যেখানে নদীরা এসে মেশে

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 18 Apr 2019

2225 বার পড়া হয়েছে

Shoes
এস এম এমদাদুল ইসলাম

রাস্কিন বন্ড ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ভারতীয় লেখক। বন্ডের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়ী ষ্টেশনে। তাঁর প্রথম উপন্যাস “দ্য রুম অন দ্য রুফ” তিনি লিখেছিলেন ১৭ বছরবয়সে এবং এটি প্রকাশিত হয়েছিলো যখন তার বয়স ২১ বছর। তিনি তার পরিবার নিয়ে ভারতের মুসৌরিতে থাকেন। Our Trees Still Grow in Dehra লেখার জন্য ১৯৯২ সালে তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পান। ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০১৪ সালে পদ্মভূষণ পুরষ্কারে ভূষিত হন। তিরিশটির বেশি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। লিখেছেন প্রচুর নিবন্ধও। রাস্কিন বন্ডের উপন্যাস ‘অল রোডস লিড টু গঙ্গা’ একটি আলোচিত উপন্যাস। প্রাণের বাংলায় এই উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ করেছেন  এস এম এমদাদুল ইসলাম। ‘হিমালয় ও গঙ্গা’ নামে উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ এখন থেকে প্রকাশিত হবে প্রাণের বাংলায়।

