেঘের শেষ আলপনাটুকু। এসব সময়ে পাড়াঘেঁষা নদীটাও কেমন যেন অসহায় হয়ে পড়ে। স্রোতহীন সে নদীর গা ছুঁয়ে উঠে আসা বাতাস তীরে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই বালুচড়ের লু হাওয়া টপ করে গিলে ফেলে তাকে। আর শহরের চৌমাথায় দাঁড়ানো কৃষ্ণচূড়া গাছটা দগ্ধ বিকেলের তাপটুকু শুষে নিয়ে লালকন্ঠ হয়ে উঠতেই আকাশের টকটকে লালিমা জানান দেয় আগামীদিনের গনগনে সময়ের পূর্বাভাস।

চিরতা ভেজানো জল, ষষ্ঠীর ঘট, শেফালি পাতার রস কিংবা মঙ্গল কামনায় মায়ের মঙ্গলচন্ডী ব্রত কোনোকিছুই আমাকে অসুখ বিসুখের হাত থেকে রক্ষা করে না বা করতে পারে না।  অসুখবিসুখ বলতে সেই এক জ্বর। ঋতু পরিবর্তনের তীব্র জ্বর। জ্বরের ঘোরে কখনো কাঁদি, কখনো হাসি। আবার কখনো ডেকে উঠি,

ঠাকুমা, ও ঠাকুমা….

মাথার উপরে একটানা সিলিং ফ্যানটা ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে থেমে যায়। গাছ থেকে উড়ে যায় সারাদিন ডেকে চলা কাকটা। নির্জন দুপুরে হাক দিয়ে যাওয়া ফেরিওয়ালাও টঙ দোকানে বাতাসা ফেলা জলে গলা ভিজিয়ে জিরোতে বসে বাণিজ্যের সব ইচ্ছা ধুলায় উড়িয়ে শুধু আমার আমার জ্বরেই লাগাম লাগে না এসবদিন।

এখানে তো আর ঠাকুমা নেই যে টিনের চাল থেকে কাঁসার কলসে সোনার টুকরো, কাঁচা হলুদ আর ধানের ছড়া বেঁধে জল ঢালবে। আর নীচে দাঁড়ানো আমি সেই জলে স্নান করে মৌসুমি জ্বরের চৌকাঠে কাঁটা পুঁতবো। তাই মা খানিক পরপর হয় কপালে জলপট্টি দেয় নয়তো ঠান্ডা জলে গা মুছে দেয়। আর জ্বরে পুরে যেতে যেতে আমি হাতড়ে বেড়াই বাইরবাড়ির গা জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস কিংবা উঠোনের তাড়ে মেলা সদ্য সাবান জলে ধোয়া বাতাসের ঘ্রাণ।

শহরে এসে মা এক নতুন ব্রত ধরেছে। মঙ্গলচন্ডী ব্রত। নদীর বুক থেকে রাতডুব শেষে সূর্যটা আকাশের গা ছুঁতেই মা তুলে নিয়ে আসে পদ্মজবার কুঁড়ি। আর সেই সূর্যের রোদ মাটি ছুঁলে তবেই পদ্মজবা পাপড়ি মেলে।  ফুলের সঙ্গে লাগে তিন শিরের দূর্বা আর কাঠালপাতা। কাঠালপাতায় যবের শিষ আর ধান দিয়ে মা বানায় খিলি।এরপর দুপুরের রোদ বারবেলা পড়লে উপোসী মা ব্রতের থান সাজিয়ে  চলে যায় কালিবাড়ির নাটমন্দিরে। সেখানেই হয় এই ব্রত। ব্রত শেষে কাঠালপাতার খিলি হাতে জয়দেব জিয়াবতীর  ব্রতকথা শুনে যখন আমরা বাসার পথ ধরি তখন কখনো নটকন ফল অথবা জল সিঙ্গারা হাতে পড়ে আমার। আর বেশী বায়না ধরলে টঙ দোকান থেকে বিটলবণ ছেটানো মুচমুচে পাপর ভাজা চলে আসে আমার হাতে।

তবে আজ সেসব কিছু হবে কীনা কে জানে।  ক’দিনের জ্বরে দুধ পাউরুটি নয়তো দুধ বার্লির পর আজ বাবা বড় বাজার থেকে নিয়ে এসেছে কাজলি মাছ আর বাতাবিলেবু। যদি জ্বরের মুখে সেসব স্বাদ যোগায়। বিছানা ছেড়ে কখনো ঘরের চৌকাঠে বসি আবার কখনো বারান্দায় কুটনোকাটায় ব্যস্ত মাকে ঘেঁষে বসি। না কিছুতেই ভালো লাগে না। ক্লান্ত আর ঘোলা চোখে মুসাকে দেখি। সেই কখন থেকে উঠোনে দাগ টেনে একা একা এক্কা দোক্কা খেলে চলেছে। কতদিন হয়ে গেলো আমি খেলতে পারি না।

