বাংলা সাহিত্যের পঞ্চ কবিকে জানার সুযোগ ...

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 18 Sept 2025

2290 বার পড়া হয়েছে

Shoes
শাহরিয়ার আদনান শান্তনু
শাহরিয়ার আদনান শান্তনু 

বাংলা সাহিত্যে পঞ্চ কবির বিশাল অবদান। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের নাম জানা থাকলেও অন্য তিন কবিকে নিয়ে আলোচনা তেমনটা হয় না। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, আমরা কিন্তু কোন না কোন ভাবে অন্য তিনজনের রচনা পাঠ ও চর্চা করে আসছি নিজেদের অজান্তেই। এও এক মজার বিষয়।
বরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গী বাংলা সাহিত্যের দিকপাল এই পঞ্চ কবি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাদের জীবনচরিত, রচনা, স্মরণীয় ঘটনা তুলে ধরেছেন " নীলাম্বরি শাড়ি পরে " শীর্ষক বইতে। একই মলাটে পঞ্চ কবিকে নিয়ে এমন সমৃদ্ধ প্রকাশনা পাঠকদের জন্য আনন্দের এবং নতুন সংযোজন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ডি. এল. রায়, অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত - এই পাঁচজন আমাদের বাংলা সাহিত্যের গৌরব। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের বাইরে অন্য তিন কবির সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয় "নীলাম্বরি শাড়ি পরে " বইটি পাঠ করে।

এক.
"সত্য সেলুকাস!  কি বিচিত্র এই দেশ।"

আসলেই সত্যিই সেলুকাস। কি বিচিত্র এই দেশ! আর মানুষ! কোন এক অদ্ভুত কিংবা বিষয়ের উদাহরণ উল্লেখ করতে গেলে আমরা এই সংলাপটি আউরিয়ে থাকি। আচ্ছা, আপনারা কি জানেন,  এই লেখাটি কার? কেউ হয়তো জানবেন। আবার আমার মতো অনেকেই আছেন,  খানিকটা বিভ্রান্তিতে পরবেন। আমিও জানতাম না। ভেবেছিলাম কোন বিদেশি নাটকের সংলাপ হবে। নতুবা রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা হবে। ওমা - পরে জানলাম - এটি দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের

(ডি. এল. রায়) লেখা নাটক "চন্দ্রগুপ্ত" - এর তুমুল জনপ্রিয় সংলাপ।  অথচ আমাদের পড়ার সীমাবদ্ধতার কারণে, জ্ঞানচর্চা সীমিত হয়ে যাওয়ার কারণে এই তথ্যটি জানা হলো অনেক পরে। "সত্য সেলুকাস"। আবারও প্রমাণিত হলো।

ডি. এল. রায় বা দ্বিজেন্দ্র লাল রায় বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর এক ছেলে - নাম: দিলীপ কুমার রায়। দিলীপ কুমার রায়ও ছিলেন একজন সংগীতজ্ঞ। তো, বাবা-ছেলের কিছু আলাপ এই বইতে উল্লেখ করা হয়েছে। এবং তা পাঠ করে বেশ বিস্মিত হতে হয়। কেননা ১০০+ বছর  আগেও তাঁরা কতটা উদার ও সুন্দর মানসিকতার মানুষ ছিলেন।

" লন্ডনে থাকাকালীন  ডি.এল. রায়ের কি প্রেম হয়েছিলো এক বিদেশিনীর সঙ্গে। দিলীপ কুমারের স্মৃতিচারনা থেকে বাবা-ছেলের আলাপচারিতা -
-  "মেম বিয়ে করা কি খারাপ বাবা?"
- দ্বিজেন্দ্র লাল ( চিন্তিত): " জোর করে বলা যায় না। আমার জীবনে এক ইংরেজ মেয়ে এসেছিলেন। তাকে বিয়ে করিনি অনেক ভেবে। "
- " তাহলে তাকে ভালোবাসেননি বলুন"।
- ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তা নয়। তবে আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম বৈ কি! পরমা সুন্দরী। কিন্তু নিত্যগোপাল আমার খুব উপকার করেছিলো। সে ছিলো বিলাতে। আমার পরম বন্ধু বোঝালে আমাকে - অমন কর্ম কোরো না দ্বিজ, তেলে জলে মিশ খায় না। তাছাড়া ছেলেপিলে? "

