পার্সোনাল সার্ভিস পর্ব. ২

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 7 Dec 2023

4775 বার পড়া হয়েছে

Shoes
দীপারুণ ভট্টাচার্য

দুই.

কাঞ্চন দাস কৃষ্ণনগরেরই ছেলে। তবে গ্রামে সে যায় না অনেকদিন। তার বাবা ভোলানাথ দাস ছিলেন কৃষ্ণনগরের নাম করা যাদুকর। সুজন শুনেছে, প্রথম জীবনে ভোলানাথ হাটে বাজারে খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন। খুব সাধারণ ভাবেই চলতো ভোলানাথের সংসার। তখন সুজনের বাবা এই পরিবারটাকে নানান ভাবে সাহায্য করেছেন। ভোলানাথ কাকু একসময় তার বাবার সঙ্গে একই স্কুলে পড়তো, সুজন শুনেছে। তাই কাঞ্চন দাস পরীক্ষার ফি দেওয়া থেকে বই কিনে দেওয়া, সুজনের বাবা অনেক করেছেন। কাঞ্চন কোলকাতায় এসেছে বাবা মারা যাওয়ার পরে। এখন সেও যাদুকর। এতদিনে নিশ্চয়ই ভালো রোজগার করে। আশ্রয় চাইলে কি আর মানা করবে! তবে সুজনকে কিছুদিনের মধ্যেই একটা কাজের জোগাড় করতে হবে।

“আচ্ছা, বঙ্গবাসী কলেজটা কোনদিকে বলতে পারেন?” প্রশ্ন শুনে একজন রাস্তা বলে দিল। বিদ্যাপতি সেতুর নিচের দোকান গুলো এখন একে একে বন্ধ হচ্ছে। কাঞ্চনের বাড়ি সুজন একবারই এসেছে। কলেজ স্ট্রিটে বই কিনতে এসে সেবার কাঞ্চনের সঙ্গে দেখা। বঙ্গবাসী কলেজের কাছে এসে সুজন সেই সরু গলিটা খুঁজতে লাগলো। গলিটা এতটাই সরু যে দুইজন মানুষ পাশাপাশি যেতে পারে না। গলিটা একবার পেয়ে গেলেই বাড়িটা খুঁজে পাওয়া যাবে। কলেজের সামনে সকালে একটা বাজার বসে। এখন এলাকা অন্ধকার ও চুপচাপ। একটা চায়ের দোকান টিমটিম করে চলছে। সুজন এগিয়ে গিয়ে বলল, “দাদা, এখানে যাদুকর কাঞ্চন দাস কোথায় থাকে বলতে পারেন?” বয়স্ক দোকানদার হাত নেড়ে বললো, “এই বাচ্চু, কাঞ্চন দাসের বাড়িটা দেখিয়ে দে তো”। বাচ্চু নামের ছেলেটা বেঞ্চে বসে বিড়ি টানছিলো। সে বললো, “কাঞ্চন‘দার সঙ্গে কি দরকার?” তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করেই চললো বাড়িটা দেখিয়ে দিতে।