সেই যে যেদিন ভাদুড়ী বাড়ির জংলা বাগানে ঝরে পড়লো শেষ সজনে ফুল, আমগাছের কচিবোলের ঘ্রাণ ছুটলো বাতাসে, মসজিদের মাঠ ছেয়ে গেলো খেজুর ফুলে মনে হয় সেদিন শেষ খেলেছিলাম আমি মুসার সাথে উঠোনে, বড়দাদীর বাগানে। এরপর তো কতদিন হয়ে গেলো জ্ব্ররের তাপে সবই ঘোরলাগা দিনরাত।

আমাকে আনমনে বসে থাকতে দেখে মা কিছু একটা বোঝে। পাতলা করে জ্বাল দেওয়া সূজির বাটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

মনি, একটু একটু করে খাও।

পথ্য যোগাতে মায়ের ক্লান্তি নেই। তবে তা হলে কী হবে, কোনোকিছুই যে আমার মুখে স্বাদ যোগায় না। দু’চামচ খেয়ে বাটি ঠেলে সরিয়ে চৌকাঠে বিছানো শীতলপাটিতে আবার গা মেলি আমি। কপালের তাপ কমতির দিকে হলেও শরীরের দূর্বলতা কমার নাম নেই। ক’দিন হলো স্কুলও কামাই হচ্ছে। এরমধ্যে ঊষাদি এসে দেখে গেছে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকি,

আচ্ছা, আমার বইয়ের  কোন ভাগটা পড়ানো হলো আজ? স্কুলের সবাই কি আজও ছুটির পর দাঁড়িয়াবান্ধা খেলছে? আর স্কুল গেইটে বসা মাসির কাছে আজও কি হজমির প্যাকেট আছে…

আমার ভাবনায় ছেদ পড়ে পরিচিত এক ডাকে,

নাতিন, ও নাতিন…

বড়দাদী আজই ফিরেছে মেয়ের বাড়ি থেকে। আর বড়দাদীর ফেরা মানেই হাকডাকে পুরো পাড়া মেতে ওঠা। ধবধবে ফর্সা মানুষটির মেহেদিরঙা চুল আর বাটিভরা নতুন নতুন মোরব্বা এই শহরে আমার একমাত্র ভালোলাগা। শহরে এসেই জেনেছি শুধু নারুমোয়াই নয়, নানাপদের হালুয়া আর মোরব্বাও যখনতখন বেরিয়ে আসে প্যান্ডোরার বাক্স থেকে।

আজ বাটি ভরে দাদীর সাথে এসেছে আমলকীর মোরব্বা।

আহা, মুখখান কেমন হয়ে গেছে, ও নাতিন খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছো নাকী?

শুধু জিজ্ঞাসা করার অপেক্ষাতেই ছিল মনে হয় মা। এরপর একদমে কতদিন জ্বর, কতদিন ঠিকমতো খাই না, কতরকম পথ্য মা দিয়েছে সবকিছুর বৃত্তান্ত মা প্রায় একদমে বলে ফেললো।আজকের  কাজলি মাছের আদাঝোলও যে পথ্যই তাও জানিয়ে দিলো মা এক নি:শ্বাসে। মায়ের অসহায়ত্ব বড়দাদীর চোখ এড়ালো না।

তিতার বড়া বানাও মা নাতিনের জন্য, ওতে দেখো নাতিনের মুখে রুচি ফিরবে……রসো….

কথা শেষ না করেই বড়দাদী ভাদুড়ি বাড়ির জংলা বাগানের দিকে চলে গেলো। পতিত সেই বাড়ির এখানে সেখানে বড়দাদীই এটাওটা বুনে খায়। সেখান থেকে কোচড় ভরা কচি উচ্ছে পাতা তুলে নিয়ে এলো বড়দাদী,

ডাল বেটে কালোজিরে ফেলে বড়া বানাও নাতিন ক’লোকমা খাবে দেখো।

আজ মায়ের উপোস। আর ব্রত শেষে ফলেজলেই  দিন কাটাবে আজ। আর আমিও কিছু খাইনা ঠিকঠাক। তাই দুপুরের পদে আজ যোগারযান্তি কম। কাজলি মাছের আদাঝোল, লালশাক ভাজা আর বেগুন ভাজা হবার কথা ছিল। এখন সেসবের সাথে যোগ হলো উচ্ছেপাতার বড়া।

কাঁসার জামবাটিতে মা মটর আর মসুর ডাল ডুবুডুবু জলে ভিজিয়ে দিলো। মুসা এরইমধ্যে একবাটি মুড়ি চিবিয়ে মসজিদের মাঠে খেলতে চলে গেছে। উঠোনের সব কাজ সেরে মুসা’র মা কলতলা থেকে স্নান সেরে এসে উঠলো বারান্দায়।

