মাত্র তো কয়েকটা দিন…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 16 Oct 2025

515 বার পড়া হয়েছে

Shoes

মাত্র তো তিনশ পয়ষট্টিটা দিন কিন্তু কত ঘটনা যে ঘটনা উপচে পড়ে। পথ চলতে চলতে, ঘড়ির কাটা পুরো ডায়ালটা কয়েকবার চেক্কর শেষ করার আগেই পাল্টে যায় একটা দেশ, কয়েকটা শহর, রাজনীতি;জীবনযাপন যেন পুড়ে যাওয়া মোমবাতি! শুধু আলোর স্মৃতিটুকু ফেলে রেখে যায়।

তাহলে এখন কি চারপাশে শুধুই অন্ধকার? দূরে কাছে শুধু আগুনের রেখা চোখে পড়ে? কোথায় সব পুড়ে যাচ্ছে? পৃথিবী প্রতিদিন পাল্টে যাচ্ছে। যুদ্ধে, সংঘাতে, মিথ্যা কথায় আর রাজনৈতিক বিষবাষ্পে ভরে উঠছে আমাদের চারপাশ।

শীতের এক ধরণের মৃত টান আছে। মরে আসা পানি, ঝরে পড়া শিউলি, কুয়াশার ম্লান পর্দা অতিক্রম করে দিনগুলো বসন্তে পৌঁছায়। তারপর ক্রান্তীয় সূরযের এই দেশে গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে। হেমন্তে মাঠে মাঠে ফসলের গল্প রেখে যায়। তারপর আবারও শীত আসে।

বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলাম অস্কার ওয়াইল্ডের ‘ইম্পর্টেন্স বিয়িং আর্নেস্ট’ নাটকের দেড়শ বছর বয়স হয়ে গেল। অমিতাভ বচ্চনের দুর্দান্ত অভিনয়ে ভরপুর ‘দিওয়ার’ ছবিটাও ৫০ বছরে পা রাখলো। আর আমরা আজও ঠিক কী চাই তা নির্ধারণ করতে পারলাম না।

ভয় নেই পাঠক, এখন সাহিত্যের আলাপের ডালপালা বিস্তারের কোনো আগ্রহ নেই। হঠাৎ মনে পড়লো কোনো বইতে পড়েছিলাম,দার্শনিক পাসকাল নাকি একদা চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন : ‘এখন আমি কী করব?’

আজও এই একই প্রশ্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে আমাদের অস্তিত্বকে বর্শার ফলায় গেঁথে ভিন্ন এক মহাযুদ্ধের মাঠের দিকে যাত্রা করেছে। সে যুদ্ধ কি কুরুক্ষেত্রে, নাকি ট্রয় রাজ্যে? নাকি ফোরাত নদীর তীরে এজিদের বাহিনী ঘেরাও করেছে ইমাম হোসেনকে? একটা সময়ে আত্মজিজ্ঞাসা বলে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নের প্রচলন ছিল আমাদের ভাবনার মধ্যে। সেই চিহ্নটা কি এখনও সক্রিয়? আমরা কি এখন স্বাধীন ভাবে ভাবতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি? প্রশ্ন করতে পারি, আমাদের জন্য এই নরক কারা তৈনি করে দিল? ভাষা বিনষ্ট হয়েছে, ভাবনাও তাই। পৃথিবীজুড়ে ধর্মান্ধ দক্ষিণপন্থার জয়জয়কার।

বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে দার্শনিক জাঁ-পল সার্ত্র বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে এই পৃথিবী খারাপ, কুৎসিত এবং আশাহীন। কিন্তু আমি প্রতিরোধ করছি।’ আমরা কি প্রতিরোধ তৈরি করছি? নিজের আত্মার কাছে ফিরে এসে বারংবার একই প্রশ্ন করছি। এ যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আত্মীয় চিনতে পারছি না, স্বজন চিনতে পারছি না। অস্ত্র পরিত্যাগ করতে চাইছে অর্জুন। মৃত্যু চাইছে আকিলিস। হিংসার আদ্যোপান্ত ঘিরে ফেলেছে আমাদের। নিজেদের ঘর পুড়ে যাচ্ছে আমাদের নিজেদেরই হিংসার আগুনে।

মনে পড়ে নীৎসে কী লিখে গেছেন? ‘দানবের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে সম্রণে রাখতে হবে আমরাই না আবার দানবে পরিণত হই।’ জীবনানন্দ দাশ প্রশ্ন করেছেন, ‘আমরা কি তিমিরবিলাসী?’দানবের সঙ্গে লড়তে গিয়ে আমরাই যে দানব আত্মার কাছে নিজেদের বিক্রি করেছি তার প্রমাণ তো এই স্বদেশে এখন নিত্যদিন দাঁত বের করে হাসছে। এই সমাজ, সমাজের মানুষের ভিতরকার বুননটাই ছত্রখান হয়ে গেছে।

আমরা কি বরাবরই এরকম ছিলাম? প্রশ্নটা বারংবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে ছুঁড়ে দিতে ইচ্ছে করে। সাহস পাই না; কী জানি উত্তর পাব কে জানে!

দুই শীতের মাঝখানের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম। কত শূন্যগর্ভ কথা আমরা বলে চলি, কত অঘটনের জন্ম দিই তা নিজেরাই বুঝে উঠতে পারছি কি? দুই শীতের মাঝখানে আমরা বুনে চলেছি প্রলাপের বীজ, উগ্রতার বীজ,শূন্যগর্ভ এক পরিস্থিতি। আর যার পরিণতিতে চারপাশে তৈরি হচ্ছে অরাজক এক পরিস্থিতির দেয়াল। আমাদের ঘিরে ফেলছে হতাশা। হতাশা কি অন্ধ বিশ্বাসকে ভাবনার মধ্যে প্রবল করে তোলে? হয়তো তাই। স্যামুয়েল বেকেট তার কোনো একটি উপন্যাসে লিখেছিলেন, ‘খাদে পড়ে না গেলে আমার চোখ খুলেত না।’ কী নিদারুণ সত্য! চতুর্দিকে ভীষণ অরাজকতার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মতো শক্তির কেন্দ্র নেই। মাথার উপরে শুধু জেগে থাকে অনন্ত নক্ষত্রবীথি। তারা সাক্ষী হয়ে থাকে আমাদের উন্মত্ততার, আমাদের সব অস্থিরতার। দুই শীতের মাঝখানে আমরা তৈরি করি নিজেদের ধংসের মঞ্চ।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199