ষাটের পথে ষাটের স্মৃতি …

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 27 Jun 2024

2590 বার পড়া হয়েছে

Shoes
কামরুল হাসান
কামরুল হাসান

ষাটের দশকের প্রায় মাঝে আমার জন্ম। ১৯৬৪ সাল। ইতোমধ্যে জীবনের ৫৯টি বসন্ত পাড়ি দিয়ে কিছুদিনের মধ্যে ৬০ বছরে পদার্পন করবো। জন্ম আমার ষাট দশকে বলে নিজকে এখন তুলনামূলকভাবে প্রাচীন মনে হচ্ছে। তবে অসংখ্য স্মৃতি মানসপটে ভেসে উঠে। তার কয়েকটি কথা বলা যায়। ষাটের দশকে ঢাকা শহর আমাদের নিকট আনন্দএকটি শহর ছিলো। কারণ বাবা-মা‘র নিবিড় পরশ আর স্নেহ পেয়ে বেড়ে উঠছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১/এ – তে আমার আব্বা কোয়ার্টার পাবার আগে ১৯৬৬-৬৭ সালে আমরা এলিফ্যান্ট রোডের একটি টিনের ঘরে ভাড়া থাকতাম। গৃহমালিক গরু পালতেন। একটি গরু আমাকে ঢুশ দিয়েছিলো, হয়তো শিং ছিলো না। নতুবা বড় আঘাত পেতাম। ১৯৬৭ সালের প্রায় শেষের দিকে আমরা ফুলার রোডে আব্বার বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে চলে আসি। ফ্ল্যাটের একতলায় আমাদের পরিবারের বসবাস। বাসার বারান্দা থেকে মূল ফুলার রোড দেখা যায়। ফুলার রোডের আবাসিক এলাকাটির একটি গাম্ভীর্য্য রয়েছে। তখনকার এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ীগুলোতে গাছপালা থাকতো। একতলা ও দু‘তলা বাড়ীগুলো ছিলো ছিমছাম। তুলনায় ফুলার রোড তুলনামূলকভাবে সুউচ্চ ভবন (তিনতলা/চারতলা) ভবনসমূহ নিয়ে আরো যেন পরিপাটি, খেলার মাঠ, পরিকল্পিত ফ্ল্যাট সমূহ, প্রাচীন গাছের ছায়াশীতল প্রদানকারী শাখা প্রশাখায় পাখির বাস। এলাকার পূর্ব প্রান্তে ছাতিওয়ালা বিশাল বাংলো। বিশাল তার বারান্দা, যেন ক্রিকেট খেলা যাবে। গাড়ী বারান্দাও ছিলো। (ইমারতটি ব্রিটিশ স্থাপত্যে গড়া যা ১৯০৫-১১ সালে বঙ্গভঙ্গকালে গড়ে উঠেছিলো বলে অনুমান হয়।) চড়ুই পাখি ও পাতি কাক যত্রতত্র উড়ে বেড়াতো। গৃহের ভেন্টিলেটরের কোঠরে বাস করতো চড়ুই পাখি। আমাদের ওই বাসার উত্তরপ্রান্তে খেলার মাঠের পাশে ছিলো একটি শিশু পার্ক যেটি এখনো রয়েছে। ইউনিভারসিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে কেজি থেকে লেখাপড়া শুরু করি। আমার বাবা ঐ স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক। আই, ই, আর বিশাল ভবনে তখন আমাদের স্কুলটি ছিলো। তার খোলা অডিটরিয়ামে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সমাগম বা অ্যাসেম্বলী হতো। ওই দিকে ফুলার রোডের জীবনযাপন নিয়ম মাফিক,মার্জিত ও শান্ত আবহ। কথাবার্তায় পরিশীলিত বাংলার চর্চা ছিলো। চারিদিক খোলামেলা- অনেক জায়গা। দখিনা বাতাস ঘরে বয়ে যেতো। আমাদের প্রতিবেশীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিলো বাঙালি আর ছিলো কয়েকটি বিহারি পরিবার। এই বিহারি পরিবার দু‘টি আমাদের নিকট প্রতিবেশী ছিলো। ১১ নং ভবনের দোতালার পূর্ব পাশে আমার ক্লাসমেট বাপ্পিদের