ব্যাপারটা আজব, কিন্তু একথা সত্যি যে কোথাও যাবার আগেই সাধারাণত আমি বলে দিতে পারি জায়গাটা আমার পছন্দ হবে কি না। কাজেই পাউরি শহরের কুড়ি মাইল আগে থাকতেই মনে হলো জায়গাটা আমার ভালোলাগবেনা। তাই হলো। নন্দপ্রয়াগের ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা হয়েছিলো। 
বাতাসে হয়তো গন্ধ ভেসে বেড়ায়, আর সেই গন্ধ শুঁকে হয়তো আমি আগাম আন্দাজ করে ফেলি সেই জায়গাটি সম্পর্কে সেখানে পৌঁছার আগেই। এটা ঠিক ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। হয়তো বিষয়টা মোটেই সুন্দরও নয় এভাবে কোনো জায়গার ব্যাপারে আগাম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়, আর সেই সত্যিটাই আমি বলে ফেলি।
নন্দপ্রয়াগের ক্ষেত্রে মনে হয়েছে আগের কোনো জন্মে যেন আমি ওখানে ছিলাম, কারণ গাড়ি চালিয়ে আসতে আসতে মন্দাকিনী ও অলকানন্দার সঙ্গমস্থল থেকে একটু উপরে রাস্তার দু’পাশে ছোট্ট কুটিরগুলো দেখে মনে হয়েছে যেন বাড়ির পথে ফিরছি।
প্রয়াগ হলো দুটো নদীর মিলনস্থল, আর গাড়োয়ালে যেহেতু নদী অনেক, এরা কোথাও না কোথাও মিলিত হয়ে গঙ্গা বা যমুনায় গিয়ে মেশার অপেক্ষায় থাকে। কেদারনাথ, বদ্রিনাথ বা অন্যান্য তীর্থস্থানের আগে এমন অনেক প্রয়াগের অস্তিত্ব দেখা যায়। হিমালয়ের আর কোথাও এত মন্দির, পবিত্র নদী, তীর্থস্থান বা এত সাধু দেখা যায়না।
সত্যি সত্যি যেন জায়গাটি কেবল দেবতাদেরই রাজত্ব, কারণ এসব পার্বত্যাঞ্চলে মানব শাসকরা তেমন কোনো চিহ্নই রেখে যেতে পারেননি ইতিহাসে। এখানকার প্রতিটা ক্ষুদ্র জায়গাও ধর্মীয় উপাখ্যানে সিঞ্চিত। মনে হয় যেন পা-বরা মাত্র সেদিন জায়গাটি মাড়িয়ে গেছেন। হতেও পারে, যদি বিশ্বাস করেন যে সময় গত হয়না, হই আমরা। নন্দপ্রয়াগের ব্যস্ত ছোট্ট বাজারটির একটু পরেই ট্যুরিস্ট রেস্টহাইজ। সম্ভবত এই অঞ্চলের অতিথিশালাগুলোর সেরা। প্রধান সড়কের হৈ চৈ থেকে দূরে অবস্থিত রেস্টহাইজটিকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর একটি বাগান ও নানান ফলের গাছ।
একটু উপরে রয়েছে পায়ে চলার তীর্থযাত্রার পুরনো পথটি। এখানে স্মরণে আনা যেতে পারে যে কুড়ি বছরের কিছু আগে আপনি আত্মশুদ্ধির সন্ধানে বদ্রিনাথ বা কেদারনাথ আসতে চাইলে ওই পথে পায়ে হেঁটেই আসতে হতো সুদূর হৃষিকেশ থেকে মাস দুয়েক লাগিয়ে কয়েকশত মাইল অতিক্রম করে। সেই সময়ে মানুষের হাতে সময় ছিলো, অন্তরে বিশ্বাস ছিলো, আর ছিলো ধৈর্য। অসুস্থ হয়ে বা পথ হারিয়ে কখনো কখনো তারা বাধাপ্রাপ্ত হতেন, তবে শেষমেশ স্বর্গের নৈকট্য লাভ হলে এসব সাময়িক অসুবিধা কোনো অসুবিধাই নয়। এদের কেউ কেউ অবশ্য ফিরতি যাত্রা পর্যন্ত টিকতেন না। আজকালকার তীর্থযাত্রীদের বিশ্বাসে কমতি না থাকলেও তারা অবশ্য তীর্থ শেষে জীবিত বাড়ি ফিরতে পারার আশা বজায় রাখেন মনের মধ্যে।
পুরনো তীর্থপথ বরাবর চোখে পড়বে চমৎকার কিছু পুরনো ঘরবাড়ি, আমগাছ, পেঁপে ও কলাগাছ শোভিত হয়ে। উপরে পাহাড়ে পাইনগাছের সারি চোখে পড়ে, কিন্তু নিচে এখানকার প্রকৃতি ঈষদুষ্ণ অঞ্চলের মতো। নন্দপ্রয়াগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩,০০০ ফুটের মতো উচ্চে অবস্থিত , বাতাসের প্রকোপ কম থাকায় এখানে সবুজ উদ্ভিদ জন্মানোর পরিবেশ বিদ্যমান।
ওই সব বাড়িঘরের একটি দোতলা বাড়িতে থাকেন বিদ্যান ও নিভৃতচারী মি. দেভকি নন্দন বৈষ্ণব। তিনি আমাকে তাঁর বাড়িতে স্বাগত জানান এবং নানান পদ খাওয়াতে খাওয়াতে এমন অবস্থা করেন যে মনে হয় আমার পেট বিস্ফোরিত হবে। গাড়োয়ালে তাঁর এই ছোট্ট নিবাস নিয়েভালোলাগার অন্ত নেই তাঁর। তিনি গর্বভরে নন্দপ্রয়াগের উপরে লেখা তাঁর সংগৃহিত নানান পেপার কাটিং বের করে দেখান আমাকে। তার একটি সিস্টার নিবেদিতার লেখা বই থেকে, ইনি মার্গারেট নোবল নামের একজন ইংরেজ মহিলা, যিনি হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯২৮ সালে তার লেখা:

