যেতে তো হবেই

ড: সেলিম জাহান

লেখক, লন্ডন থেকে

প্রকাশ: 5 Aug 2021

2240 বার পড়া হয়েছে

Shoes

এখানে দিন বেশ দীর্ঘ এখন – ফলে সন্ধ্যে সাতটার সময়েও ঘরে থাবা মেরে পড়ে থাকে রোদ। তাই প্রায় প্রতিদিনই বাড়ী ফিরে আহারান্তে চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে বারান্দায় যাই। পূর্বী নদীর সামনের বারান্দাটিতে কাঁচ-ঢাকা টেবিলটির একদিকের সবুজ চেয়ারটিতে বসি। টেবিলটির কাঁচে পেঁজা তুলোর মত মেঘের ছবি, মুখোমুখি নীলচে শূন্য চেয়ারটিতে চুপ করে থাকে ছায়া – যেন ‘এলায়ে পড়েছে ছবি’। পূর্বী নদীর দিকে তাকাই – ভাঁটার স্রোত বয়ে যাচ্ছে জোরে। নদীতে আকাশের নীল ছায়া। কত নৌকো জলে – কোনটা বড়, কোনটা ছোট; কোনটা যন্ত্র-চালিত, কোনটা পাল-তোলা; কোনটায় লোক দেখা যায়, কোনটায় কাউকে দেখি না। নদীর জল চিরে চলে তারা সবাই – কখনও ঢিমে তালে, কখনও দ্রুত লয়ে।

নদীর এ পাড়ে আমাদের দ্বীপে নদীর ধারে বেঞ্চিগুলোতে বসে থাকে কতজন – কিশোর-কিশোরীরা, যুবক-যুবকীরা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। বোঝা যায়, কথা হচ্ছে, গল্পে মেতেছে অনেকে, উচ্চকিত হাসির আওয়াজ আসে কখনো-সখনো। ছ’তলায় আমাদের বারান্দার সামনের মাঠের ফালির প্রান্তসীমায় দু’টো ম্যাপেল গাছ বড় হয়ে নদীকে ঢেকে দিয়েছে কিছুটা। সেই গাছের মগডালে পাখীর বাসা চোখে পড়ে। শনৈ শনৈ বেড়ে উঠেছে গাছ দু’টো। তাকালে মনে হয়, যেন বলছে, ‘কি ভালো আছো তো’?

নদীর পাড়ের পথ দিয়ে কত লোক হেঁটে যায় – একা, দু’জন, বহুজন। নবীন মা-বাবারা শিশু-বাহন ঠেলে নিয়ে যান এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই বাহনটি শিশুশূন্য, শিশুটি নেমে পড়েছে বহু আগে। শিশুদের কল-কাকলি কানে ভেসে আসে। চিনি অনেককেই। ২৫ বছর আগে যাঁদের শিশু-কিশোর হিসেবে দেখেছিলাম, তাঁরাও মা-বাবা হয়েছেন। ওপরের দিকে তাকিয়ে অনেকেই হাত নাড়েন, হাসেন – আমিও হাত নাড়ি, হাসি ফিরিয়ে দেই। নদীর ওপাড়ে ম্যানহ্যাটেনের সুউচ্চ হর্ম্যরাজির ফাঁক দিয়ে ‘কনে দেখা রোদ’ এসে পড়ে বারান্দায়, শার্সিতে, টেবিলটার ওপরে। ডিমের হাল্কা কুসুমের মত নরম হলদেটে রোদ – তার মৃদু উত্তাপ পাই। ভালো লাগে। ওপারের দালানগুলোর কাঁচে বিকেলের পড়ন্ত রোদ জ্বলতে থাকে অন্ধকারে বেড়ালের চোখের মতো।

আকাশের দিকে তাকাই। মনে হয় সারা আকাশে আগুন লেগে গেছে – ‘নামে সন্ধ্যা তন্দ্রালসা, সোনার আঁচল খসা’। মেঘের রঙের সঙ্গে রোদ গুলে কতরকম যে রং ধরে মেঘমালা – কোনটা আগুন রঙা, কোনটা গোলাপী, কোনটা হলদেটে, কোনটা ধূসর-লালে মাখামাখি। কখনও কখনও মেঘমালারা কাছে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ভালবাসায়, কখনো কখনো তারা অভিমানে দূরে সরে যায়। কখনো কখনো দেখি, মেঘমালার মাঝ দিয়ে একটা জানালা তৈরী হয়েছে – তার ফাঁক দিয়ে তাকাই, কিছু একটা দেখার চেষ্টা করি। কি, তা নিজেও জানি না।
আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামে। মেঘের ওতো রং কে যেন রবার ঘষে তুলে ফেলে নরম হাতে। ম্যানহ্যাটেনের বাতি জ্বলতে শুরু করে। জ্বলে ওঠে আমাদের নদী-পাড়ের সোজা দাঁড়িয়ে থাকা বাতি স্তম্ভের আলোগুলোও। টের পাই লোকজন ফিরতে শুরু করেছে গৃহপানে। মনে পড়ে যায় সেই চরনটি – ‘যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে’।

