লেনিনের যতো ভালোবাসার চিঠি…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 14 Mar 2024

2155 বার পড়া হয়েছে

Shoes

লেনিনের চিঠিগুলো উড়ে যায় সন্ধ্যার বাতাসে। উড়ে গিয়ে শব্দগুলো জানতে চায় সে কতোটা অসুস্থ? কী খেয়েছে, কে তাকে রান্না করে দেয়? জানতে চায় রাশিয়ার তীব্র শীতে তার কি আরও জ্বালানী কাঠ লাগবে? চিঠির নিচে লেখা, ‘তোমার লেনিন’।

১৯২০ সালে প্রতিবিপ্লবের আগুনে পুড়ছে সোভিয়েট রাশিয়া। সেই সময়ে লেনিন চিঠি লিখছেন।সেই চিঠিগুলোর প্রাপকের উত্তর এসে পৌঁছাচ্ছে লেনিনের কাছে, ‘আত্মার ভেতরে মৃত্যুর কান্না কখনও শেষ হবে না। আমি অবাক হই দেখে যখন অন্য মানুষেরা হাসে। আমার হৃদয়ে আমার সন্তান আর তোমার(লেনিন)জন্য কিছু উষ্ণতা বাকি রয়ে গেলো শুধু।’

এই চিঠিগুলোর আকুলতার সূত্র স্মৃতির পথ ধরে ফিরে যায় ১৯১০ সালে প্যারিস শহরে। সেখানে এভিনিউ দ্য অর্লিন্সের এক পানশালার উপরে এক ছোট্ট কুঠুরিতে বসে রুশ বলশেভিকদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত থাকতেন ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। সেখানেই সে বছরের শরৎকালে লেনিনের বিপ্লব প্রচেষ্টার সঙ্গে যোগ দিতে আসেন ৩৬ বছর বয়সী ইনেসা আরমান্ড। বাদামী চুল আর সবুজ চোখের সেই নারীকে দেখে তখনেই মুগ্ধ হয়েছিলেন লেনিন? ভালোবাসার গভীর আবেগে কেঁপে উঠেছিলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সেই লৌহ মানবের হৃদয়? ভালোলাগা তৈরি হয়েছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর তা থেকেই এক অদ্ভুত প্রণয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো দুজনের মাঝে। স্ত্রী স্ক্রুপস্কায়াও জানতেন সেই সম্পর্কের কথা।

এই সম্পর্কের পরিণতি জানতে চাইলে অপেক্ষা করতে হয় ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত যখন ইনেসার মৃত্যুময় শরীরের আশ্রয় কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে টলে উঠেছিলেন লেনিন।চোখ ভরে উঠেছিলো কান্নায়।তারপর? তারপর পাথরের মতো ভালোবাসার মৃত্যু সহ্য করে নেয়া শুধু।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো লেনিনের ভালোবাসার গল্প ‘লেনিনের যতো ভালোবাসার চিঠি’।   

ইনেসা আরমান্ড

কে ছিলেন এই ইনেসা আরমান্ড? বিপ্লবী, ৫ সন্তানের জননী আর রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম রূপকার লেনিনের প্রেমিকা? এটুকু পরিচয়ের ব্র্যাকেটে বন্দী করা যায় না তাঁকে। রুশ বিপ্লবের পরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের ক্ষমতাধর নারী। বিপ্লবের আগে ঝড়ে ওড়া দিনগুলিতে তিনি পাশে ছিলেন লেনিনের।লেনিনের সঙ্গে বিনিময় করা তার চিঠিগুলো দীর্ঘকাল রুশ সেন্সরশীপের অন্তরালেই ঘুমিয়ে ছিলো। লেনিনের স্ত্রী’র মৃত্যুর পর ইনেসার বড় মেয়ে আন্না তার মায়ের কাছে লেখা লেনিনের সব চিঠি রুশ কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগারে জমা দেন। বিচক্ষনতা আর সাহস তাকে লেনিনের সহচরে পরিণত করেছিলো। ফরাসী বংশোদ্ভূত ইনেসার জীবনীকার মাইকেল পিয়ারসন তার বইতে তাকে চিহ্নিত করেছেন ‘লেনিনের সংকটতারিণী’ হিসেবে। এই কৃতিত্ব ইনেসা একদিনে অর্জন করেননি।লেনিনের সেই নির্বাসিত জীবনে সেই নারী সংগঠন গড়ে তোলার কাজে সহায়তা থেকে শুরু করে একাহাতে বিভিন্ন সংকট সামলানোর কাজে এতাটাই দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন যে লেনিন মুগ্ধ হয়ে যান। সেই মুগ্ধতা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় প্রেমের সীমানায়। আর লেনিনের সেই ভালোবাসা আর মুগ্ধতা ইনেসাকে ১৯১৯ সালের মধ্যে পরিণত করে মস্কোর এক শক্তিধর নারীতে।

