হিমালয় ও গঙ্গা

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 7 Feb 2019

2860 বার পড়া হয়েছে

Shoes
এস এম এমদাদুল ইসলাম

রাস্কিন বন্ড ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ভারতীয় লেখক।বন্ডের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়ী স্টেশনে।   তাঁর প্রথম উপন্যাস “দ্য রুম অন দ্য রুফ” তিনি লিখেছিলেন ১৭ বছর বয়সে এবং এটি প্রকাশিত হয়েছিল যখন তার বয়স ২১ বছর তিনি তার পরিবার নিয়ে ভারতের মুসৌরিতে থাকেন। Our Trees Still Grow in Dehra লেখার জন্য ১৯৯২ সালে তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পান। তিনি ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০১৪ সালে পদ্মভূষণ পুরষ্কারে ভূষিত হন। তিরিশটির বেশি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। লিখেছেন প্রচুর নিবন্ধও।

রাস্কিন বন্ডের উপন্যাস ‘অল রোডস লিড টু গঙ্গা’ একটি আলোচিত উপন্যাস। প্রাণের বাংলায় এই উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ করেছেন পেশায় ব্যবসায়ী এস এম এমদাদুল ইসলাম। ‘হিমালয় ও গঙ্গা’ নামে উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ এখন থেকে প্রকাশিত হবে প্রাণের বাংলায়।

