দাড়ি কান্ড...

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 18 Jan 2018

2040 বার পড়া হয়েছে

Shoes

দাড়ি কাটুন অথবা রাখুন, আপনাকে জানতে হবে, একজন মানুষ যদি পৃথিবীতে গড়পরতা ৬০ বছর বেঁচে থাকেন, তাহলে সেই মানুষ জীবনের প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘণ্টা সময় নষ্ট করেছেন তার দাড়ি কাটতেই! মানে গোটা জীবনের প্রায় মাস চলে গেছে দাড়ির পেছনে ব্যস্ত হয়ে।

বাংলা ভাষায় দাড়ির অন্য নাম শশ্রু। বিজ্ঞানীরা অনেক পরীক্ষা করে মানুষের মনস্তত্ব বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন, পুরুষ নিজে দাড়ি রাখতেই আগ্রহী। কিন্তু সে যখন তাঁর দাড়ি কেটে ফেলে, তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেছনের কারণটা থাকে কোনো মহিলাকে 'ইমপ্রেস' করা। কারণ, বেশিরভাগ মহিলারাই আবার ছেলেদের মুখে দাড়ি না থাকাটাই বেশী পছন্দ করেন। আরো মজার তথ্য হচ্ছে, সারা পৃথিবীর পুরুষ এবং মহিলাদের সঙ্গে কথা বলে গবেষকরা দেখেছেন, পুরুষ মানুষের বয়স বাড়লে তাঁর দাড়ি রাখাকে সমর্থন করেন ৮০ শতাংশের বেশি পুরুষ এবং মহিলা! কিন্তু যখন পুরুষের বয়স তুলনামূলক ভাবে কম, তখন কিন্তু নারীরা দাড়ি রাখাটা অপছন্দই করেন।

প্রাচীন মিশরে দাড়ি ব্যাপারটা এক সময়ে এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে মহিলারাও ধাতু দিয়ে তৈরী এক ধরণের নকল দাড়ি নিজেদের সৌন্দর্য্ বিকাশের জন্য পরিধান করতো।

ধারালো ক্ষুর অধবা ব্লেড যুগের পর যুগ ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে মানুষের গালে গজিয়ে ওঠা দাড়ির বিরুদ্ধে। কিন্তু এই নিধন এবং শাসনের চোখ এড়িয়ে দাড়ি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে মানুষের কাছে, বিশেষ করে পুরুষের কাছে। ইতিহাস বলছে এই দাড়ি নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনাও চলেছে তাদের মধ্যে। দাড়ি ইঙ্গিত করেছে শ্রেণী অবস্থান, ভালোবাসা আর পৌরুষকে

তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেলো পুরুষের গালের ওপর গজিয়ে ওঠা এই কেশ নিয়ে বহু ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে। তাই এই সংখ্যা প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজন দাড়ি কান্ড নিয়ে।

দাড়ি নিয়ে গবেষণা! অবাক হওয়ারই মতো ব্যাপার। কিন্তু এই দাড়ি নিয়েও গবেষণা হয়েছে, তৈরী হয়েছে সমীক্ষা প্রতিবেদন। তবে রবীন্দ্রনাথের ওই বিপুল দাড়ির সমাহার নিয়ে কোনো গবেষণা হয়েছে কি না সে সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। আর দাড়ি ছাড়া তো আমরা রবীন্দ্রনাথকে ভাবতেই পারি না। যেমন পারি না কার্ল মার্কসকে। দাড়িপূর্ণ মুখ ভাবলেই অবধারিত ভাবে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে অসাধারণ চে গুয়েভারার অবয়ব।

ইতিহাস লেখা হওয়ার আগের সময়েও মানুষের মধ্যে দাড়ি রাখার প্রচলন ছিলো। তারা অবশ্য একেবারেই শারীরিক কারণে দাড়ি রাখতো। বিশেষ করে প্রচন্ড ঠান্ডা থেকে নিজেদের মুখমন্ডলকে আড়াল করার জন্যই দাড়ি রাখার প্রচলন হয়েছিলো বলে মনে করেন ইতিহাস গবেষকরা।অবশ্য সে দাড়িতে কোনো নান্দনিকতার ছোঁয়া ছিলো না বলাই বাহুল্য। কিন্তু সময়ের বাঁক বদলের মধ্যে দিয়ে সেই দাড়ি হয়ে উঠলো পুরুষের পৌরুষ, আভিজাত্য, ফ্যাশন আর এক ধরণের যৌন আবেদন প্রকাশের বাহন।নানান ভঙ্গী আর ছাঁট নিয়ে দাড়ি হয়ে উঠলো পুরুষের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম।