পরে দিলীপ রায় লিখেছেন, কবি মেম বিবাহ সম্পর্কে এই কথাটা পরেই জোর দিতেন"।

শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী

ভাবা যায়, কতটা উদার ও সুন্দর মানসিকতার মানুষ হলে বাবা-ছেলে বিদেশিনী বিলেতি মেম বিষয়ে প্রেম না আসক্তি - এই বিষয়ে আলোচনা করে। বাপ-ছেলের এমন সুন্দর আলাপন আমায় ভাবিত করেছে। ১০০+ বছর পরেও যুগ আধুনিক হলেও মানসিকতা আধুনিক হয়েছে কী? প্রেম না আসক্তি - জানতে হবে শূন্য থেকে।

"আবার তোরা মানুষ হ " দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের বিখ্যাত একটি গান। ১০০+ বছর আগের এই গান আমাদের সমাজ বাস্তবতায় এখনো ভীষনভাবে প্রাসঙ্গিক।

" কীসের শোক করিস ভাই - আবার তোরা মানুষ হ।

গিয়েছে দেশ দুঃখ নাই - আবার তোরা মানুষ হ।

পরের 'পরে কেন এ রোষ, নিজেরাই যদি শত্রু হ'স?

তোদের এ যে নিজেরেই দোষ - আবার তোরা মানুষ হ। "

যতদিন যায়, ভাবিত ও শংকিত হই। ডি.এল. রায় মিছে লিখেননি। শত বছরেরও বেশি আগে তিনি কী ভেবে এই গান লিখে গেছেন - সত্যিই রহস্য। তাহলে কী তিনি ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা...! হতেই হবে। নাহলে এমন পরিস্থিতি নিয়ে লিখে যাবেন?


দুই.
তুমি নির্মল কর,  মঙ্গল করে

মলিন মর্ম মুছায়ে।

তব, পূণ্য - কিরণ দিয়ে যাক, মোর

মোছ - কালিমা ঘুচায়ে।"

অসাধারণ এই গানটি শুনলেই মনটি ভরে যায়। এই গানটির রচয়িতা রজনীকান্ত সেন নামক একজন কবির, তা অনেকেরই অজানা। রজনীকান্ত এমনই আরেক মেধাবী ও বহুমাত্রিক লেখক, যিনি বাংলা সাহিত্যে মূল্যবান অনেক রচনা লিখে গেছেন।

রজনীকান্ত সেনের জন্ম ২৬ জুলাই, ১৮৬৫। তৎকালীন পাবনা জেলার ( বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলা) বেলকুচি উপজেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামে।  রজনীকান্ত গান গাইতেন প্রাণভরে। যখন গাইতে বসতেন, গাইতেই থাকতেন। বিশ্রাম নেওয়া, খাওয়া - দাওয়ার কথা ভুলে যেতেন। তাঁর যে কোন গান শুনলেই মনে হয় - এ তো আমাদের পরিচিত গান। এ আমাদেরই গান। তিনি অল্পসময়ে গান লিখতে এবং সুর দিতে পারতেন। মাটির গন্ধ মেশানো কথা-সুরে নিজের জাত চিনিয়ে দিতে খুব একটা সময় নেননি। শ্রোতা-পাঠক রজনীকান্তকে বরণ করে নিলেন। বাংলা গানের ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারায় রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের পর রজনীকান্ত তার নিজস্ব ভঙ্গিতে অবদান রেখেছেন।  এবং সেই অবদান সর্ব মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে।


তিন.
বাংলা ভাষা নিয়ে বাঙালির গৌরব ও অহংকারের শেষ নাই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির জন্য

প্রাতঃস্মরণীয়।  " আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি " গানটি ছাড়াও আরেকটি গান সব অনুষ্ঠানে গাওয়া হয় - " মোদের গরব,  মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা"।  লেখা ও সুরের কারণে এই গানটি জনপ্রিয়। অদ্ভুত মায়াময় গান। দেশপ্রেম এবং বাংলা ভাষা - দুটোই গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেন কবি। আর এই কবির নাম: অতুল প্রসাদ সেন। তাঁর জন্ম ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর, ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে মাতুলালয়ে। ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদের গান সেই সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র লালের সঙ্গে দারুণ সখ্য ছিলো অতুল প্রসাদের। অতুল প্রসাদ স্মৃতি রোমন্থন করে দিলীপ কুমার রায়কে ( দ্বিজেন্দ্র লালের সন্তান)  বলছিলেন: সে কী কাণ্ড,  দিলীপ - জানো না তো!  "ডাকাতে ক্লাবে" তোমার বাবা, আমি, জগদিন্দ্রনাথ, রবিবাবু সবাই মিলে গান গল্প করতে করতে রাতকে রাত দিয়েছি কাবার করে। রবিবাবু পারতেন না রাত দুটার পর জাগতে। "