পাহাড়ি লেখক

বিশ্বাস হতে চায়না যে এতগুলো বছর কেটে গেছে এখানে- চল্লিশটা গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত ও হিমালয়ী বসন্ত- মনে হয় যেন এইতো সেদিন এলাম। 
এই অনুভূতিতেই যেন সবটুকু প্রকাশ হয়ে যায়। কাল অতিক্রান্ত হয়, আবার হয়ও না (সময় ঠিকই থাকে শুধু আপনি আর আমি সময়ের দৃশ্যপট থেকে সরে যাই)। মানুষ আসে এবং চলে যায়, কিন্তু পাহাড়-পর্বত রয়ে যায়। এরা চিরস্থায়ী, অনড়-গ্যাঁট হয়ে পড়ে থাকে। বোমা ফাটিয়ে এদের শরীর গুঁড়িয়ে আপনি খনিজ বার করতে পারবেন; ওদের গা থেকে গাছপালা কেটে সাফ করতে পারবেন; পাহাড়ি নদীতে বাঁধ দিতে পারবেন, বা সেই নদীর গতিপথ বদলে দিতে পারবেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের অস্তিত্ব মুছে দিতে পারবেনা মানুষ। আর এই বিষয়টাই আমার ভালো লাগে- এদের জন্ম টিকে থাকার জন্য।
পর্বতমালার এই বিশেষ অংশটির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে আছি আমি-এরকম ভাবতে ভালো লাগে আমার। এতগুলো বছর আছি এখানে, এতে করে এই গাছপালা, বুনো ফুল, এমনকি মস্ত পাথরগুলো যা এই পাহাড়ের অবিচ্ছেদ্য-এসবের উপর যেন আমার একরকম অধিকার জন্মে গেছে। গতকাল গোধুলিবেলায় ওক্ গাছের সারির ভেতরদিয়ে যাবার সময় মনে হয়েছে আমি এই বনেরই একজন। চলতে গিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা ওক্-কাণ্ডের বাকলে হাত রেখেছি, পরে ঘুরে দাঁড়াতেই ওক্-পত্র আমার গাল ছুঁয়ে দিয়েছে মমতায়, আমাকে চিনতে পেরে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমরা যদি এমন করে গাছ কেটে বনের পর বন উজার করতে থাকি তো একদিন বোধ হয় বনের গাছগুলো আর বসে থাকবেনা; ওরা নিজেরাই নিজেদের মূল-উৎপাটন করে মিছিল করে চলে যাবে পরের, বা তারও পরের কোনো দূর পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রয়ে, একেবারে মানুষের সীমানার বাইরে। বহুবছরের সাক্ষী আমি, কীভাবে গাছ কেটে বনের পর বন উজাড় করে দেয়া হয়েছে।
ইদানিং বেশ হৈচৈ গাছ কাটা নিয়ে। হঠাৎ পরিবেশবান্ধব হবার একটা চল শুরু হয়েছে। ভালোই। প্রকৃতি ও পরিবেশের যেটুকু বাকি আছে সেটুকু রক্ষার সময় হয়তো শেষ হয়ে যায়নি। পরিবেশবাদীরা নতুন আবাসন উদ্দোক্তাদেরকে নিরুদ্যমকরণের মাধ্যমে কাজটা শুরু করতে পারেন। প্রপারটি ডেভেলপারদের লম্বা হাত অনেক দূর পৌঁছায়।
সমুদ্র নিয়ে লেখালেখি হয়েছে বিস্তর। ক’জন বিখ্যাত লেখকের নাম করতে পারি- কনরাড্, মেলভিল, স্টিভেনসন, মেসফিল্ড-কিন্তু পাহাড়-পর্বতকে বিষয় করে উল্লেখযোগ্য কোনো লেখা এবং তার ধারাবাহিকতা আমার চোখে পড়েনি। এসব খুঁজতে প্রাচীন চিনের তাওবাদী কবিদের কাছে যেতে হবে। পাহাড় নিয়ে কিপলিঙের কিছু লেখা আছে, কিন্তু হিমালয় হাল-জমানার কোনো ভারতীয় লেখকের বিশেষ দৃষ্টি কেড়েছে একথা বলা কঠিন।
আমার অনুমান, লেখকদের রুটি রোজগারের জন্য সমতলে থাকাটা জরুরি। পাহাড়িদেরকে জীবিকার জন্য ঘাম ঝরাতে হয় পাথুরে মাটি চষে ফসল ফলাতে। পর্বতারোহীরা পাহাড়ে বসতি গড়তে আসেন না; তারা একটা চূড়া জয় করে আরেকটার উদ্দেশে অভিযান অব্যহত রাখেন।
আমার ব্যাপারটা একটু আলাদা, লেখক হিসেবে পাহাড়-পর্বত আমার প্রতি সবসময় সদয় থেকেছে। শুরু থেকেই এদের দয়া-দাক্ষিণ্য পেয়েছি-সেই যখন দিল্লির চাকরি ছেড়ে এসে হিল-স্টেশনের ধারে ছোট্ট একটা কুটির ভাড়া নিয়েছিলাম তখন থেকেই। আজকাল হিল-স্টেশনগুলোর আশেপাশে পয়সাওয়ালাদের বসবাস, কিন্তু পঁচিশ বছর আগে এসব জায়গায় সীমিত সামর্থের মানুষজন সস্তায় জীবনযাপন করতে পারতো। মোটরগাড়ি কমই ছিলো তখন- হাঁটার অভ্যাস ছিলো সবার।
ওক্ আর ম্যাপল্ বনের ধারে আমার কুটিরটি, যেখানে আট থেকে ন’টি বছর আমি কাটিয়েছি-গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও বাচ্চাদের জন্য লিখে। পাহাড়ে বসবাস করতে আসার পরই কেবল বাচ্চাদের জন্য লিখতে শুরু করেছি- কেটেছে একটা সুন্দর সময়।
