গাছের সঙ্গে বেড়ে ওঠা

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 1 Mar 2019

3050 বার পড়া হয়েছে

Shoes
এস এম এমদাদুল ইসলাম

রাস্কিন বন্ড ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ভারতীয় লেখক।বন্ডের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হিমালয়ের পাদদেশে পাহাড়ী ষ্টেশনে। তাঁর প্রথম উপন্যাস “দ্য রুম অন দ্য রুফ” তিনি লিখেছিলেন ১৭ বছরবয়সে এবং এটি প্রকাশিত হয়েছিলো যখন তার বয়স ২১ বছর। তিনি তার পরিবার নিয়ে ভারতের মুসৌরিতে থাকেন। Our Trees Still Grow in Dehra লেখার জন্য ১৯৯২ সালে তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরষ্কার পান। ১৯৯৯ সালে পদ্মশ্রী এবং ২০১৪ সালে পদ্মভূষণ পুরষ্কারে ভূষিত হন। তিরিশটির বেশি উপন্যাস লিখেছেন তিনি। লিখেছেন প্রচুর নিবন্ধও। রাস্কিন বন্ডের উপন্যাস ‘অল রোডস লিড টু গঙ্গা’ একটি আলোচিত উপন্যাস। প্রাণের বাংলায় এই উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ করেছেন  এস এম এমদাদুল ইসলাম। ‘হিমালয় ও গঙ্গা’ নামে উপন্যাসের ধারাবাহিক অনুবাদ এখন থেকে প্রকাশিত হবে প্রাণের বাংলায়।

