রাজনৈতিক ফুটবল

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 4 Jan 2023

2755 বার পড়া হয়েছে

Shoes

দেশে চলা হিজাব আন্দোলনের সমর্থনে ইরানের খেলোয়াড়দের জাতীয় সঙ্গীত না-গাওয়া কিংবা ফিফার বিরুদ্ধে জার্মানদের মুখে হাত দিয়ে প্রতিবাদ— বিশ্বকাপ ফুটবলের মাঠে রাজনীতির ঘোড়ার পা ঠোকার আওয়াজ শোনা গেলো এবার বেশ জোরেসোরেই।রাউন্ড অফ ১৬-এর খেলায় অস্ট্রেলিয়া-আর্জেন্টিনার ম্যাচে লিওনেল মেসির হাতে ছিলো ‘এডুকেশন ফর অল’ আর্মব্যান্ড। তা নিয়ে পত্রিকায় লেখালিখিও হয়েছে। ফুটবলাররা এখন কাশি দিলেও সেটা প্রবল সংবাদ হয়ে ওঠে।ফুটবলের মাঠে এই যে অন্য ভাবে কিছু বলতে চাওয়ার বিষয়টা তাই ভালোই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সবার। যেরকম সার্বিয়া আর সুইজারল্যান্ডের ম্যাচের দিন গ্যালারীতে সর্বিয়ার সমর্থকদের ফ্যাসিস্ট শ্লোগান হাঁকা আর পতাকা দেখানোর ব্যাপারটাও কারো দৃষ্টি এড়ায়নি।

পৃথিবীর রাজনীতির মাঠ এখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় ব্যস্ত। দেশে দেশে অর্থনীতির রাজনীতি নিয়েও চলছে নানান খেলা। ফুটবলের মাঠ তো তার বাইরে নয়। তবে ফুটবল খেলা দিয়েও যে প্রতিবাদ গড়ে তোলা যায়, বার্তা পাঠানো যায় ক্ষমতাসীনদের কাছে তা সর্বপ্রথম প্রমাণ করেছিলেন  ব্রাজিলের ফুটবল তারকা সক্রেটিস। নিজের দেশে মৃত্যুর পরেও তিনি ডক্টর সক্রেটিস নামেই পরিচিত এখনও।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে ফুটবলের মাঠে সক্রেটিসের রাজনৈতিক চেতনার কাহিনি নিয়ে রইলো’। ‘রাজনৈতিক ফুটবল’

ফুটবল খেলেছেন, উপার্জনও করেছেন প্রচুর, তবে ফুটবল ছিলো তাঁর কাছে প্রতিবাদের মঞ্চ। ফুটবল আদ্যন্ত একটি রাজনৈতিক খেলা বলেই বিশ্বাস ছিলো এই ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি ফুটবলারের। ‘ইয়েস টু লাভ, নো টু টেরর’। ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপের মঞ্চে এমন বার্তা লেখা হেয়ারব্যান্ড পরেই মাঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন ঝাঁকড়া চুলের ব্রাজিলিয়ান তারকা। তখন সদ্য লিবিয়াতে বোমাবর্ষণ করেছে আমেরিকা। প্রাণ হারিয়েছে অজস্র মানুষ। আমেরিকার এই ক্রুর আচরণে যখন মুখ বন্ধ করেছিলেন গোটা বিশ্বের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, সেখানে খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন একজন ফুটবলার— এমনটা আশা করেননি কেউ-ই।     

সাংবাদিকরা ম্যাচের পরে তারে কাছে সেই ব্যান্ড বার্তার রহস্য জানতে চাইলে সক্রেটিস মৃদু হেসে উল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুযোগ পেলে তো তার সদ্বব্যবহার করাই উচিত, কী বলেন? সেই ম্যাচে সক্রেটিসের নেতৃত্বে ব্রাজিল দল উত্তর আয়ারল্যান্ডের ‍বিরুদ্ধে ৩-০গোলে জয় তুলে নেয়।

মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের সঙ্গে ছোটবেলা থেকেই দেখেছিলেন তিনি।  তাই তার লড়াইয়ের ভোটটা বরাবরই ছিলো শ্রমজীবীদের স্বপক্ষে। পেলে বা অন্য কোনো ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নন, বরং সক্রেটিসের জীবনে আলোকস্তম্ভ হয়ে উঠেছিলেন ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, জন লেননের মতো মানুষেরা। ১৯৬৪ সাল। ব্রাজিলের রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গিয়েছিলো সামরিক রাষ্ট্রনেতার হাতে। তারপরই দেশটাতে শুরু হয়েছিলো এক অন্ধকার অধ্যায়ের পৃষ্ঠা উল্টানো। সেই স্বৈরশাসকরা নিষ্দ্ধি ঘোষণা করেছিলো প্রতিবাদী লেখকদের লেখা বই।মানুষের কাছে উদার চিন্তাধারা পৌঁছে দেয়ার অপরাধে সে-সব বই জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ব্রাজিলের রাজপথে। সে-সময় বাড়িতে থাকা কিছু নিষিদ্ধ বই জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে বাবাকে কাঁদতে দেখে জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো কিশোর সক্রেটিসের মনে। মাথার ভিতরে গণতন্ত্রের স্বপ্ন জায়গা করে নিয়েছিলো।  

বড় হয়ে সেই রাজনৈতিক লড়াইয়ে তাঁর অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ফুটবল। একদিকে যেমন চিকিৎসাবিজ্ঞানের পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন সক্রেটিস, গাইনোকোলজিস্ট ও অর্থোপেডিক্স হিসাবে কাজ করেছেন বিভিন্ন হাসপাতালে, তেমনই সমান তালে ফুটবল খেলেছেন বোতাফোগো, ফোরেন্তিতা, কোরেন্থিয়ান্সের মতো প্রথম সারির ব্রাজিলীয় ফুটবল ক্লাবে। সেই সময়  জাতীয় ফুটবল দলে জায়গা পান সক্রেটিস। বছর দু‘বছরের মাথায় দায়িত্ব পান বিশ্বকাপে দেশের নেতৃত্ব দেয়ার।

সক্রেটিসের খেলোয়াড় জীবন কিন্তু শুধু গোল সংখ্যা বা কাপ বিজয়ের খতিয়ানে সাজানো ছিলো না। ১৯৮৪ সালে ব্রাজিলজুড়ে যে ‘ফেয়ার ইলেকশন নাও’ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সেখানে মিছিলের অগ্রনায়ক ছিলেন এই ফুটবলার। দিনের বেলায় চলতো চিকিৎসার কাজ আর রাতে ফুটবল অনুশীলন। বিপরীতমুখী এসব কাজের মাঝেও সক্রেটিস হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির মানুষ। তাকে কেন্দ্র করে সে-সময় একাধিক প্রতিবাদী সংগঠনও গড়ে উঠেছিলো ব্রাজিলের বিভিন্ন প্রান্তে। 

সক্রেটিসের ক্রমশ রাজনৈতিক হয়ে ওঠা আর দেশের মানুষের কাছে আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠাটাকে ভালো চোখে দেখেনি তখনকার স্বৈরাচারী সরকার। একটি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছিলো, ব্রাজিলের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ জয় তুলে নিতে না-পারলে সক্রেটিসকে দেশছাড়া করবে ব্রাজিলের প্রশাসন। সেই খবরটাই কিন্তু হঠাৎ ব্রাজিলের সামরিক শাসকদের পতনের ঘন্টা বাজিয়ে দেয়। লক্ষ মানুষ নেমে পড়ে পথে। পতন ঘটে স্বৈরশাসনের।

সেবার সক্রেটিসকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চেয়েছিলো দেশের মানুষ। কিন্তু মাঠের এবং পথের সেই যোদ্ধা সরে দাঁড়ান নির্বাচনী যুদ্ধ থেকে। জানিয়ে দেন, নেতা আর রাজনীতিবিদের মাঝে একটা সরু বিভেদরেখা আছে। আর সে বিষয়টা তিনি জানেন।

রাজনীতির দুনিয়ায় তাঁর সরব উপস্থিতি বজায় ছিলো ২০১১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে দুঃখের সঙ্গেই সক্রেটিস জানিয়েছিলেন, ফুটবলের ব্যাপক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ব্রাজিলের ফুটবলাররা কেবলমাত্র শিক্ষার অভাবে তা ব্যবহার করতে পারে না দেশের পরিস্থিতি বদলানোর জন্য। তাঁর সেই দুঃখের দীর্ঘশ্বাসকে যেন ১১ বছর পর আরেক লাতিন আমেরিকান ফুটবলার মেসি জীবন্ত করে তুললেন ‘এডুকেশন ফর অল’ আর্মব্যান্ড পরে।

 

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

তথ্যসূত্রঃ আইরিশ টাইমস

ছবিঃ

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199