এস.এম. সুলতান : আমাদের চিত্রশিল্প জগতের আদমসুরত

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 23 Jan 2025

4285 বার পড়া হয়েছে

Shoes
শাহরিয়ার আদনান শান্তনু
শাহরিয়ার আদনান শান্তনু 

"আমাদের দেশের কৃষকের জীবনধারণ এবং তারা যে খুব অল্প আহারী, খুব কষ্টের মধ্যে উৎপন্ন করে, এতে কোন সন্দেহ নাই। তাদের বেশি ভালোভাবে থাকার জন্য আকাংখা নেই।...  তারা যেন কোন ব্রতে ব্রতী রয়েছে - শুধু উৎপন্ন করে যাওয়ার জন্য"  - এভাবেই নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতান।
গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে এভাবেই তিনি দেখেছেন। লালন করেছেন। এবং ছবি এঁকে তুলে ধরেছেন এই কৃষকদের। যেখানে পেশীবহুল ও ইস্পাত-দৃঢ় চিত্তে ধান ক্ষেতে ফসল কাটছে। এই বিষয়ে এস. এম. সুলতান বলেন: "আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা মনের ব্যাপার।"  

এস. এম. সুলতানকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র " আদমসুরত" দেখতে গিয়ে তাঁকে আবার নতুন করে ভাবতে হয়। সেই ১৯৯১ সালে প্রথম দেখেছিলাম। সম্প্রতি ইউটিউবের সুবাদে আবারও দেখলাম। তবে এবার আরেক রকম অনুভূতি হলো।

তারেক মাসুদ দীর্ঘ আট বছর সময় নিয়ে এই তথ্যচিত্রটি নির্মণ করেন। এটি তারেক মাসুদের প্রথম নির্মিত তথ্যচিত্র। এস. এম. সুলতান বাংলাদেশের এমন এক ব্যতিক্রমী চিত্রশিল্পী,  যাঁর ছবি আঁকার বিষয় ও পদ্ধতি একেবারেই ভিন্ন। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, দ্রোহ ও প্রতিবাদ, বিপ্লব -সংগ্রাম ইত্যাদি রঙের তুলিতে এঁকেছেন।

একেবারেই সাদাসিধে মানুষ সুলতান। অথচ তাঁর সুযোগ ছিলো পাশ্চাত্যের কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করার। কিন্তু কী অদ্ভুত...  তিনি চলে এলেন নড়াইলে, চিত্রা নদীর পারে পুরুলিয়া গ্রামে। যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। আছে আদিম ও অকৃত্রিম রূপ। যেখানে সুলতান নিজেকে প্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পেলেন। অথচ তাঁর সমসাময়িক শিল্পীরা শহুরে নাগরিকতায় অর্থে - বিত্তে এগিয়ে গিয়েছিলেন অনেক দূর। কিন্তু সুলতান তা একেবারেই গায়ে মাখেননি। মনেও আনেননি। একেবারেই সাদামাটা জীবন কাটিয়েছেন গ্রামের মানুষের মাঝে। "আদমসুরত"-এ দেখলাম, কীভাবে এমন বরেণ্য শিল্পী সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকার সহজাত গুণের অধিকারী হলেন সুলতান। তাই সুলতান হয়ে উঠেছিলেন একেবারেই জাত শিল্পী। একেবারেই নিজস্বতায়, বৈচিত্র্যে এবং স্বকীয়তায়। যেখানে আর কোন চিত্রশিল্পীকে আজ অবধি পাইনি।

সুলতানের ছবি আঁকার দর্শন বলি কিংবা তাঁর দৃষ্টি ভঙ্গি  বলি- তা তাঁর উপরের কথাতেই বলেছেন। জন্ম থেকেই তিনি দেখেছেন জন্মভূমির কৃষক সমাজকে। নদীর পারের মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি। তিনি ছবিতে দেখিয়েছেন পৃথিবীতে খাদ্য যোগানকারী কৃষকেরাই মূখ্য ভূমিকা রেখে আসছে। তাঁরাই এই পৃথিবীর চালিকা শক্তি।  অথচ তাঁদের কথা তেমন কোথাও উল্লেখ করা হয় না। আর এই দর্শন থেকেই সুলতান ছবি এঁকেছেন কৃষক ও কৃষি নিয়ে। সবচেয়ে অবাক ও  বিস্ময় লেগেছিলো কৃষক ও কৃষাণীর পেশীবহুল শরীর। এই বিষয়ে ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম চলচ্চিত্র সংসদের একটি কর্মশালায় অতিথি হিসেবে আগত চিত্রনির্মাতা তারেক মাসুদের কাছে সরাসরি জানতে চাই। তিনি বললেন: "বাঙালি চিন্তায় ও মননে অসীম শক্তিশালী জাতি। দেখতে রুগ্ন হলেও এস.এম. সুলতানের কাছে তাঁরা অসীম বলশালী। আর এটাই তিনি ছবিতে এঁকেছেন।"
 

চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতান
চিত্রশিল্পী এস.এম. সুলতান

আমি শিল্পী সুলতানকে সামনাসামনি  দেখিনি। তারেক মাসুদের তথ্যচিত্রের মাধ্যমে দেখেছি। যেখানে তিনি মাটি,  গাছ-গাছালিতে ঘেরা আদিমতায় ঘেরা এক অন্য জগতের মানুষ। নিজের ধ্যানে ছবি আঁকছেন। বিশাল বিশাল ক্যানভাস তৈরি করছেন। শহরে থেকে নয়। গ্রামেই তৈরি করছেন রঙ। সেই রঙে ছবি আঁকছেন। আর ক্যানভাসের উপরে বসে থাকা তাঁর নিত্যসঙ্গী  বিড়ালকেও অস্বাভাবিক মনে হয়নি। তারেক মাসুদ ইচ্ছে করলে বাদ দিতে পারতেন। কিন্তু ক্যানভাসের উপর বসে সুলতানকে অবলোকনকারী বিড়াল যেন আদিমতার প্রতিক হয়ে গেছে।

শুনেছিলাম, পঞ্চাশের দশকে ফ্রান্সে সালভাদর দালী, পাবলো পিকাসো, ব্রাক- এর মতো শিল্পীদের সঙ্গে এস.এম. সুলতানের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়েছিলো। কিন্তু সেই সুলতান চলে এলেন পাশ্চাত্যের আধুনিকতায় মোড়া জগত ছেড়ে পুরুলিয়া গ্রামে। অপার ভালোবাসায় ও শান্তিতে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটিয়েছেন। নগর সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুলতানের  মনে কোন দাগ কাটেনি। তাই শহর জীবন থেকে দূরেই ছিলেন। কোন প্রদর্শনীতে আসতেন। দিন কয়েক থেকেই আবার ফিরে যেতেন গ্রামে। "আদমসুরত"-এ তা-ই দেখা গেছে।

তারেক মাসুদ দীর্ঘ সময় নিয়ে এই তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে। তারপরও সুলতানকে তো পেলাম এক বৈচিত্র্যময় ও মহান শিল্পী হিসেবে। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট তারিখে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে "আদমসুরত" -এর মাধ্যমে দেখতে পেয়ে মনে হলো: এমন শিল্পী শুধু একবারেই আসে। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যখন তাঁকে " ম্যান অব দি এচিভমেন্ট " সম্মাননা প্রদান করলো, তখনও তিনি বলেন: " শিল্পের কোন পুরস্কার হয় না। শিল্পের ভার তো প্রকৃতি স্বীয় হাতে প্রদান করে।"
বংশীবাদক হিসেবেও সুলতানকে আমরা দেখেছি। প্রশান্তি মনে বাজাচ্ছেন বাঁশী। বিখ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনও তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন। তিনিও এই মহান শিল্পীকে ফ্রেম বন্দী করেছেন। সেখানেও দেখি শিল্পী সুলতানের চোখের অসাধারণ দ্যুতি।

এমন মহান শিল্পী শেষ জীবনে এসে বলে গেলেন: " আমি সুখী। আমার কোনো দুঃখ নেই। সকল দিক দিয়েই আমি প্রশান্তির মধ্যে দিন কাটাই। আমার সব অভাবেরই পরিসমাপ্তি ঘটেছে।"  এমন কথা কেবল এস. এম. সুলতানের পক্ষে বলা সম্ভব। যিনি আজো সেই চিত্রা নদীর পারে পুরুলিয়া গ্রামে শুয়ে আছেন। এই মহান শিল্পীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199