‘নন্দপ্রয়াগ-এর সুখ্যাতি তার সৌন্দর্য ও সুবিন্যস্ততার জন্য। এখানে পৌঁছার দুই-এক মাইল আগে থেকেই আমরা এই জায়গার উন্নত চাষাবাস পদ্ধতি ও কোথাও কোথাও স্বযত্নে রচিত ফল ও সবজি বাগান লক্ষ করেছি। কৃষকসম্প্রদায় দেখতে শুনতে কাশ্মিরীদের থেকে কম যায়না। গোহ্না প্লাবনের পরে পুনর্নির্মিত শহরটি এখন নতুনের মতো, মন্দিরটি বিস্তির্ণ মাঠের সুদুরে প্রয়াগের কূলে নির্মিত। মন্দিরটির স্থাপত্য খোদাইয়ের মধ্যে যেন একধরনের তেজ ক্রিয়াশীল রয়েছে, পুরো নির্মাণজুড়ে যেন রত্নশোভা বিরাজ করছে। এই মন্দিরটি নাগদেবতা তক্ষককে নিবেদিত। নদী পার হতে হতে দুটি প্রাচীন পাঠান সমাধি লক্ষ করি, শ্রীনগরের উত্তরে (গাড়োয়ালে) একমাত্র মুসলমান বসতির চিহ্ন।’