দরজা খুলে চমকে গেলো কাঞ্চন, “আরে সুজন তুই, এত রাতে?” উত্তর দেওয়ার আগেই বাচ্চু বললো, “দোকানে এসে তোমার নাম ধরে ডাকাডাকি করছিলো। তাই নগেন দা বললো…” কথা শেষ করার আগেই কাঞ্চন বললো, “তুই এখন যা বাচ্চু। আয়, ভিতরে আয় সুজন”। পায়রার খোপের মতো দুটো ঘর। এক চিলতে বারান্দা। তার পাশেই রান্নার জায়গা। উল্টো দিকে একটা বাথরুম। কাঞ্চন যে ঘরে তাকে নিয়ে এলো সেখানে উঁচু খাটের উপর এক বৃদ্ধা শুয়ে আছেন। খাটের নিচে সারি সারি জিনিস। বাকি মেঝের উপর মাদুর পাতা। সুজন ব্যাগ রেখে বসলো। কাঞ্চন বললো, “কি ব্যাপার বল তো?” দরজার আড়ালে কাঞ্চনের বউ, নিভা এসে দাঁড়িয়েছে, সুজন বুঝতে পারলো। সে চোখে মুখে একটু দুঃখের ভাব এনে বললো, “মামা, তাড়িয়ে দিয়েছে কাঞ্চন‘দা। কয়েকটা দিন আমাকে একটু আশ্রয় দাও”। কাঞ্চন হ্যাঁ বা না বলার আগেই নিভা ঘরে এসে দাঁড়াল। কাঞ্চন কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। তারপর আমতা আমতা করে বললো, “আমাদের এখানে তো বুঝতেই পারছিস জায়গা বড়ই কম। তার মধ্যে মায়ের যা অবস্থা” বলে খাটের দিকে চোখ দিলো। “চোখে দেখতে পারে না, কথা বলতে পারে না…” তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে নিভা বললো, “হ্যাঁ, এখানে থাকা মুশকিল ভাই”। সুজন বুঝলো কথা তাকে নিভার থেকেই আদায় করতে হবে। সে বললো, “বৌদি, আমি তোমার ছোট ভাইয়ের মতো। দু-চার দিন থাকতে দাও। এর মধ্যে একটা কাজ জুটিয়ে ঠিক চলে যাবো। তোমরা না দেখলে আমাকে তো ফুটপাতে থাকতে হবে”। নিভা কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলো। তার আগেই কাঞ্চন বললো, “এক সময় আমরা যখন বিপদে ছিলাম, তখন তোর বাবা অনেক সাহায্য করছেন। ঠিক আছে, থাক কিছুদিন। তবে বুঝতেই তো পারছিস…!” নিভা মুখ ভার করে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো।

সকালে ঘুম থেকে উঠে যে চিন্তাটা প্রথম সুজনের মাথায় এলো সেটা হলো, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা। গহনা গুলো আজই বিক্রি করতে হবে। টাকা পয়সা বাড়িতে রাখা নিরাপদ নয়। পাড়ার ছেলে সৈকত একটা প্রাইভেট ব্যাঙ্কে চাকরি করে। কাঞ্চনের কথায় অ্যাকাউন্টটা খুলে গেলো। কাজ মিটিয়ে সুজন চললো, বউ বাজারে। সোনার দোকানের লোকেরা পুরনো সোনা নিয়ে নতুন গহনা দেয়। কিন্তু সোনা কিনে টাকা দেয় কি! সুজন জানে না। তাছাড়া, এতো গুলো টাকার জিনিস যদি কোন বিপদ হয়! অবশ্য রিস্ক সুজনকে নিতেই হবে। ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মোড় থেকে ডান দিকে ঘুরতেই সারি সারি সোনার দোকান। নানান গহনা পরা মডেলদের ছবি আর আলো ঠিকরে বেরনো রত্নের পোস্টার। শ্রী ভৃগু’র রাশিফল পড়তে এক জায়গায় বেশ কিছু মানুষের ভিড়। সুজন তার রাশি নক্ষত্র জানে না। সে মাঝারি গোছের একটা সোনার দোকানে ঢুকল। মালিক বয়স্ক মানুষ। সঙ্গে দুই জন যুবক কর্মচারী। সকালের দিকে তেমন লোক থাকে না। লোক আসে দুপুরেরে পরে। তাই দোকান ফাঁকা। সুজনকে দেখে খরিদ্দার বলে মনে হচ্ছে না। বৃদ্ধ বললেন, “কি চাই?”

হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল সুজনের মাথায়, “একটা বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি জেঠু”।

বৃদ্ধ অবাক হয়ে বলল, “বিপদ!”

