পঞ্চাশ বছর পরে (পর্ব ১)

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 31 Aug 2023

10000 বার পড়া হয়েছে

Shoes
দীপারুণ ভট্টাচার্য

১.

লোকের মুখে মুখে ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। মুক্তি বাহিনী উনিশ জনকে যশোরের বিহারি পল্লী থেকে তুলে এনে চিত্রা নদীতে নামিয়ে গুলি করে মেরেছে। মৃতেরা সবাই পুরুষ আর জাতে  বিহারি মুসলমান। দারোয়ান কাসেম ক্লাসে ক্লাসে এসে কথাটা বলে যেতেই ভিক্টোরিয়া স্কুলে একটা শোরগোল পড়ে গেলো। অমলের বাবা সরলেন্দু মুখোপাধ্যায় নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজে ফিজিক্স পড়ান। স্কুল আর কলেজ পাশাপাশি। চিত্রা নদীর ঘাট কলেজ থেকে হাঁটা পথ। বাবা ছুটতে ছুটতে এসে অমলের হাত ধরে দৌড় দিলেন বাড়ির দিকে। সরলেন্দুদের পৈতৃক নিবাস ঢাকার বিক্রমপুর অঞ্চলে। তবে পিতা বা পৈতৃক কিছুর সঙ্গেই তার এখন কোন যোগাযোগ নেই। সরলেন্দুর অপরাধ তিনি অব্রাহ্মণ মেয়েকে বিয়ে করেছেন। অমল এখন সিক্সে পড়ে। তার জন্ম এই নড়াইলেই। গত শীতে সে এগারোতে পা দিয়েছে। তারা ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক সুবিমল চক্রবর্তীর বাড়িতে ভাড়া থাকে।

সরলেন্দু ঘরে ঢুকতেই স্ত্রী রমলা প্রশ্ন করলো, ‘কি হয়েছে?’ চেয়ারে বসতে বসতে তিনি বললেন, ‘যুদ্ধটা এবার নড়াইলেও শুরু হবে!" রমলা ভয় পেয়ে বলল, ‘এখন উপায় কি?’

-‘যতদিন গণ্ডগোল না থামে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে!’

-‘তোমাদের তো মাইনেও হচ্ছে না কত মাস হয়ে গেল। এরপর আমরা খাবো কি?’ রমলার গলা কান্নায় ধরে এলো।

বিষয়টা চিন্তারই বটে। পাকিস্তান সরকার বহুদিন হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানদের সাহায্য করা বন্ধ করেছে। ছাত্রদের থেকে টাকা তুলে কলেজ কমিটি মাসে কিছু কিছু দিচ্ছে। তবে তাকে ঠিক মাইনে বলা যায় না। কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়াও বাকি পড়েছে। নেহাত সুবিমল চক্রবর্তী অন্য মানুষ তাই, নইলে…।

-‘জানো বাবা, সবাই বলছে দেশ স্বাধীন হবে! কবে হবে বলতো?’ অমলের প্রশ্নে চটকা ভাঙ্গলো। তবে উত্তর দেওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। রমলা চমকে উঠলেন। দরজার ওপাশের লোকটা নিচু গলায় বললেন, ‘সরল, দরজা খোলো, কথা আছে!’ দরজা খুলে দিতেই সুবিমল বাবু ঘরে এলেন।

কথাগুলো অমল বুঝতে পারেনি, তবু হতবাক হয়েই শুনেছিল।

-‘খবর পালাম নড়ালে মিলিটারি নামবে। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে খবর আসছে। মিলিটারি এসে কলেজেও ঘাঁটি করতি পারে’ বললেন সুবিমল।

-‘কি বলছেন দাদা। আমরা তাহলে কি করবো?’ বাবাকে এমন উদ্বিগ্ন হতে দেখেনি অমল।

-‘লোকে বলতিছে, বোম পড়বে। তাই ভাবতিছি, একটা গত্ত বা সুড়ঙ্গ কাটায় রাখলে কেমন হয়?’

-‘গর্ত!’

-‘হ্যাঁ, দুগ্গো ভিটাটা উঁচু জায়গা। রমজানরে বললাম, একটা গত্ত করতি। বোম পড়লি, গত্তে ঢুকতি হবে!’

অমল মনে মনে ভাবলো, বোমটা যদি গর্তে এসে পড়ে, তখন কি হবে!

গর্ত কাটার সময় দিলো না পাকিস্তান মিলিটারি। বিকাল থেকেই নড়াইলের আকাশে উড়তে লাগলো কয়েকটা ছোট ছোট উড়োজাহাজ। ভয়ে তখন সবাই জড়সড়। সন্ধ্যে নামতেই প্রথম বোমাটা পড়লো চিত্রা নদীর আশেপাশের অঞ্চলে। তারপর এদিক ওদিক থেকে আসতে শুরু করলো বোমার শব্দ। সুবিমল বাবু চিৎকার করে বললেন, ‘যে যেখানে আছো, পুকুরে নামো’। সুবিমল এই অঞ্চলের পুরনো বাসিন্দা। তার পূর্বপুরুষ এককালে নড়াইলের জমিদার রতন বাবুর কর্মচারী ছিলো। এ অঞ্চলের প্রায় সব হিন্দুই লতায় পাতায় তাদের আত্মীয়। তার ডাক শুনে আশেপাশের লোকজন ঝপাঝপ নেমে পড়লো পুকুরে। পুকুরটা একটা দিঘির মতো বড়। এখানেই সাঁতার শিখেছে অমল।  কাজেই জলে তার ভয় নেই। কিন্তু এমন সন্ধ্যেবেলা সে কোন দিন পুকুরে নামেনি। বাবা মা খুব বকাবকি করে। আর আজ কি কাণ্ড, সারা পাড়া রাতের অন্ধকারে পুকুরের জলে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে আছে। জীবন যে কত কঠিন, কত জটিল সেটা অবচেতনে প্রথম বুঝতে শুরু করে অমল।