প্রেম-এর বাচ্চাদের একটা ভূমিকা এখানে মূখ্য-আমার ধারণা। প্রেম সিং বালক বয়সে চলে এসেছিলো পাওরি গাড়োয়ালের রুদ্রপ্রয়াগের কাছে তার গ্রাম থেকে। ও অঞ্চলে আর সব বাচ্চাদের চাইতে প্রেম ছিলো দীর্ঘকায় এবং তার গায়ের রং ছিলো অন্যদের থেকে বেশ কালো। সে আমলে যদিও গ্রামের স্কুলগুলো প্রাথমিক স্তরের উপরে যেতোনা, তথাপি এই ছেলেটির লেখাপড়ার আগ্রহ ছিলো বেজায় এবং তার অঙ্কের মাথাটিও ছিলো ভালো।
আমার সঙ্গে বছরদুয়েক থাকার পর বাড়ি গেলো সে বিয়ে করতে, পরে বউ চন্দ্রাকে নিয়ে ফিরে এলো। তারপর থেকে ঘরের পুরো দায়িত্ব গিয়ে পড়লো ওদের দু’জনের উপর। বিদ্যুতের ফিউজ কেটে গেলে, বাথরুমের পানির লাইনে ময়লা ঢুকে বন্ধ হয়ে গেলে, গ্যাসের সিলিন্ডারে লিক হলে, পানির পাইপ ফেটে গেলে, ঝড়ে টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে গেলে বা অন্য যেকোনো খুচরো কাজে আমি আমার হিল-স্টেশনের আস্তানায় ওদেরকে ছাড়া অসহায়। ঘুরিয়ে বললে ওরা একজন লেখকের জন্য তার লেখার কাজটাকে সম্ভব করেছিলো।
অসুস্থ হলে সেবাটাও ওদের কাছ থেকেই পেতাম, এতে মনে হতো আমার একটা সংসার এখানে হয়েছে; এ এমন এক অনুভূতি যা ছেলেবেলা থেকে আমি পাইনি।
ওদের ছেলেমেয়েরা, রাকেশ, মুকেশ ও সাবিত্রী মেপলউড কটেজে ও পরে আরো অন্যান্য যেসব বাড়িতে আমরা থেকেছি সেখানে থেকে বড়ো হয়েছে। ছেলেমেয়েদের কাছে আমি ছিলাম তাদের পিতামহের মতো। রাকেশের জন্য আমি একটা গল্প লিখেছিলাম- সেটা ছিলো একটা চেরির চারা নিয়ে, যেটি স্বাভাবিক গতিতে বাড়ছিলোনা। (রাকেশ ছিল রোগা-পটকা একটা বাচ্চা)। মুকেশ ছিলো দুরন্ত, সব এলোমেলো করে দেয়া ছিলো তার স্বভাব। ওর জন্য লিখেছিলাম ভূমিকম্পের গল্প, সেই গল্পের নায়ক সে। আর সাবিত্রীর জন্য লিখেছিলাম একগুচ্ছ ছড়া ও কবিতা।
এটা এমন একটা জায়গা যেখানে গল্পের উপাদানের কোনো শেষ নেই। পাহাড়ের পায়ের কাছে একটা ছোটো নদী বয়ে গিয়েছে। সেখানে পানি খেতে আসে ছোটো ছোটো (কখনো বড়োও) নানান রকম প্রাণী; পারে ফোঁটে বুনো ফুল, জন্মায় লতা, ফার্ন; রয়েছে গাছের সারি, পাখি, পোকা, কত কী। নিকটবর্তী গ্রামগুলোতে কত মজাদার বিষয়ই না রয়েছে। মুসৌরি হিল-স্টেশন ও লান্ডুরে যে পুরনো বসতি তাতেও রয়েছে কত কিচ্ছা। পাহাড়ের রাস্তায়, কখনো তীর্থ-যাত্রীদের পথ ধরে হেঁটেছি অনেক, ঘুমিয়েছি পথের পাশের চায়ের দোকানের ছাপড়ায় বা গাঁয়ের পাঠশালায়। দুঃখের কথা এসব গাঁয়ে স্কুল বা চিকিৎসা-সুবিধা প্রায় অনুপস্থিত, যা অন্যত্র পাওয়া যায়।
‘পাহাড়ে যাওয়া যেন মায়ের কাছেই যাওয়া।’ কিপলিং এইরকম লিখেছিলেন তাঁর একটা বইতে। এর চেয়ে খাঁটি কথা তিনি আর কখনো লিখেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। বাস্তবিকই, পাহাড়ে বসবাস মায়ের কোলের উষ্ণতার মধ্যে বসবাসের মতই। যতবার ফিরে এসেছি এখানে ততবারই যেন আগেরবারের চাইতে আরো আদরের, আরো প্রিয় মনে হয়েছে জায়গাটিকে। দিনে দিনে এই পাহাড়ি বন্ধনটা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে আমার। রক্তে একবার পাহাড় ঢুকে পড়েছে তো এর থেকে আর মুক্তি নেই আপনার।
এতকিছু ভালোর বিপরীতে অন্য আর কিছু যে নেই তা অবশ্য নয়। রাকেশ, মুকেশের মাঝখানে জন্ম নেয়া সুরেশ মারা গেল ধনুষ্টঙ্কারে মাত্র দুবছর বয়সে। আমি নিজেও দারুণ অসুখে ভুগেছি বেশ ক’বার। টাকা-পয়সার অভাবে পড়েছি। স্বাধীনভাবে লিখে পেট চালানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে মাঝে-মধ্যেই। আমার পরিচিত আনেক লেখকের মতো একটা বাড়ি কেনার পয়সা আমার কখনোই হয়নি।
কখনো কোনো সম্পাদক আমার জন্য তার দরজা বন্ধ করেছেন তো তখন আবার অলৌকিকভাবে অন্য আরেকটি দরজা খুলে গেছে। হয়তো লন্ডন, বা হংকং, বা এমনকি বোম্বেতে থাকলেও এরচেয়ে ভালো জীবিকা হতো আমার। তবে সুযোগ এলেও আমার পক্ষে বোধহয় সেটা গ্রহণ করা সম্ভব হতোনা। মানুষের যে ভালোবাসা এখানে পাওয়া যায়, পাহাড় যে স্বাধীনতা আপনাকে নিশ্চিত করে তাতে তো আপনি স্বর্গের খুব কাছাকাছি অবস্থান করেন।
আজকে রাকেশ আর বীণার সুন্দর তিনটি বাচ্চা, আর ওদিকে মুকেশ আর বিনীতার দুইটি বিচ্ছু। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199