সিস্টার নিবেদিতার সময় থেকে এখানে তেমন পরিবর্তন হয়নি, এবং নন্দপ্রয়াগে এখনো অল্পকিছু পাঠান বসবাস করছে। সত্যি বলতে আমি যখন মি. বৈষ্ণব-এর সঙ্গে দেখা করতে আসি তখন তিনি আসলে তাঁর মুসলমান বন্ধুদের জন্য ঈদ শুভেচ্ছা পাঠাবার আয়োজনে ব্যস্ত। পুরনো কিছু সমাধি রাস্তা বানাবার কালে ধ্বংস হয়েছে। দুঃখের কথা হলো সিস্টার নিবেদিতার বর্ণিত চমৎকার মন্দিরটিও নাকি ১৯৭০-এর বন্যায় ভেসে গিয়েছে। সেসময় অলকানন্দা প্রবল বর্ষনের সময় ভাঙনে মেতে উঠেছিল।
মি. বৈষ্ণবের সে সময়কার কথা মনে আছে যখন তিনি পায়ে হেঁটে পাউরি এসে মেসমোর মিশনারি স্কুলে পড়তে আসতেন। গাড়োয়ালের অনেক কৃতিসন্তান এইস্কুলে তাঁদের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছেন। পাউরি যেতে তখন তাঁর লাগতো চার-চারটা দিন, আর এখন লাগে চার ঘণ্টা, বাসে করে। ১৯৬২ সালে চিনাদের আক্রমণের পর উত্তরভারতের পাহাড়ি জেলাগুলোতে রাস্তা তৈরির হিড়িক পড়ে যায়। তার আগে পর্যন্ত এখানকার লোকজন হাঁটতো, এবং হাঁটা নিয়ে তাদের কোনো অভিযোগও ছিলোনা।
সেই সন্ধ্যায় রেস্টহাউজের ছোট্ট বাগানটিতে একা বসে অসংখ্য পাখির কলতান শুনছি। এদের কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা, কারণ আলো কমে এসেছে তখন, গাছগুলো প্রায় আঁধারে ডোবা। তবে পাহাড়ি ঘুঘুর করুণ সুর চিনতে পারছিলাম, তার সঙ্গে সরু কণ্ঠে কোয়েলের ক্রমবর্ধমান চিৎকার। বাকি আরো অনেক শিস, কলতান ধরতে পারছিলামনা। আহা, সালিম আলি আমার সঙ্গে থাকলে হতো!
এখন আবারো যখন জিনিয়াঘেরা বাগানটিতে বসি তখন আমার মনে হয় এখানে আমি আগেও এসেছি। আনার ও করবী ফুলের গাছে সজ্জিত সবুজ পাহাড়ি জায়গাটি পরিচিতই ঠেকে। শৈশবের কোনো স্মৃতি? কিন্তু আমার শৈশবে হৃষিকেশের পরে আসা হয়নি। দুন উপত্যকা মানুষের ঢলে নিমজ্জিত না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে নন্দপ্রয়াগের কোনো কোনো অংশের কিছু মিল ছিলো। তবে দুনে আপনার বাগানের পাশ দিয়ে কোনো বড়ো নদী বয়ে যায়নি, অথচ এখানে রয়েছে দুটো, আর এরাও আমার স্মৃতিকে খোঁচাচ্ছে। কাজেই আমি হয়তো আমার পূর্বের অস্তিত্বে এসেছি এখানে-তীর্থযাত্রী হয়ে বা ফুলবিক্রেতা হিসেবে। অথবা হয়তো সেই জন্মে আমি এখানকার বাসিন্দাই ছিলাম, আর তাই এত পরিচিত ঠেকছে সব কিছু। কে বলতে পারে? সে যাই হোক, রহস্য উদ্ঘাটনের চাইতে রহস্যাবরণে থাকার মজা বেশি।
আমার ঘর-তদারকির ছেলেটি এসেছে বাগানে আমার সঙ্গে আলাপে। ম্যানেজারের অনুপস্থিতিতে ছেলেটিই একরকম রেস্টহাউজটি চালায়। যেকোনো মুহুর্তে কোচ-ভর্তি তীর্থযাত্রী এসে পড়বে, তার আগে পর্যন্ত আশেপাশে পাখিদের উপস্থিতি ছাড়া জায়গাটি শূন্য। ছেলেটির নাম জানকপাল, সে আমাকে পাশের পাহাড়ে তার গাঁয়ের গল্প বলে, জানায় সেখানে এক চিতার দৌরাত্ম্য। প্রায়ই গরু-ছাগল জানোয়ারটির থাবার নিচে প্রাণ দিচ্ছে। চিতা-রক্ষার আইন নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, কিন্তু চিতারা মানুষখেকো না হয়ে উঠলে ওদেরকে মারার অনুমোদন নেই।
হঠাৎ একপশলা বারিবর্ষণ হলো আমাদের উপর, সেই সঙ্গে আগমণ তীর্থযাত্রীদের। জানকপাল ছুটে গেল সেদিকে। আমাকে বেশিক্ষণ একা থাকতে হলো না, চা নিয়ে এলো আরেকটি বাচ্চা ছেলে। সে আমাকে জানালো যে সে এখানে নন্দপ্রয়াগে বাসন ধুয়ে ক্লান্ত, আর পারছেনা এখানে। এখন যেতে চায় মুসৌরি বা দিল্লি, সেব্যাপারে আমার সাহায্য চায় সে।
‘এখানেই ভাল আছো,’ বললাম আমি আন্তরিকভাবেই। ‘মুসৌরিতে দ্বিগুণ বাসন ধুতে হবে, আর দিল্লিতে দশগুণ।’
‘কিন্তু ওসব জায়গায় সিনেমা, ভিডিও আছে,’ তার জবাব, আর আমি লা-জবাব।
বৃষ্টি থেমেছে, আমি হাঁটতে বের হই। তীর্থযাত্রীরা আছে নিজেদের নিয়ে, কিন্তু স্থানীয়রা আলাপে সদাউন্মুখ। কাজেই আমার একাকিত্ব ক্ষণস্থায়ী। একটা প্রবাদ (সম্ভবত গাড়োয়ালি) মনে পড়ে, ‘সবাই আমার বন্ধু, শুধু খুঁজে নিতে হবে তাদের।’ পাহাড়ে জীবন চলে ধীরতালে, সভ্যভব্য ভাবে, সেখানে সারাক্ষণই বন্ধু মেলে।
মুসৌরির সিনেমাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, জানকপাল একদিন ঠিকই দিল্লি যায়, কিন্তু সেখানকার টিকেটের উচ্চহার তার নাগালের বাইরে। (চলবে)

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199