অতুল প্রসাদই প্রথম কিছু কিছু উর্দু শের-এর বাংলা অনুবাদ করেন। সংখ্যায় অল্প হলেও তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেছেন। লখনউ- এ থাকাকালীন সময়ে তিনি "মুসায়েরা"-য় যেতেন। মুসায়েরা হচ্ছে কবি সম্মেলন। যেখানে কবিগণ স্বরচিত গজল পাঠ করেন। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা। অতুল প্রসাদ মুসায়েরায় গিয়ে অনুপ্রাণিত হলেন। উর্দু আয়ত্ত করলেন এবং পরবর্তীতে লিখেছেন গজল। এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, তার মননশীল চিন্তায় গজলের ইতিবাচক প্রভাব ছিলো। পঞ্চকবির অন্য চার কবির মতোই, অতুলপ্রসাদের সৃষ্ট গানই ছিলো জনপ্রিয়। গানই অতুলপ্রসাদকে সারা বাংলায় পরিচিতি এনে দিয়েছে।


চার.
পঞ্চ কবির মধ্যে বিদ্রোহী কবি নামে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে কাজী নজরুল ইসলামের। নজরুলের প্রতিবাদী গান, গণসংগীত দাবী আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র সম্মেলন, যুব সম্মেলন, কৃষক সম্মেলন, শ্রমিক সম্মেলন,  মৎস্যজীবী সম্মেলনের জন্য কাজী নজরুল ইসলাম গান রচনা করেছেন। বিভিন্ন শ্রেণি - পেশার জন্য তিনি বক্তব্যধর্মী উদ্দীপনামূলক গান রচনা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে স্নেহ করতেন। তাঁর প্রতিভার ইতিবাচক মূল্যায়ন করতেন। ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর লেখা নাটক " বসন্ত " নজরুলকে উৎসর্গ করেন।

আবার যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন,  তখন কবি নজরুল কারাগারে বন্দী। সেখানেই তিনি এই খবর পেলেন এবং আনন্দে উদ্বেলিত হন। এরপর তিনি লিখেছেন :

" আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে

মোর মুখ হাসে,  মোর চোখ হাসে মোর

টগবগিয়ে খুন হাসে

আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। "

পঞ্চ  কবির মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামই এত বৈচিত্র্যময় ও বহুমাত্রিক গান লিখেছেন। তাঁর হামদ, নাত, ইসলামী গান যেমন গানের ভুবনে নতুন, তেমনি সফল সংযোজন। আবার নজরুলের লেখা শ্যামা সঙ্গীত, পরবর্তীতে আর কারোর পক্ষে করা সম্ভব হয়নি।


পাঁচ.
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য জগতে এক অপার বিস্ময়ের নাম। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই, যেখানে তিনি হাত দেননি। তাঁর সকল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে গানকেই এগিয়ে রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে "সালাম অস্ত-রবি" নামে একটি কবিতা রচনা করেছিলেন। যা পরবর্তীতে কোলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত নজরুল লিখেছেন :

" ঘুমাইতে দাও,  শান্ত রবিরে জাগায়োনা

সারা জীবন যে আলো দিল

ডেকে তার ঘুম

ভাঙায়োনা... "।

গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা পঞ্চ কবির নানান দিক নিয়ে লেখা " নীলাম্বরি শাড়ি পরে " বইটি সুখপাঠ্য। অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ করে দিয়েছে। এজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই শহীদ মাহমুদ জঙ্গীকে।


নীলাম্বরি শাড়ি পরে
শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
প্রকাশক : আজব প্রকাশ,  ঢাকা
প্রচ্ছদ : সারাজাত সৌম
মূল্য : চারশত টাকা     

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199