কেরোসিনের পলতায় আগুন পড়েছে বেশ খানিকক্ষণ। নীল আঁচে কড়াইয়ের টেলে ভাজা হচ্ছে তারাবেগুনের চাক ভাজা। মুসার মা শিলপাটা নিয়ে বসে গেছে। একটু আদা ফেলে জলে ডুবে ফুলেফেঁপে ওঠা ডালগুলো বাটতে শুরু করলো খুব মিহি করে।

উঠোনের রোদের তেজ বাড়ছে ক্রমাগত। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা  জাম-জামরুলের নিশ্চল ছায়া সূর্যের সাথে দিকবদল করলেও পাতা কেঁপে বাতাস ছাড়ছে না এখন। তাই গড়িয়ে যাওয়া দুপুর গুমোট হয়ে তাপ ছড়াচ্ছে আরও বেশী।

মুসা’র মায়ের ডালবাটা হয়ে গেছে। এখন কচি উচ্ছে পাতাগুলো কুচিয়ে দিলো বটিতে। মা ডালবাটায় লবণ, হলুদ গুঁড়ো আর কালোজিরা মিশিয়ে ফেটিয়ে নেয়। এরপর তাতে মিশিয়ে দিলো হাতভরা উচ্ছেপাতা কুচানো। আবার ফেটানো।

ও মনি, ওঠো গা টা একটু ঠান্ডা জলে মুছে দেই।

উনুনে কড়াই বসিয়ে মা তাতে ঢেলে দিয়েছে সর্ষের তেল। সেই তেল তেতে ধোঁয়া ছাড়লে তবেই তাতে পড়বে উচ্ছেপাতার বড়া।

কলতলায় নিয়ে গিয়ে গা মুছিয়ে আমাকে বারান্দায় বসিয়ে দেয় মা এরমাঝেই।

মধ্যউঠোন থেকে গাছগুলোর ছায়া এখন সরে এসেছে ফটকের সামনের উঠোনে। কড়াইতে পাঁচ আঙুলের ছাপ দিয়ে উচ্ছেপাতার বড়াগুলো মা একটা একটা করে ছেড়ে দিচ্ছে এবার। স্টোভের নব ঘুরিয়ে আঁচ কমিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে তা ভেজে নিলো মা।

মায়ের কপাল নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। গুমোট বারবেলা তীব্র রোদের আঁচল ছড়িয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। টাইমকলে জল এসেছে মেলা সময়। চৌবাচ্চা ভরে উঠেছে টাটকা জলে। তবে সেটুকুতেও মন ভরে না মুসার মায়ের। বালতি বালতি টাইমকলের জল বেহিসাবির মতো শুষ্ক উঠোনে ঢেলে দিতে শুরু করলো। আমার জ্বরতপ্ত শরীরের মতো উঠোনটিও নিমেষে শুষে নিলো সব জল।

বারান্দায় আজ পাত পড়েছে আমার একার। আর উঠোনে বসেছে মুসা। আমার পাতে আউশের লাল ভাত, উচ্ছেপাতার বড়া আর কাজলি মাছের আদাঝোল। আমার অনিহায় আড়ি দিতে মা নিজেই ক’দিন হলো খাইয়ে দেয় আমাকে। আজও তার ব্যত্যয় হলো না। লালভাতে উচ্ছেপাতার বড়া মেখে আমার মুখের সামনে ধরতেই নাকে ধাক্কা দিলো উচ্ছেপাতার তিতকুটে ঘ্রাণ। ভাতের গ্রাসটুকু মুখে পুরতেই সোঁদা একটা স্বাদ ছড়িয়ে গেলো মুখে,

ও মা, আরেকটু বড়া ভেঙে দাও…

মায়ের মুখে কি একটা তৃপ্তির হাসি দেখা দিলো?

কী জানি কি?

মনি, খেয়ে নাও মা নাটমন্দিরে ব্রতের সময় হয়ে গেলো তো।

কতদিন পর গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আস্বাদে আমার মন ভরে উঠছে। পাতের বড়াগুলো এরইমধ্যে চলে এসেছে আমার হাতে। বড়দাদীর গলা পাচ্ছি। প্রাচীরের ওপাশে দাঁড়িয়ে বলছে,

ও নাতিন, আমলকির মোরব্বা খেও কিন্তু। জ্বরের মুখে ভালো লাগবে…

মায়ের ব্রত’র থানে পদ্মজবাগুলো পাপড়ি মেলে লাবণ্য ছড়াচ্ছে। ঘটের গায়ে সিঁদুরের ফোঁটা পড়তেই রহিম চাচা রিক্সার বেল বাজিয়ে জানান দিলো নাটমন্দিরে যাবার সময় চলে এসেছে এখন।

ছবিঃ লেখক

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199