পঞ্চাশ বছর পরে (পর্ব ৪)

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 28 Sept 2023

16205 বার পড়া হয়েছে

Shoes
দীপারুণ ভট্টাচার্য

চার.
সব শুনে নির্মল কাকা আসাদ ভাইকে বইসে ইন্ডিয়ার দালালি করলে জবাই কইরে দিমু”। লোকটা শেষ খবর দিলো। আসাদ এসে খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়ার সুরে বলল, “মিলিটারির দোহাই দিইয়া রাজাকার বাহিনী এখন গ্রামে লুটপাট চালাচ্ছে। তবে আপনাগো ভয় নেই। আমি একটা ব্যবস্থা করতিছি”।  
সুবিমল বাবু বললেন, “এবার আমাদের নড়ালে ফিরে যাওয়া উচিৎ। গ্রাম এখন আর নিরাপদ নয়”। 
-“কিন্তু কাকা, এতো লোকের সঙ্গে নড়ালে যাবেনই বা কি কইরে?” 
-“সেটাই তো ভাবতিছি”।
-“এতদিন যখন থাকলেন আর কয়দিন থাকেন কাকা”। এরপর সে নিচু গলায় বলল, “শোনা যাচ্ছে ইন্ডিয়ার মিলিটারি ঢুকে পড়বে। ইন্ডিয়া যদি আসে না কাকা, শালার পাকিস্তানিদের এমন ঘাপান দেবে…ওরা পালাতি পথ পাবে না”।
ইন্ডিয়ার মিলিটারির নাম শুনে কেউ কেউ মনে একটু শান্তি পেল। কিন্তু সুবিমল বাবু শান্তি পেলেন না। তিনি বিড়বিড় করে একটাই কথা বলতে লাগলেন, “ব্রাহ্মণ বাড়িতে গরুর অপমৃত্যু ভালো লক্ষণ নয় আসাদ; একদম ভালো নয়!” 

ভাবতে ভাবতে সন্ধ্যা হল। আর তার সাথে শুরু হল এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ। এই কয়েক মাসে গুলির শব্দ গা সওয়া হয়ে গেছে অমলের। মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে বিলের মধ্যে গিয়ে নৌকায় বসে থাকতে হয়, এই তো। এ নিয়ে কেউ আর প্রশ্ন করে না। সেদিন একজন বলল, মুক্তি বাহিনীও নাকি বিলের মধ্যে লুকিয়ে থাকে সন্ধ্যার পর থেকে। ভোর রাতের দিকে তারা বের হয়। রাজাকারদের কুপিয়ে খুন করে আসে। কিংবা বাড়িতে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। রাজাকাররাও তাই উঠে পড়ে লেগেছে মুক্তি বাহিনীকে খতম করতে।   

পরদিন সকালে আবার মাছ ধরতে বের হল অমল। এখন সে ভালোই শিখে গেছে বিষয়টা। একটা নৌকাতে সে আর তার বাবা। অন্যটাতে হারান আর পরেশ দাদা। বিলের মধ্যে আগাছার জঙ্গল এখন অনেকটা কম। তাই অনেক দূর পর্যন্ত পরিস্কার দেখা যায়। তাদের নৌকা দেখে দূর থেকে একটা মোটর বোট সেদিকে এগিয়ে এলো। সেখানে একজন মিলিটারি আর কয়েকজন বাঙালি। এরাই কি রাজাকার! প্রশ্নটা মাথায় আসতেই একটা লোককে চিনতে পারলো অমল। সেই ছয় আঙ্গুলের নাপিত। নৌকা নিয়ে বিলের মধ্যে তারা কি মুক্তি বাহিনী খুঁজে বেড়াচ্ছে। নৌকা কাছে আসতেই ছয় আঙ্গুলের নাপিত বলল, “এই শালা মুক্তি হ্যায়। কলেজে পড়ায় আর ছাত্র খেপায়”। কথাটা বলেই নাপিত তার নৌকার উপর থেকে একটা রামদা হাতে তুলে নিলো। এরপর কেউ কিছু বোঝার আগেই সেটা চালিয়ে দিল সরলেন্দু বাবুর গলা লক্ষ করে। একটা ছোট্ট চিৎকার করেই আওয়াজটা থেমে গেল। মুণ্ড হীন ধড়টা কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পড়লো বিলের জলে। আর কাঁটা মাথাটা ফুটবলের মতো গড়িয়ে গেল ডুঙ্গি নৌকার খোলের ভিতর। হতবুদ্ধি হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে ছিল অমল। তারপর তার চোখ গেল পায়ের দিকে। তার বাবার কাঁটা মুণ্ডুটা তার পায়ের কাছে গড়াচ্ছে! এরপর মাথাটা ঘুরে সব কিছু অন্ধকার হয়ে গেল। আর কিছুই তার মনে নেই। 

