পার্সোনাল সার্ভিস পর্ব. ৮

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 18 Jan 2024

3590 বার পড়া হয়েছে

Shoes
দীপারুণ ভট্টাচার্য

আট.

একজনের সঙ্গে অন্য জনের জীবন কখন কিভাবে মিলে যাবে কেউ বলতে পারে না। মাঝে মাঝে অবাক লাগে সুজনের। যে বীথির সঙ্গে তার ছোটবেলা থেকে সম্পর্ক তাকে সে ধরে রাখতে পারলো না। বীথি দিল্লি চলে গেলো। আর সেই দিল্লি থেকে ফেরার পথেই সে খুঁজে পেলো প্রণতিকে। এখন জীবনটাকেই তার মাঝে মধ্যে পার্সোনাল সার্ভিস বলে মনে হয়। জানা অজানা নানান লোকের সঙ্গে কেবল লেনদেন। এই লেনদেনের মধ্যে দিয়েই গড়ে ওঠে সম্পর্ক। যেমন তার গড়ে উঠেছে প্রণতির সঙ্গে। কয়েকদিনের ফোনের আলাপে সুজন অনুভব করেছে তার মতো প্রণতিও সঙ্গীহীন। কথা বলার লোক বলতে একমাত্র বাবা। তাই মাঝে মধ্যেই ফোনে তাদের গল্প হয়। কাপুর সুজনকে বেশি বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলো। সুজন লক্ষ করে দেখেছে বাইরে কোথাও যেতে প্রণতিও তেমন উৎসাহী নয়। কিছুদিন হল সুজন তাকে বলছে তার মনের কথা। প্রণতি বলেছে, “তুমি একদিন বাড়িতে এসো। বাবার সঙ্গে আলাপ করলে তোমার ভালো লাগবে”। এই উত্তর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, প্রণতি রাজি। তবে তা মুখে বলতে লজ্জা পাচ্ছে।

সুজনের ধারণা, কাপুর এখন আর তার উপর নজরদারি করে না। মনে হয় এতদিনে সুজন তার বিশ্বাস যোগ্য হয়ে উঠেছে। মাঝে মধ্যেই কোলকাতার বাইরের তাকে কাজে পাঠাচ্ছে কাপুর। সুজনের ধারণা এই পার্সোনাল সার্ভিসের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে আছে দেশের বাইরেও। সেই জন্যেই কাপুর তাকে বলেছে পাসপোর্ট বানাতে। উৎসাহ নিয়ে কাজটা এখনো করা হয় নি। ভুবনেশ্বরের একটা হেভিওয়েট কাজের কথা কাপুর কিছুদিন হলো তাকে বলে রেখেছে। টাকাটা তুলতে হবে মুম্বাই থেকে। দিতে হবে ভুবনেশ্বরে। রাতে ফোন করে ডেট ফাইনাল করে দিলো কাপুর। সেই দিন সন্ধেবেলায় তার প্রণতির বাড়িতে যাওয়ার কথা। সুজনের মন খারাপ হয়ে গেলো। প্রণতিকে কাজের বিষয়টা বলতে সে বললো, “কাজ আগে। তুমি ফিরে এসো। বাবা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না”।

মুম্বাইয়ে গিয়ে একটা সমস্যায় পড়ে গেলো সুজন। দুইদিনের টানা বৃষ্টিতে শহরের একটা বড় অংশ জলের তলায়। টাকা পেতে দেরি হয়ে গেলো আরও দুই দিন। তারপর ভুবনেশ্বর এসে জানা গেলো যিনি টাকাটা নেবেন তিনি জরুরী কাজে চলে গেছেন শহরের বাইরে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। টাকাটা দিয়ে একটা ফাইল নিতে হবে। তারপর কোলকাতায় ফেরা। এই রকম আগেও হয়েছে। এ কাজে সব থেকে বড় সমস্যা হলো, অনিশ্চয়তা। লোকটা কবে আসবে তার ঠিক নেই। আর যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ এক মুহূর্ত হোটেলের রুম থেকে নড়ার উপায় নেই। এমন কি হোটেলের রেস্টুরেন্টে পর্যন্ত যেতে পারবে না সুজন। খাবার খেতে হবে ঘরে আনিয়ে। যক্ষ যেমন ভাবে তার ধন পাহারা দেয়, এই কাজটা তেমনই। সেই ধন যক্ষ কোনদিন আর ব্যবহার করতে পারে না। তবুও সে আগলে রাখে!

কয়েকদিন ধরে প্রণতির সঙ্গেও কথা হচ্ছে না। তার ফোন বন্ধ। কি জানি কি হয়েছে! কোলকাতায় গিয়েই তার বাড়ি যেতে হবে। সন্ধ্যার মুখে জানলার ধারে বসে দূরের বাড়ির গুলোর দিকে তাকিয়ে সুজন ভাবছিলো একটা সুস্থ জীবন কথা। সারাদিনের কাজের পর বাড়িতে ফিরে সে ডুবে যাবে সুখী পরিবারের আনন্দ সাগরে। এমন সময় হঠাৎ বেজে উঠলো বেল। দরজা খুলে সে দেখলো জনৈকা ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। একটু অবাক হল সুজন।

-“আর ইউ মিস্টার শঙ্কর সেন?”

-“ইয়েস”।

-“আমি ডেলিভারির জন্যে এসেছি”।

-“আপনার কাছে কি ডেলিভারি নোট আছে?”