এই মুহূর্তে পৃথিবীতে প্রায় ৫৫ শতাংশ পুরুষ তাদের মুখে দাড়ি বহন করছে। ১৭০০ সাল নাগাদ গোটা ইউরোপ জুড়ে পুরুষরা তাদের গাল থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছিল  দাড়ি।কিন্তু কেন? তখন সমাজে একটি ধারণার প্রচলন ঘটলো যে মুখভর্তি দাড়ি আসলে পুরুষকে মারমুখী, অভদ্র করে তোলে। সেই সময়ের পুরুষরা তাই দাড়ি কামিয়ে নিজেদের নিজেদের ‘সুশীল ভদ্রলোক’রূপটাই উপস্থাপন করতে চাইলো। এরপর প্রায় দেড়শ বছর বেঁচে থাকলো পুরুষের দাড়িহীন স্টাইল। আবার দাড়ি ঘুরে দাঁড়ালো ১৮ শতকের গোড়ার দিকে। এর আগে অবশ্য দাড়ির বদলে মোটা এবং লম্বা জুলফি পুরুষদের ফ্যাশন হয়েছিলো।

ওই যে বলছিলাম দাড়ি নিয়ে গবেষণার কথা। সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী বিশ্বজুড়ে দাড়িওয়ালা পুরুষদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন, তাদের মনে হিংসার ভাবটা কম থাকে। সমীক্ষায় আরো জানা গেছে, দাড়িওয়ালা মানুষেরা ‘ছ্যাবলা’ ধরণের হয় না। এরা প্রথম পরিচয়ে কোনো মানুষের সঙ্গে মিশতে ইতস্তত বোধ করে। কিন্তু একবার খোলস ভেঙ্গে বের হয়ে এলে এদের মতো চমৎকার সঙ্গী কম হয়। দাড়িটা এদের বেলায় ব্যক্তিত্বের চাদরের মতো কাজ করে।

তবে দাড়িওয়ালা লোকেদের জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে। আমেরিকার আলোচিত বাণিজ্য বিষয়ক পত্রিকা ‘ফোর্বস’ এক সমীক্ষা চালিয়ে প্রকাশ করেছে যে, দাড়িওয়ালা লোকেরা বিত্তশালী হয় না। ফোর্বসের বিচারে বিশ্বের সব চাইতে ধনী মানুষের যে তালিকা প্রকাশ হয় বছর-বছর, সেই তালিকায় ১০০ জনের মধ্যে গড়ে ৯৮ জনেরই মুখ একেবারে ক্লিনশেভ। তবে এই খবরে দাড়িওয়ালা মানুষদের হতাশ হওয়ার কিছু নেই। গবেষণা বলছে, ২০০৮ সালের পর থেকে সারা বিশ্বে পুরুষদের মুখে দাড়ির 'ট্রান্সপ্লান্ট' ৬০০ শতাংশ হারে বেড়ে গিয়েছে! এর কারণ, ২০০৮ সালের পর থেকে সারা বিশ্বেই দাড়ি রাখার চলই বেড়ে গিয়েছে!

এ যুগের নারীরা পুরুষের মুখে দাড়িকে জঞ্জাল মনে করলেও চার্লস ডারউইন সাহেবের বই বলছে একটা সময়ে নারীরা দাড়িওয়ালা পুরুষদেরই পছন্দ করতো। কারণ যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাড়ি তখন পুরুষের প্রাপ্তবয়স্কতা এবং যৌন সামর্থকে চিহ্নিত করতো।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীন মিশরে দাড়ির জনপ্রিয়তা খুব বেশী ছিলো। আর এই জনপ্রিয়তার ধাক্কায় সেখানকার মেয়েরাও দাড়ি রাখতে শুরু করে! চমকে উঠলেন তো? আসলে তখন ধাতুর বিশেষ করে সোনার তৈরী এক ধরণের দাড়ির প্রচলন হয়েছিলো মিশরে। জনপ্রিয়তার জন্যই মহিলারা সেই বিশেষ ধরণের দাড়ি নিজেদের মুখে পড়তেন!এক ধরণের রিং মাথায় আটকে নিতেন তারা। সেই রিংয়ের গায়েই ঝুলতো সোনার দাড়ি। অবশ্য স্বর্ণ নির্মিত দাড়ি সেই মিশরীয় সমাজের ওপর মহলেই বেশী প্রচলিত ছিলো।মধ্যযুগে দাড়ি ছিলো খুব সম্মানজনক একটা বিষয়। তখন কোনও মানুষের দাড়িতে হাত দেওয়া ছিল মারাত্মক অপরাধ। মনে করা হতো, যে ব্যক্তির দাড়িতে হাত দেওয়া হয়েছে, তাকে আসলে চূড়ান্ত অপমান করা হয়েছে। সমাজে দাড়িওয়ালা মানুষের মূল্য ছিল এতটাই। আর অন্যের দাড়িতে হাত দেয়ার অপরাধে কঠোর শাস্তিও দেওয়া হতো।

প্রাচীন কালে সমুদ্রে জলদস্যু বা পাইরেটদের মাঝেও দাড়ি রাখার প্রচলন ছিলো। মড়ার মাথার খুলি আঁকা সেই ভয়াল রক্তহিম করা কালো পতাকা আর কদাকার দাড়িওয়ালা দস্যুরা তখনকার পৃথিবীতে আতঙ্ক হয়েই বিরাজ করতো। জলদস্যুদের দাড়ি রাখার স্টাইলও পরবর্তী সময়ে পুরুষদের কাছে ফ্যাশন ট্রেন্ড হয়েছিল।