বৃক্ষবান্ধব জায়গা দেরাদুন, আমার পিতামহের বাড়ির চারপাশে গাছের অভাব নেই, পিপুল, নিম, আম, কাঠাল, পেঁপে, কত কী। একটা প্রাচীন বটগাছও ছিলো। এসব গাছের সঙ্গে আমি বেড়ে উঠেছি, আবার বেশ কিছু গাছ আমার সঙ্গেই বড়ো হয়েছে, যার অনেকগুলোই পিতামহের লাগানো।
দু’ধরনের গাছে বাচ্চাদের আনন্দ বেশি, যে গাছে চড়তে সুবিধা, আর যে গাছে খাবার যোগ্য ফল ধরে।
কাঁঠালগাছে এই দুই সুবিধাই রয়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম ফল কাঁঠাল ধরে শুধু গাছের গুঁড়িতে আর বড়ো বড়ো শাখায়। এই ফলে আমার তেমন আকর্ষণ নেই, যদিও কাঁচা কাঁঠালে সুস্বাদু তরকারি রান্না হয়। কিন্তু এই ঘনপত্রশোভিত মজবুত বৃক্ষটি সহজে আরোহণযোগ্য। ঘন ও গাঢ় পাতার কারণে গাছটি প্রায় আঁধারে ঢাকা থাকে, ফলে গাছে চড়ে নিজেকে অন্যের দৃষ্টির আড়াল করে ফেলা খুব সহজ। ওই গাছের কাণ্ডের একটা গর্তে অনেক নিষিদ্ধ জিনিস রেখেছিলাম- গুলতি, কিছু কমিক বই, একগাদা চ্যুইংগাম, ইত্যাদি। আমার মনে হয় ওগুলো আজো আছে সেখানে, কারণ আমরা ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় জিনিসগুলো সরাতে ভুলে গিয়েছিলাম।
বটগাছটা ছিল বাড়ির পিছনদিকটায়। ছড়ানো শাখা-প্রশাখা থেকে ঝুরি নেমে এসে মাটিতে আবার শিকড় গজিয়েছিলো। এইসব ঝুরি অনেকগুলো প্যাঁচানো সুরঙ্গ মতো তৈরি করেছিলো, যার ভেতর দিয়ে যাওয়া-আসা করার মতো মজা আর কিছুতে পাইনি।বটগাছটি আমাদের বাড়ি থেকে পুরনো ছিলো, এমনকি আমার পিতামহের চাইতেও বয়স্ক ছিলো। দেরা যতটা পুরনো বটগাছটিও তাই। এই গাছে চড়ে নিজেকে ঘন পাতার আড়াল করে নিচের জগতের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে পারতাম আমি। গাছে চড়ে এর গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ট্রেজার আইল্যান্ড, জাঙ্গল বুক ও নানান কমিকের (উইজার্ড, হটস্পার) বই পড়ার জায়গাও ছিলো গাছটি।
বটগাছটি স্বয়ং একটা জগৎ ছিলো। ছোটো ছোটো প্রাণী, বড়ো পোকা- এসবের বসবাস ছিলো সেখানে। বসন্তে কচি গোলাপি পাতায় ছাওয়া অবস্থায় নানান নক্সাদার প্রজাপতি উড়ে এসে বসতো, ডিম পাড়তো। কচিপাতা নিঃসরিত একধরনের মধুস্বাদের প্রলেপ ডোরাকাটা কাঠবিড়ালিদের আকৃষ্ট করতো। একসময় এরা আমার উপস্থিতিকে আর ভয় পেতো না। খুব ভোরে লালঝুঁটি কাকাতুয়ার ঝাঁক উড়তো বটগাছের উপরে।
তবে বটগাছটি পূর্ণজীবন পেত বর্ষার সময়। সে সময় শাখায় শাখায় ভারী হয়ে ঝুলতো ডুমুরের মতো লাল রঙের থোকা থোকা ফল। এগুলো অবশ্য মানুষের খাবার উপযুক্ত নয়, তবে কাঠশালিক, ময়না, বুলবুলি, বসন্তবউরি, কাক সহ বিভিন্ন জাতের পাখির জন্য এ ছিলো এক মহা ভোজের সরব আয়োজন। রাত নেমে এলে পাখিরা বিশ্রামে যেতো, কিন্তু মাথার উপর চক্কর দিতে দিতে আসতো শেয়ালমুখো বাদুরেরা। ডালে ডালে ঝুলে থেকে এদের ফল চিবানোর আওয়াজ শোনা যেতো।
বট-কাঁঠালের গাছে নৈশ অতিথির ভিতর ছিলো বাজ-কোকিল, মগজ ঠোকড়ানো ডাক এদের। একটানা বিরক্তিকর ‘কোপ কোপ’ ডাক গ্রীষ্মের গভীর রাতের ঘুমও হারাম করে দিত।
ব্রিটিশরা এই পাখির নাম দিয়েছে ‘ব্রেইন ফিভার’। ওদেরকে মারাঠিরা বলে ‘পাওস-আলা’, মানে হলো ‘বৃষ্টি আসছে’। তবে আমার পিতামহের দেয়া এই ডাকের ব্যাখ্যা আমার সবচেয়ে পছন্দের ছিলো। তাঁর মতে বাজ-কোকিল ডেকে বলে: ও প্রিয়, ও প্রিয়! কী গরম, কী গরম! গরম লাগছে, গরম লাগছে!
বর্ষর সময় বটগাছটা কলরবমুখর হয়ে ওঠতো এটা সত্যি। নিশি-সংগীতের শিল্পী যদি ছিলো বাজ-কোকিল বা ব্রেইন ফিভার পাখি, তো দিনটা মাতিয়ে রাখতো নানা জাতের ঝিঁঝি পোকারা তাদের ঐকতানের মাধ্যমে। সংগীতকার হিসেবে ঝিঁঝিদের অবস্থান ধ্রুপদি। গরমের পুরোটা সময় বাগান ভেদ করে তাদের সমবেত বাদন শ্রুত হতো। হঠাৎ বারিপাত তাদের উৎসাহ দমানোর পরিবর্তে তা আরো চাগিয়ে দিত। গেছো ঝিঁঝিরা দিনের যে কোনো সময় তাদের যন্ত্রসঙ্গীত সূচনায় অভ্যস্ত, তবে সন্ধ্যায় এরা বেশি মাত্রায় সরব হতো। স্বচ্ছ পাখাযুক্ত চাপা-সবুজ রঙের সংবেদনশীল পতঙ্গগুলো বর্ষাকালের সবুজ পরিবেশে প্রায় অদৃশ্য থাকতো; তবে একবার কোনোটাকে দেখা গেলে কাছাকাছি টোকা দিলেই সঙ্গেসঙ্গে তার বাজনা বন্ধ হয়ে যেতো। বর্ষ যখন তুঙ্গে তখন বটগাছটি যতরাজ্যের সঙ্গীত শিল্পীদের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হতো। পাখি, কীটপতঙ্গ, কাঠবিড়ালি গ্রীষ্মের শেষটায় হঠাৎ বর্ষণের স্বস্তিতে প্রাণচাঞ্চল্যে উছলে উঠতো।
কখনো আমি আমার বাঁশিতে সুর তোলার চেষ্টা করতাম, শরিক হতে চাইতাম ওদের ঐকতানের সঙ্গে। কিন্তু আমার বাদন ওদের পছন্দ হতো না বুঝতে পারতাম, কারণ আমি বাজানো শুরু করা মাত্র ওদের সঙ্গীত স্তব্ধ হয়ে যেতো। (চলবে)

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199