জ্ঞান ফেরার পর বেশ কয়েকদিন ঘোরের মধ্যে কাটিয়েছিল অমল। চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যটা সে দেখতে পেতো আর চিৎকার করে উঠত। নবগঙ্গার পাড়ে জ্বালানো হয়েছিল সরলেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চিতা। সৎকার বলতে ঐ টুকুই। শান্তি স্বস্ত্যয়নের কথা কেউ আলোচনা করেন নি। তখন না ছিল সেই মনের অবস্থা আর না ছিল অর্থনৈতিক সামর্থ। এতদিন যিনি দক্ষতার সঙ্গে সবটা পরিচালনা করছিলেন; এই মৃত্যুতে সেই সুবিমল বাবুও প্রবল ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। আর যার ভেঙ্গে পড়াটাই স্বাভাবিক ছিল, তিনি রইলেন শক্ত হয়ে। অমলের মা, রমলা। সন্ধ্যেবেলা শ্মশান ঘাট থেকে ফিরে রমলা, সুবিমল বাবুকে বললেন, “আমি ভাইয়ের কাছে, কোলকাতায় চলে যাবো!”
বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন সুবিমল। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “তোমাকে বাধা দেওয়ার অধিকার আমার নেই। যাতি চাইলে যাও। মংলা কে বলতিছি সে যদি কিছুটা আগায় দিয়ে পারে!” কথা শেষ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন সুবিমল বাবু।

রাতের অন্ধকারে মংলা, মা আর ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। প্রথমে নদী পথে তারপর পায়ে হাঁটা। সকালে ঘুম ভেঙ্গে অমল দেখল হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে। সেই মানুষের ভিড়ে হাঁটছে তার মা। সে নিজে চলছে মংলা দা’র কোলে চড়ে। মায়ের চোখ থেকে একটানা জল গড়িয়ে পড়ছে। কোথায় চলেছে তারা? কে উত্তর দেবে এই প্রশ্নের! হাজার হাজার মানুষের মিছিল। মনে হচ্ছে যেন একদল ভিখারি চলেছে শেষ ভোজের আশায়। একটা জায়গায় এসে মংলাদা বলল, “আর কি যাওয়ার দরকার আছে?” এবার রমলা ছেলের হাত ধরলেন। মংলাদা গামছায় বাঁধা চিড়ের পুটলিটা অমলের হাতে দিয়ে পথের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লো। মানুষের মিছিল তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলো, যন্ত্রের মতো। বড় সড়কে জায়গায় জায়গায় মিলিটারি আর রাজাকারের পোস্টিং। তাই সবাই চলেছে গ্রামের ভিতর দিয়ে গঙ্গারামপুরের দিকে। সেখানে থেকে বোরোইতলা হয়ে ভারতের দিকে চলে যাবে এই জনস্রোত। কতজন ভারতে গিয়ে পৌঁছাবে কে জানে। ক্ষুধা তৃষ্ণা তো আছেই তার সঙ্গে আছে নারী মাংস লোভী রাজাকার বাহিনী আর পাকিস্তানি মিলিটারিদের ব্রাশ ফায়ার!

টেবিলের উপর ঝুঁকে খুব মন দিয়ে একটা সার্জারি জার্নাল পড়ছিলেন ডাক্তার অমলেন্দু মুখোপাধ্যায়। দেওয়ালে পুরনো আমলের একটা ঘড়ি টিক টিক করছে। তার পাশে ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের একটা বাঁধানো ছবি। মাথার উপর খুব ধীরে ধীরে ঘুরছে পুরনো আমলের ফ্যানটা। রোজ আউট ডোরের পরে নিয়ম করে তিনি কিছুক্ষণ পড়াশুনা করেন। তারপর বেরিয়ে যান রাউন্ডে। তিনিই বর্তমানে মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের প্রধান। আর কয়েকদিন পরেই অবসর নেবেন। ভর্তির সময় সত্যি বয়েস দেওয়া থাকলে কিছুদিন আগেই তার অবসর হয়ে যেতো। যদিও এই বিষয়টা তাকে সেভাবে ভাবায় না। একদিন নিঃস্ব হয়ে মায়ের হাত ধরে ওপার বাংলা থেকে ভারতে চলে এসেছিল ছোট্ট অমল। সেখান থেকে আজ এই পর্যন্ত যে আসতে পেরেছেন এটাই তার জীবনে বিরাট পাওয়া। যাকে বলা যেতে পারে, ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সুবিমল বাবু, মংলাদা বা গৌরাঙ্গদের কথা মাঝে মাঝে তার এখনো মনে পড়ে। তারা কে কোথায় কিভাবে আছে, কে জানে! কোলকাতায় আসার পর এতো বছরে তাদের সঙ্গে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। দেখতে দেখতে পঞ্চাশ বছর চলে গেল। প্রথম দিকে যোগাযোগ করার কথা মনেই হয়নি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়। কিন্তু এখন কি আর তারা সবাই বেঁচে আছেন! সেদিনের ছোট্ট অমল এখন বরিষ্ঠ চিকিৎসক। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199