সেই সময়ে পূবের দেশগুলোতে বিশেষ করে গোটা ভারতবর্ষে দাড়ি ছিলো জ্ঞান এবং সম্মানের প্রতীক। সাধু সন্নাসীরা দাড়ি রাখতো। সে দাড়ি তারা কর্তনও করতো না। দাড়ি তখন এতোটাই সম্মানজনক ছিলো যে, কোনো পুরুষ পরকীয়া প্রেমে লিপ্ত হলে অথবা অন্য কোনো ধরণের সামাজিক অপরাধ করলে শাস্তি হিসেবে তার দাড়ি কেটে দেয়া হতো।

রাজনীতি আর রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দাড়ির একটা সম্পর্ক আছে বোধ হয়। এক সময়ে রাজনৈতিক নেতা আর বাম রাজনীতির প্রবাদ পুরুষদের সবারই দাড়ি ছিলো।কার্ল মার্কস, অ্যাঙ্গেল, লেনিন সবা্র গাল এবং থুতনিতে ছিলো দাড়ির রাজত্ব। এক সময় নাকি রাশিয়ায় গাল ভর্তি দাড়ি নেই এমন কমিউনিস্ট নেতাকে পাতেই তোলা হতো না। বলা হতো সেই ব্যক্তি সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে পারেনি। এ বিষয়ে খোদ স্ট্যালিনেরও সমালোচনা ছিলো। তবে স্ট্যালিনের ইয়া চওড়া গোঁফ বোধ হয় দাড়ির অভাব পূরণ করে দিয়েছিলো।

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রো একবার বলেছিলেন, কেউ যদি দৈনিক ১৫ মিনিট সময় দাড়ি না কামিয়ে বাঁচাতে পারে তাহলে সে মানুষ বছরে বাড়তি দশ দিন  সময় হাতে পাবে কাজ, বই পড়া আর খেলাধূলার জন্য। ফিদেল কাস্ত্রোর দাড়ি তো ইতিহাস হয়ে আছে। তেমনি হয়ে আছে চে গুয়েভারার শশ্রু। পৃথিবীর দেশে দেশে তরুণরা চে‘র দাড়িকে ফ্যাশন আইকনে পরিণত করেছে। তবে ষাট অথবা সত্তরের দশকে  গোটা পৃথিবী জুড়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার জন্য যে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয় সেই গেরিলাদের গাল ভর্তি দাড়ি ও বড় চুল তখন হয়ে ওঠে তরুণদের বিশেষ পছন্দের বিষয়। সত্তরের দশকে পৃথিবী জুড়ে হিপি কালচারও দাড়িকে সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। তখন বহু রক গানের গায়ককেও দেখা যেতো দাড়ি রাখতে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দাড়ি রাখার ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন বিখ্যাত রক গায়ক আজম খান। ওই সময়ে দাড়ি, গোঁফ ছিলো এক ধরণের বিদ্রোহের প্রতীক। তখন একদল পুরুষ বিশেষ করে তরুণরা ‘জয় অফ সেক্স’ নামে আরেকটি ভিন্ন আন্দোলন তৈরী করে। সেই আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল দীর্ঘ দাড়িওয়ালা তরুণরা তরুণীদের কাছে নিজেদের যৌনতার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করবে।

সিনেমার পৃথিবীতে দাড়ি রাখার চল আছে। অন স্ক্রিন অথবা অফ স্ক্রিন দু জায়গাতেই নায়করা দাড়ি রাখেন। তাদের এই দাড়ি ভক্তদের কাছে হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। বলিউডে আমির খানের ক্ষুদে সাইজের দাড়ি রাখাটা বেশ অনেকদিন ফ্যাশান হয়ে ছিলো পুরুষদের মাঝে। আর হলিউডে অভিনেতা জনি ডেপ তো পাইরেটস অফ দি ক্যারিবিয়ান সিনেমায় জলদস্যুর বেশ ধারণ করে দাড়িটাকেই বিখ্যাত করে ফেলেছেন।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন জীবনের শুরুর দিকে দাড়ি রাখতে পছন্দ করতেন না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তাঁকে একটি ছোট মেয়ে চিঠি লিখে বলে, 'আপনি যদি দাড়ি রাখেন, আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগবে।' ব্যস, লিঙ্কন শুরু করেন দাড়ি রাখা। আমরা তো এখন আব্রাহাম লিঙ্কনকে দাড়ি ছাড়া কল্পনাই করতে পারি না।

ডাক্তারদের কাছেও এই দাড়ি কিন্তু প্রয়োজনীয় একটি ব্যাপার। তারা বলেন, অনেকের মুখের ত্বকে এলার্জি হলে সেটা সারাতে দাড়ি কাজে আসে। এ ছাড়া দাড়ি রাখলে পুরুষের মুখের ত্বক তুলনামূলক ভাবে কোমল হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, বড় দাড়ি ঠান্ডা থেকে গলাকে রক্ষা করে, কন্ঠনালীতে ইনফেকশন এড়াতেও সাহায্য করে।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199