পঞ্চাশ বছর পরে (পর্ব ৩)

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 14 Sept 2023

8545 বার পড়া হয়েছে

Shoes
দীপারুণ ভট্টাচার্য

তিন.

প্রতি বুধবার ব্রাহ্মণডাঙ্গায় হাট বসে। আজ অনেকদিন পর সুবিমল বাবু এসেছেন। বাড়িতে কারো হাতে একটাও পয়সা নেই। নড়াইল থেকে পালিয়ে যখন এসেছিলেন তখনও হাতে তেমন পয়সা ছিল না। কলেজের মাইনেতো কয়েক মাস আগে থেকেই বন্ধ। ব্রাহ্মণডাঙ্গায় আসার পরেও কেটে গেছে আরও কয়েকটা মাস। মেয়েদের হাতে কানে গলায় এখন আর বিশেষ কিছুই নেই। একে একে সবই বিক্রি হয়ে গেছে পেটের জ্বালায়। আজ সুবিমল বাবু হাটে এসেছেন তার ছোট মেয়ের বালা নিয়ে। জিনিসটা দেখে ছিদাম মুদি বলল, “টাকা দেন কাকা, সোনা কেউ নিতি চায় না!” কথাটা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন সুবিমল। নির্মল আর সরল ও তার সঙ্গে ছিলেন। তাদেরও মাথা কাজ করছে না। হাটের মধ্যে এমন একটা গোলমাল শুনে কয়েকজন লোক এগিয়ে এলো। এরা সবাই মুসলমান। সুবিমল বাবুকে এখানে অনেকেই চেনে। ছোট বেলা থেকে এই ব্রাহ্মণডাঙ্গাতেই বড় হয়েছেন তিনি। ভিড়ের মধ্যে থেকে আসাদ মিয়া এগিয়ে এলো। সে ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপালের শালা। বিষয় শুনে বলল, “চিন্তা করবেন না কাকা, আমি ব্যবস্থা করতিছি। আপনারা বাড়ি যান”। খানিক পরে একটা নৌকা নিয়ে বাড়ি এলো আসাদ। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন মুসলমান লোক।

-“এই রফিক, আনোয়ার, মাল গুলা নামায় দে” বলতেই তারা একে একে মাল পত্র দাওয়ায় এসে নামিয়ে রাখল। ছোট এক বস্তা চাল, কয়েক সের আটা, লবণ, তেল, আলু আর কয়েকটা পাকা কুমড়ো। আসাদ বলল, “আপাতত, এইটুকই রাখেন। দেখি আরও কিছু জোগাড় করতি পারলি, পাঠাবোয়ানে।  আর কোন দরকার থাকলি বলবেন কাকা। লজ্জা করবেন না”।

-“এই বালাডা তুমি রাখো আসাদ” বললেন সুবিমল বাবু।

-“কি যে বলেন কাকা” আসাদ সুবিমল বাবুকে জড়িয়ে ধরল “আপনার বাবার পাঠশালায় আমরা সবাই পড়িছি কাকা। এই বালা আমি নিতি পারবো না”।

বাড়ির লোকেরা তাকিয়ে রইল উঠোনে আলিঙ্গনবদ্ধ এই মানুষ দুটোর দিকে। কেউ কি মনে রাখবে, যুদ্ধের কান্না সব সময়ে দুঃখের হয় না। সেদিন সামান্য ডাল ভাত সবাই এমন ভাবে খেলো, যেন বাড়িতে এক মহা ভোজ লেগেছে।

বিকেলে দুটো গরু আর দুটো বাছুর নিয়ে মংলা এসে উপস্থিত হল। তাকে দেখে সবাই হতবাক। মংলা কে কেউ চিন্তার মধ্যেই রাখেনি এই কয়েক মাস। তার থেকে নড়াইলের অনেক খবর পাওয়া গেল। জানা গেল ওয়াপদা অফিসে থাকা শোয়ার অসুবিধা বলে বালুচ কম্যান্ডার আরফাত খান বেশ কিছুদিন সুবিমল বাবুদের বাড়িতেই ছিলেন। মংলাই তার দেখাশোনা করতো। খান সাহেব দুধ খেতে ভালবাসেন বলে গরুদের আবার গোয়ালে ফিরিয়ে এনেছিল সে। রাতে দুইজন বন্দুকধারী পাহারাদার থাকতো বাড়িতে। তাই এই কদিন মংলার বিশেষ কিছু সমস্যা হয়নি। কিন্তু যুদ্ধের বাজারে ভালো বা খারাপ কোনটাই একটানা বেশি দিন চলে না। কাল রাতে মুক্তি বাহিনী যখন বাড়িতে চাড়াও হয় মংলা তখন ঢেঁকি ঘরে শুয়ে ছিল। মিলিটারি আর মুক্তি বাহিনীর মধ্যে শুরু হল গুলির লড়াই। কে বাঁচল কে মরল জানে না মংলা। গুলির শব্দ শুনেই কোন রকমে দুটো গরু আর বাছুর নিয়ে রাতের অন্ধকারে পেছনের মাঠের দিকে দৌড় দেয় সে। তারপর মাঠের মধ্যে দিয়ে গরু চরাবার ছদ্মবেশে কিছুটা হেঁটে বাকিটা সাঁতরে কোন ক্রমে এখানে চলে এসেছে। গরু গুলো ক্লান্ত হয়ে বার বার ডাকছে। বোঝা যাচ্ছে পথের ক্লান্তিতে তাদের শরীর নুয়ে পড়েছে।