কালো বেড়ালের মতো ছায়া ছায়া আঁধার নেমে আসতে থাকে অতি ধীরে। সেই ধূসর আবছায়ায় তৈরী হয় কোন এক অজানা রহস্য। ঠিক সে সময়েই এক ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’। সেই আধো-আঁধারে টের পাই ছায়া ছায়া কে একজন হাল্কা পায়ে বারান্দায় আসলো। বসলো আমার মুখোমুখি টেবিলের উল্টো দিকের নীলচে চেয়ারটাতে – ওটাই তার জায়গা ছিলো। তাকালো আমার দিকে, মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়লো তার কমনীয় মুখে। তারপর অভ্রান্তভাবে টেবিল পেরিয়ে তার হাত এসে ধরলো আমার হাত।

মনে পড়ল পরস্পর একে অন্যের হাত তো ধরে রেখেছি চার দশকেরও ওপরে – ছাড়িনি কখনো, কোন অবস্হাতেই। এ হাত ধরাধরি তো কিংবদন্তীতে পরিনত হয়েছিলো। এমন কি পিতৃপ্রতিম অধ্যাপক কবীর চৌধুরীও ঠাট্টা করে বলতেন, পাণিগ্রহণের এমন আক্ষরিক দৃষ্টান্ত তিনি আর কোথাও দেখেন নি। লজ্জা আমাদের কারোই ভূষণ ছিলো না – সুতরাং তাঁকেও পাল্টা ঠাট্টা হজম করতে হয়েছে। কানে নয়, মনে শুনতে পাই, ‘কেমন কাটলো তোমার দিন’? মুখে নয়, মনে বলতে শুরু করি ঐ প্রশ্নের উত্তর। শুনতে পাই হৃদয়ে সেই অতি পরিচিত অসহিষ্ণুতা, ‘আসল কথা বলো’। মনে মনে হাসি, এ অসহিষ্ণুতা সে রেখে গেছে আমাদের কনিষ্ঠা কন্যার মাঝে। জৈষ্ঠ্যা যেখানে চায় গল্পের বিস্তার – ‘তারপর কি হলো’, কনিষ্ঠা সেখানে চায় শুধু গল্পের নির্যাসটুকু – ‘আসল কথা বলো’।

অন্ধকার আস্তে আস্তে ঘন হয়ে আসে চারদিকে, বারান্দার ধূসর চাদরের মত আবছায়া কালো হয়ে আসে। অতি ধীরে নরম ছোঁয়ায় সে হাত ছাড়িয়ে নেয়, নীলচে চেয়ার ছেড়ে ওঠে। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে আমার সবুজ চেয়ারের দিকে। তার ছায়া পড়ে টেবিলের কাঁচে। আমার চেয়ারের পেছনে একহাত রেখে অন্যহাত রাখে আমার মাথায়। আমি চোখ বুঁজে সেই আবেশটুকু নেই। জিজ্ঞেস করি, ‘যাচ্ছো?’ মৃদু কণ্ঠের জবাব পাই মনের ভেতরে, ‘যেতে তো হবেই’।

আমি চোখ মেলি, তাকাই এদিক-ওদিক। সেই দুলে ওঠা মায়াবী পর্দাটি কেটে গেছে। কেউ কোথাও নেই। হু হু করে হাওয়া আসে যেন কোন দিক থেকে। গাছের পাতার হুটোপুটি শোনা যায়। আমিও শূন্য চায়ের পেয়ালাটি তুলে উঠে পড়ি – তৈরী হতে হবে আগামীকালের জন্য। আমি পা বাড়াই অন্ধকারে ঢাকা শূন্য ঘরের দিকে। শেষবারের মতো বারান্দার দিকে তাকাই – ‘কিছু কি ফেলে গেলাম’? হৃদয়ের এক গহীন কোন থেকে শুনতে পাই, ‘দু:খ তা সে আমারই থাক, পাতার নীচে ছাতার মতন, পরম ব্যাপ্তিতে’।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199