-“বাবার চিকিৎসা হচ্ছে। অনেক টাকার দরকার। আমাদের তেমন কিছু তো নেই। মায়ের এই গহনা কটা নিয়ে আপনি যদি টাকা দেন”।

বৃদ্ধ একটা দীর্ঘ-শ্বাস ফেলে বললো, “সোনা বিক্রি করবে; কই দেখি”।

সুজন রুমালে জড়ান গহনা গুলো এগিয়ে দিল। সকালের কাগজে সে সোনার দর দেখেছিল। দোকানের বাইরেও সেটা লেখা আছে। বৃদ্ধ কালো পাথরে গহনা গুলো খানিক ঘষে এবং ওজন করে বলল, “এক লক্ষ চল্লিশ হাজার দুশো”।

হিসাবটা সুজন নিজেও করলো। তারপর বললো, “জেঠু, টাকা তো কম মনে হচ্ছে”।

-“হ্যাঁ, বারো শতাংশ বাদ যাবে”।

সুজন ঠিক করলো, দরাদরি করবে না। এই টাকাটাই অনেক, অন্তত তার একটা চাকরি পাওয়া পর্যন্ত। সে মুখে খানিকটা দুঃখের ভাব আনার চেষ্টা করে বললো, “এতে বাবার চিকিৎসা হবে না। কিন্তু কি আর করা যাবে! আপনি জেঠু, ওটাই দিন দেখি কি হয়”।

সোনার দোকানের ভদ্রলোক এবার একটু হেসে বললো, “এখনো বহুনি হয়নি। টাকা এখন দেওয়া যাবে না”।

সুজন অবাক হয়ে বললো, “তাহলে?”

-“তিন চার ঘণ্টা পরে আসতে হবে। দুপুর দুটোর আগে কিছুই হবে না”।

সুজন বুঝতে পারছে না। এখন তার কি করা উচিৎ। হাতে কোন কাজ নেই। ঘণ্টা তিনেক এই দোকানের ঠাণ্ডাতে বসে থাকা যেতেই পারে। কিন্তু দোকানদারের অন্য কোন ধান্দা নেই তো! যদি টাকা না দেওয়ার মতলোভ থাকে! সুজন বললো, “জেঠু বাবার তো অপারেশন। টাকাটা তাই খুবই দরকার। আমি কি এখানে কিছুক্ষণ বসতে পারি?”

ভদ্রলোক কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, অপেক্ষা করো”। একজন কর্মচারী সুজনকে চা আর খবরের কাগজ দিয়ে গেলো। সে বড় একটা চা খায় না। কিন্তু আজ না বললো না। চা খেতে খেতে একটা বুদ্ধি তার মাথায় এলো। এই বুড়োর কাছে একটা কাজ চাইলে কেমন হয়? সে একটু চিন্তা করে বললো, “জেঠু, আপনার সন্ধানে কোন কাজ আছে? আমার একটা কাজের খুব প্রয়োজন”। লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার তাকাল, কোন উত্তর দিলো না। মনে হলো, প্রশ্নটা পছন্দ হয় নি। এমন সময় একজন খরিদ্দার দোকানে এলেন। এই লোকটা বহুনি কাস্টমার। সে চলে যেতেই মালিক বললো, “মুন্না কে একটু ডাক তো”। একটু পরে নোংরা পাজামা পাঞ্জাবী পরা মুন্না দোকানে এলো। তাকে ঠিক সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। মালিক বললো, “এক লাখ”। মুন্না যন্ত্রের মতো পাজামার ভিতর থেকে টাকার বান্ডিল বার করে ডেস্কের উপর রাখলো। তারপর পাজামার দড়ি টানতে টানতে দোকানের বাইরে চলে গেল। দোকানদার সুজনের টাকা মিটিয়ে দিতেই সে রাস্তায় বেরিয়ে এলো। এখন তার রীতিমতো ভয় করছে। ঐ মুন্না ছেলেটা তার পিছনে লোক লাগাবে না তো। সুজন হনহন করে হাঁটতে লাগলো ব্যাঙ্কের দিকে। একসময় ব্যাঙ্কের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে তবে ভালো করে শ্বাস নিলো। সৈকত ছেলেটা টেবিলে বসে কাজ করছে। সে আবার কাঞ্চনকে বলে না দেয়! তবে এসব ভেবে বেশি লাভ নেই। রিস্ক নিতেই হবে। সুজন টাকাটা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে দিল। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199