ঠিক কতগুলো বোমা পড়েছিলো অমলের মনে নেই। তখন কত রাত কে জানে। বিমানের আওয়াজ বন্ধ হতেই একে একে সবাই পুকুর থেকে উঠে এলো। আতঙ্কে সে রাতে কারো কিছু খাওয়া হলো না। মা মুড়ি খেতে দিয়েছিলো অমলের মনে আছে। অনেক রাতে আবার টোকা পড়ল দরজায়। সুবিমল বাবু বললেন, ‘সরল, নড়ালে থাকা আর নিরাপদ মনে করতিছি না। কাওসার বললো, কাল সকালেই মিলিটারির গাড়ি আসতি পারে। শুনলাম ওয়াপদা অফিসে ঘাঁটি করবে’।

সরলেন্দু বললেন, ‘ওয়াপদা, মানে ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ারের অফিস? যাক, তাহলে কলেজটা বাঁচল। কিন্তু আমরা এখন কি করবো বড়দা?’

-‘আমি বলতিছি কি, এখন নড়াল ছেড়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে’।

-‘কিন্তু, আমাদের তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই!’

-‘আমি নৌকা ডাকিছি। ব্রাহ্মণডাঙ্গা আমার গ্রামের বাড়ি। ওদিকে সড়ক পথ নাই। তাই মিলিটারি যাতি পারবে না। বৌমারে কও গুছায় নিতে। টাকা কড়ি আর সোনা দানা সঙ্গে নিও’।

সরলেন্দু বুঝলেন সুবিমল বাবুর পরিকল্পনাই সঠিক। বন্যায় সারা দেশ ভাসছে। পাকিস্তান সেনা জীবনেও এমন বন্যা দেখেনি। জল কাদার এই যুদ্ধে তারা নাজেহাল হচ্ছে। বন্যা না হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি যে কোন দিকে যেতো বলা মুস্কিল। যাই হোক, বিপদের সময় মাথা ঠিক রাখাই বড় কথা। এমন সময় সুবিমল বাবুর মতো একটা মানুষ সঙ্গে থাকলে ভাবনা কমে যায়। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে নদীর ঘাটে লোক জমে গেলো। সংখ্যাটা জনা ত্রিশ। পাড়ার সবাই যেন আত্মীয়। কাকে ফেলে কাকে রাখা যায়। দুটো বড় বড় নৌকা ঘাটে লেগে আছে। এতো কম সময়ে কিভাবে যে সব ব্যবস্থা করলেন সুবিমল বাবু ভাবতেই অবাক লাগে। সুবিমল বাবুদের এই বিরাট বাড়িতে একা রয়ে গেলো শুধু মংলা। সে এই বাড়ির কাজের লোক। কোন ছোটবেলা থেকে এখানে আছে কেউ জানে না। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে সুবিমল বাবুর স্ত্রী নিজের হাতে গরু গুলোর গলার দড়ি খুলে দিয়ে তাদের মুক্তি দিলেন। অবলা জীব, গোয়ালে বাঁধা থাকলে না খেয়েই মারা যাবে। কিছু চাল ডাল মংলার জন্য রেখে বাকি সবই তোলা হলো নৌকাতে। ত্রিশ জন লোক নিয়ে নৌকা ছেড়ে দিলো রাতের অন্ধকারে। বড় মাঝি সুবিমল বাবুকে বলল, ‘বড়দা সবাইরে ঘুমাইতে কন। নদীতে লাশ ভাসতেছে। ঐ সব না দেখাই ভালো!’ ধীরে ধীরে সব আওয়াজ কমে যেতে লাগলো। যেটুকু আওয়াজ তখনো রইল তা হল, বইঠার ছলাৎ ছলাৎ আর ক্ষুধার্ত শিশুদের গোঙ্গানির শব্দ।  

পরেরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ নৌকা পৌঁছে গেলো ব্রাহ্মণডাঙ্গায়। বড় মাঝি হাঁক দিয়ে বললো, ‘এহানে ঘাট বইলে তো কিছুই নাই। সবই তো পানির তলায়’। একে বন্যা তার উপর জুলাই মাসের নিয়মিত বৃষ্টিতে চারিদিকে শুধু জল আর জল। এই অঞ্চলে দুইটি নদী, চিত্রা আর নবগঙ্গা। কিন্তু এই গভীর বন্যায় দুই নদী মিলে মিশে একাকার। বড় মাঝি একটা নিম গাছের সঙ্গে কোন রকমে নৌকা বেঁধে একে একে সবাইকে জল কাদায় নামিয়ে দিলো। বাড়িটা বেশ বড়। সুবিমল বাবুর ভাই সুনির্মল পরিবার নিয়ে থাকেন এখানে। কিন্তু যতই বড় বাড়ি হোক না কেন এক সঙ্গে ত্রিশ জন মানুষ এসে আশ্রয় নিলে তখন বাড়ি আর বাড়ি থাকে না, শরণার্থী শিবির হয়ে যায়। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199