বাসা। তার বোন এমিও আমাদের বন্ধু ছিলো। শোয়েব ছিলো আমার আরেক ক্লাসমেট যে আমাদের পাশের বিল্ডিং- এ থাকতো। ওর দুই ভাই শুভ আর শাহিন আমার পাড়ার বন্ধু ছিলো। অনেকের কথাইএখন মনে আসছে। তাঁদের কথা অন্যসময়ে বলা যাবে। গার্ডনিং-এ আগ্রহী বাসিন্দারা ঘরের আঙ্গিনায় ফুলের গাছ আর সবজি লাগাতো। সাদা ফুলের ঘ্রানে মাতোয়ারা হয়ে উঠতো চারপাশ। ফুটবল, ক্রিকেট, আর ব্যাডমিন্টন খেলা হতো মাঠে। বাচ্চাদের কেউ কেউ আবার আবাসিকের রাস্তায় সাইকেল চালাতো। তখন টেলিভিশন চলে এসেছে। তবে সবার ঘরে টেলিভিশন তখনো শোভা পায়নি। তখন সাদাকালো টেলিভিশনের যুগ। তবে রেডিও ছিলো সকলের ঘরে ঘরে আর তা সারাদিন অনুষ্ঠান প্রচার করতো। বিশেষ করে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের গানসমূহ আমার আম্মার প্রিয় ছিলো। ট্রানজিষ্টার রেডিও ফিলিপস সেট আমাদের বাসায় একটি ছিলো। বিশাল আকারের রেডিও সেট থেকে আয়তনে ছোট ট্রানজিষ্টর রেডিও দেখতে অনেক সুন্দর ছিলো। ষাটের দশকে ঢাকার বিনোদনে সিনেমা অন্যতম মাধ্যম ছিলো। বলাকা সিনেমা হলে বাবামায়ের সঙ্গে বেশ কয়েকটি সিনেমা দেখেছিলাম। আবির্ভাব, চকোরিসহ অনেক সিনেমা বলাকায় দেখেছিলাম। সিনেমার ইন্টারভেলের সময় আলুর চিপস আব্বা কিনে দিতেন। কী তার স্বাদ। পরিবারের সদস্যদের রেষ্টুরেন্টে হরেক রকমের বিশেষ করে লাল-সাদা-কালোজাম- মিষ্টি খাওয়াতেন আব্বা। সে সময় রমনা পার্ক –তার দীর্ঘ জলাধারের পাশে স্থাপিত রেষ্টুরেন্টে মাংসের কাটলেট বিক্রয় হতো। ঢাকা শহর ছিলো অত্যন্ত ছিমছাম সবুজ নিসর্গ। ঘোড়ার গাড়ী চলতো। গরুর গাড়ী, ঠেলাগাড়ী, বেবিট্যাক্সী, রিকশা, টয়োটা, হোন্ডা রাস্তায় দেখা যেতো। আব্বার সঙ্গে রেসকোর্সের মাঠে ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা উপভোগ করেছি একবার। সেদিন ছিলো রবিবার, সরকারী ছুটির দিন। আব্বা আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠেও নিয়ে যেতেন বিশেষ করে ফুটবল খেলা দেখার জন্য। তিনি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল হিসেবে অনেক বিষয়ে ব্যবস্থাপনার কাজ করতেন। ১৯৬৯ সালে চন্দ্র বিজয়ের পর নভোচারী নীল আর্মষ্ট্রং, এডুইন অলড্রিন, আর মাইকেল কলিন্স বিশ্ব প্রদক্ষিনের অংশ হিসেবে ঢাকা এসেছিলো। আমরা ইউনিভারসিটি ল্যবরেটরি স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা জাতীয় পতাকা হাতে রাস্তার পাশে থেকে তাঁদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। একটি হুড খোলা গাড়িতে তাঁরা শহর প্রদক্ষিণ করেছিলো। আব্বা সবসময় আমাদেরকে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। মোহসিন হলের লিফট তখন চালু হয়েছে। তাতে আরোহন করে অবাক হয়েছিলাম এর দ্রুত উঠানামা দেখে। যাট দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল আর আবাসিক এলাকায় থাকার সুবাদে আমাদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তাঁরা