মংলার সব কথা শুনে সুবিমল বাবু গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি মাথা নেড়ে বললেন, “তুই এখানে কেন এলি মংলা। এবার তো আমরা সবাই মারা পড়বো”। এই কথায় একেবারেই কান দিলেন না তার স্ত্রী। দুটো দুধেল গাই পেয়ে তিনি তখন বেজায় খুশি। গরু দুটোর গলায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “বাচ্চা গুলো এবার একটু দুধ পাবে”।

সন্ধের পর গানবোট থেকে আবার শুরু হল নিয়ম মাফিক গুলির বৃষ্টি। এখন আর কেরোসিন নেই। তাই বাড়িতে সন্ধের পর আর আলো জ্বলে না। কাঠ কুটো দিয়ে উঠোনে জ্বালানো হয় উনুন। সেই আগুনেই যতটুকু যা দেখা যায়। বাকি সব কাজই হয় অন্ধকার ঘেঁটে ঘেঁটে। গুলির শব্দ শুনেই জেঠিমা উনুনে জল ঢেলে দিলেন। তারপর কলের পুতুলের মতো সবাই নৌকা আর ভেলা নিয়ে ছুটে গেল বিলের মধ্যে। এখন বিলের জল কমে এসেছে। কার্ত্তিক মাসের ঠাণ্ডা বাতাসে শীত করে। গরম কাপড় নেই কারো কাছে। ছিঁড়ে যাওয়া বিছানার চাদর সেলাই করে মহিলারা সায়া বানিয়েছেন। সেই পরেই থাকতে হচ্ছে তাদের। সবার শাড়ি এখন শত ছিন্ন। চালের বস্তা কেটে পুরুষদের লুঙ্গি আর ছোটদের হাফ প্যান্ট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েক মাস আগে যাদের সব ছিল, এখন খাদ্যের সঙ্গে লজ্জা নিবারণও তাদের বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুলির শব্দ আজ বড় বেশিই শোনা যাচ্ছে। গরু বাছুর গুলো চিৎকার করছে প্রাণপণে। নড়াইলে কি এরা গুলির শব্দ শোনেনি! মানুষের মতো মানিয়ে নিতে শেখেনি অন্য পশুপাখিরা।

গুলির শব্দ থেমে যেতেই ঘরে ফিরল সবাই। সুবিমল বাবু আর মংলা গেল গোয়ালে। তারপরেই একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল। নির্মল কাকার টর্চের হলদেটে পাংশু আলোতে দেখা গেল দৃশ্যটা। গোয়াল ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। একটা বাছুরের গায়ে গুলি লেগেছে। সে লুটিয়ে পড়েছে তার মায়ের পাশে। মা গাভীটি জিভ দিয়ে চাটছে আপন শিশুর শরীর। মায়ের জিভে লেগে আছে শিশুর রক্ত। মংলা তাড়াতাড়ি বাছুরের মৃতদেহটা নিয়ে নদীর দিকে চলে গেল। পাগলের মতো ডাকছে গরু দুটো। বাড়ির মেয়েদের মধ্যেও একটা কান্নার রোল উঠলো। তারা তখনো জানে না এই যুদ্ধের আর কি কি ছবি তাদের দেখতে হবে। সুবিমল বাবু প্রায় সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। হতাশ গলায় বার বার বলতে লাগলেন, “ব্রাহ্মণ বাড়িতে গরু মরলি সর্বনাশ হয়”।

পরদিন সকালে হঠাৎ করে বাড়িতে কিছু লোকের আগমন হল। এরা সবাই অপরিচিত মুসলমান মানুষ। দলের একজন ছেলেকে বাড়ির লোকেরা চিনতে পারলো। ছেলেটা নাপিত। বাজারের চালা ঘরে সে সেলুন চালায়। অমলও চিনতে পারলো তাকে। কিছুদিন আগে এই নাপিতই তার চুল কেটে দিয়েছে। নাপিতের দুটো হাতেই ছয়টা করে আঙ্গুল। বাজারে সবাই তাকে বলে ছয় আঙ্গুলের নাপিত। মনে হচ্ছে দলটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে ঐ ছয় আঙ্গুলের নাপিত। লোক গুলো খুব বাজে ভাবে কথা বলছে। অমল কথার মানে বুঝতে পারছে না ঠিকই তবে, তার খুব ভয় করছে। বাড়িতে এসে এমন রূঢ় ভাবে কাউকে কথা বলতে সে কোনদিন দেখেনি। লোক গুলোর হাব ভাবও ভালো না। কাকে যেন খুঁজছে দলটা। সুবিমল বাবু বার বার বলছেন, “দেখেন আমাদের মধ্যে কেউ মুক্তি নাই!” কথাটা শুনে ফেস টুপি পরা এক লোক বলল, “আছে কি নাই সে আমরা নিজেরাই খুঁজে নেবো। সব খবর আমাদের কাছে আছে।” কথাটা বলতেই ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল দুইজন। লোকটা উঠোনে দাঁড়িয়ে বলল, “হিন্দুর বাড়ি ভালো করে খোঁজো। দুই একটা মেশিন গান পাইলেও আশ্চর্যের কিছু নাই। সব শালা ইন্ডিয়ার দালাল। পাকিস্তানে কথাটা বলার সময় সুবিমল বাবুর ছেঁড়া পাঞ্জাবীর কলার চেপে ধরে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ সব কিছু তছনছ করে চলে গেল দলটা। অমলের বাবা আর নির্মল কাকা তখন বাজারে গিয়েছিলেন। রোজ একটা গরুর দুধ তারা বিক্রি করেন। আর তাই দিয়ে যেটুকু চাল সবজি পাওয়া যায় কিনে নিয়ে আসেন। (চলবে)

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199