সাধারণত ১০০টাকার নোটের একটা ছবি পাঠান হয়। যিনি টাকা নেবেন তিনি এসে আসল নোট দিলে তবেই তাকে টাকা দেওয়ার দস্তুর। মনে হলো, এই মহিলা বিষয়টা জানেন না। তিনি অবাক হয়ে বললেন, “ডেলিভারি নোট? কই আমাকে তো তেমন কিছু বলে নি!”

-“থ্যাংকইউ দেন” বলে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিল সুজন। আর তারপরেই ফোন করলো কাপুরের এমারজেন্সি নাম্বরে।

কাপুর ফোন ধরে না। তবে অন্য নাম্বর থেকে রিং ব্যাক করে। সব শুনে বললো, “খরব লিক হয়ে গেছে। এখন টাকা নিয়ে পালাতে হবে। দেখছি কি করা যায়”।

এই প্রথম একটা বড় বিপদে পড়লো সুজন। মনে হচ্ছে কোন রাজনৈতিক লোক আছে এর মধ্যে। টাকাটা ঠিক কত সুজন দেখে নি। অনেকদিন হলো, সে দেখা ছেড়ে দিয়েছে। তবে ওজন থেকে তার অনুমান দুই কোটি হবে। যদি হোটেলের দরজা ভেঙ্গে ওরা টাকাটা নিয়ে যায় সুজনের কিছুই করার থাকবে না। যদি পুলিশ আসে, তাহলেই বা কি করবে সে! এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা ঘণ্টার মত কাটছে। এসি বাড়িয়ে দিলো সুজন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। এখন সে জানলার দিকে যেতেও ভয় পাচ্ছে। জানলার দিকেই রাস্তা। রাস্তার ওপারে আর একটা হোটেল। ঐ হোটেলের রুম থেকে একটা গুলি চালালেই সব শেষ। তার কাছে একটা ছুরি পর্যন্ত নেই। রাতে তার খাওয়া হলো না। মেঝেতে বসে থাকতে থাকতে একসময় ক্লান্তিতে সে শুয়ে পড়লো খাট আর দেওয়ালের মাঝের সঙ্কীর্ণ জায়গাটায়। তারপর চোখ জড়িয়ে গেলো ঘুমে।

সুজন দেখছে, সে রেল লাইনের উপর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। তার কাঁধে টাকা ভর্তি ব্যাগ। তিনটে লোক তার পিছুপিছু দৌড়ে আসছে। টাকাটা কার সুজন জানে না। লোক গুলো কারা সেটাও তার অজানা। যে টাকা সে বাঁচাতে চাইছে সেটা না বাঁচাতে পারলে তার কি হবে সেটাও সে জানে না। একটা গুলি এসে লাগলো তার পায়ে। পড়ে গেল সুজন। মাথাটা পড়লো রেল লাইনের উপরে। তিনটে লোক এখন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যন্ত্রণায় সে কথা বলতে পারছে না। নড়াচড়ার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই। একজন নিচু হয়ে কেড়ে নীল ব্যাগটা। তারপর পালিয়ে গেলো লোক গুলো। সুজন উঠতে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। দূর থেকে শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসল। আতঙ্কে চোখ খুললো সুজন। তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। দরজায় কে যেন বেল বাজাচ্ছে! স্বপ্নের আতঙ্ক থেকে জেগে বাস্তবের আতঙ্কে নিজেকে দিশেহারা লাগছে। আই হোলে চোখ রাখলো সে। মনে হচ্ছে হোটেলের লোক। ওদের সঙ্গে একটা ট্রলি। যেমন ঘর পরিষ্কার করার সময় নিয়ে আসে রুম সার্ভিসের লোকেরা। কিন্তু সে তো রুম সার্ভিস কে আসতে বলেনি। এখন সে কি করবে; মাথা কাজ করছে না। আবার বেলটা বাজলো। আবার আই হোলে চোখ রাখল সুজন। দুই জনের মধ্যে একজন মহিলা। সেই মহিলা নয় তো! সুজন ঠিক করলো সে দরজা খুলবে না। এমন সময় এলো কাপুরের ফোন, “দরজাটা খুলে দাও। ওরা আমার লোক। তোমাকে গাইড করবে। ওদের কথা শোনো। সব ঠিক হয়ে যাবে”।

ঘরে এসে রুম সার্ভিসের পোশাক পরা ছেলেটা বললো, “জিনিস পত্র নিয়ে তুমি এখুনি বেরিয়ে যাও। সুভদ্রা তোমাকে হেল্প করবে”। সুভদ্রা নামের মেয়েটি সুজনকেও রুম সার্ভিসের পোশাক দিয়ে বললো, “এখুনি পরে নিন। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে”। এরপর টাকার ব্যাগটা রুম সার্ভিসের ট্রলিতে লুকিয়ে নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে সুজন বেরিয়ে এলো রুম থেকে। ছেলেটা হোটেলের রুমেই রয়ে গেলো সুজনের প্রক্সি হয়ে। তারপর পিছনের দরজা দিয়ে সুজনকে হোটেলের বাইরে নিয়ে এলো সুভদ্রা। তার কথা মতো সুজন পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে পড়লো। সুভদ্রা বললো, “আপনি পুরী যাচ্ছেন। হোটেল সৈকতের ১১২ নাম্বার ঘরে ফাইল আছে। ওটা নিয়ে ব্যাগ দেবেন। তারপর এই গাড়িটা নিয়েই আপনি কোলকাতায় চলে যাবেন”। গাড়ি ছাড়ার আগে সুজনের কানের কাছে মুখ এনে সুভদ্রা ফিসফিস করে বললো, “গাড়িটাকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া কি ঠিক হবে!” (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199