ইতিহাসের সাক্ষী। এ ইতিহাস আমরা বলতে পারি নতুন প্রজন্মের নিকট। আমরা বাংলাদেশের জন্ম দেখেছি। তাই ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানের পূর্বাপর দেখেছি। “জেলের তালা ভাঙ্গবো শেখ মুজিবকে আনবো” – মিছিলের এ শ্লোগান শোনার এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে আরেকটি উল্লসিত শ্লোগান ভেসে এলো ”জেলের তালা ভেঙ্গেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি।” ছয় দফা ও ১১ দফার পোষ্টার দেখেছি। শহীদ মিনার দেখেছি। দেখেছি মিনার সংলগ্ন দেয়াল চিত্র। তা ছিলো প্রতিবাদী চিত্র। পত্রিকার পাতায় রক্তমাখা আসাদের শার্ট আমি পিতা মাতার সঙ্গে অবলোকন করেছি আর বিষয়টি জানতে পেরেছি। (কবি শামসুর রাহমান প্রায় তাৎক্ষনিকভাবে ”আসাদের শার্ট” কবিতাটি লিখেছিলেন) যে পত্রিকাসমূহ আমাদের বাসায় গ্রাহকরুপে আব্বা আম্মা পেতো তা হলো: দৈনিক পাকিস্তান, অবজারভার, চিত্রালী, ও বেগম। উল্টোরথ সিনে সাময়িকী আমাদের এক আত্মীয়া নিয়ে আসতেন। দৈনিক ইত্তেফাকও কেউ কেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। মনে পড়ে স্কুলের বাৎসরিক খেলাধুলা। গানের ক্লাস, ড্রইং ক্লাস, অ্যাসেম্বলী, টিফিন পিরিয়ডে মাঝেমধ্যে    IER ক্যান্টিনের গরম সিংগাড়া ভক্ষণ। যদিও মা টিফিন বক্সে কিছু টিফিন দিয়ে দিতো। আমাদের স্কুলের ইউনিফরম ছিলো। কো-এডুকেশন এ স্কুলের ঐতিহ্য। ইউল্যাব একটি আদর্শ স্কুল হয়ে উঠেছিলো তখন। ৬৮ সালে কেজিতে আর ৬৯ সালে প্রথম শ্রেণিতে আমি ছাত্র ছিলাম। মনে পড়ে কামরুননেসা আপার কথা। আরো অনেক শিক্ষিকা ও শিক্ষক সবাই অনেক আন্তরিক ও দরদী ছিলেন। আমার সে সময়ের সহপাঠীদের কয়েকজনের নাম স্মরণ করছি। হায়বাত, হেলাল, নাজিয়া, তানিয়া, রুপা, সাইফুল্লাহ, শুভ, বাপ্পি, রাশেদ, নাজমুল প্রমূখ। আমি দুঃখিত অনেকের নাম ভুলে গেছি। বন্ধুরা আমাকে মার্জনা করো। কেজিতে বাঙালি সংস্কৃতি বোঝাতে একটি পুতুল বিয়ের আয়োজন হয়েছিলো ঘটা করে। স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল নুরুননাহার ফয়জননেসা রেডিও-তে ছুটির দিন সকালে কঁচিকাচার আসর আয়োজন করতেন। শাহবাগে বেতার ভবনে তাঁর একটি অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছিলাম। ষাটের দশকে জন্ম নিয়ে বাবা মায়ের নিরবিচ্ছিন্ন আদর যত্ন পেয়ে আমাদের ভাই বোনদের ভিত তৈরী হতে শুরু করে। এরপর সত্তর দশক।

১৯৭১সাল।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর গণহত্যার নির্মমতা। রক্তের স্রোতধারায় মুক্তিযুদ্ধের দৃপ্ত শপথ থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মুক্তিযুদ্ধে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দান করলেন আমার আব্বা মোহাম্মদ সাদেক। বাবা তোমাকে সালাম। আমার মা তোমার সংগ্রামকে আমি স্যালুট জানাচ্ছি।

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199