ইনেসা আরমান্ডের জন্ম ফ্রান্সে। বাবা থিওডর স্তেফান ছিলেন অপেরা গায়ক। মায়ের সূত্রে তারা রুশ দেশে বসবাস করতেন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা চোখ বন্ধ করলে ইনেসা আর তার বোনকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মস্কোতে খালার কাছে। সেখানেই পড়াশোনা করেন ইনেসা। তিনটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন;জানতেন পিয়ানো বাজাতেও। তাঁর পিয়ানোর সুর উন্মনা করে দিতো লেনিনকে। পিয়ানোর রোম্যান্টিকতার বাইরে ইনেসার আরেকটি রূপ ছিলো। প্রথম বিয়েতে বিচ্ছেদ নেমে এলে ব্রাসেলসে চলে যান তিনি। লেখাপড়া করেন অর্থনীতি শাস্ত্র নিয়ে। ইনেসা একাধিকবার জেল খেটেছেন, নির্বাসিত হয়েছেন। তারপর সেখান থেকে পালিয়েও গেছেন।

এই লড়াইয়ের দাগগুলোর বাইরেই তার মুখে ভালোবাসার দাগও ছিলো। সেই দাগে আঙুল ছুঁইয়ে দিয়েছিলেন ইলিচ লেনিন স্বয়ং,যাকে চিঠিতে ইনেসা সম্বাধন করছেন ভি. আই বলে।কিন্তু সম্পর্কের এই স্রোতস্বিনীকে লেনিন নিজের হাতেই মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন এক পর্যায়ে গিয়ে। যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি ইনেসার সঙ্গে। ১৯১৩ সালের শেষের দিকে ইনেসার চিঠি, ‘আমি তোমার চুম্বনগুলো ছাড়াও বাঁচতে পারবো কিন্তু তোমাকে না-দেখে নয়। তোমার সঙ্গে কখনো কথা বলাটাও আমার জন্য গভীর আনন্দের অনুভূতি। আমাদের এটুকু সম্পর্ক তো কারুর জন্যই বেদনা বহন করে আনছে না।চিঠি লিখো আমাকে।’

লেনিন ইনেসার আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। ১৯১৪ সালের জানুয়ারী থেকে পরবর্তী সময়ে লেনিন ইানেসাকে প্রায় দেড়’শ চিঠি লেখেন। সেসব চিঠিতে নির্দেশ আর গুরুগম্ভীর কথার ভিড় এড়িয়ে লেনিনের গভীর আবেগ আর ইনেসার জন্য উৎকন্ঠা জড়িয়ে থাকতো।

ইনেসা তখন ফ্রান্সে পার্টির প্রচারণার কাজ করছিলেন। তাদের দু’জন আবার কাছাকাছি চলে আসেন অক্টোবর বিপ্লবের পর।১৯১৭ সালের পর ইনেসা পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা করে নেন।সেটা ১৯১৮ সালের মার্চ মাসের কথা। একই বছরের আগস্ট মাসে প্রতিপক্ষ দলের সদস্য ফ্যানি কাপলান গুলি চালান লেনিনের ওপর। আহত হন লেনিন। আর তখনই আবার ডাক পড়ে ইনেসার। ক্রেমলিনের খুব কাছে একটি বড় অ্যাপার্টমেন্টে তার থাকার ব্যবস্থা হয়। সেখানে সঙ্গী হয় টেলিফোন। স্ক্রুপস্ক্রায়া তখন লেনিনের পাশে ছিলেন না। ইনেসা তখন পার্টির মহিলা অংশের প্রধান।

১৯১৮ সাল এলো। ইনেসা ডুবে যেতে থাকেন মস্কো থেকে দূরে সাংগঠনিক কাজের মধ্যে। মুখোমুখি হতে হয় তাকে প্রতিবিপ্লবীদের বন্দুকের। অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন লেনিন ডাক্তার পাঠান মস্কো থেকে।ডাক্তার ফিরে গিয়ে জানালো নিউমনিয়ায় আক্রান্ত ইনেসা। লেনিনের নির্দেশ ছিলো, ইনেসার কন্যারা যেন দু’বেলা নিয়ম করে তার অবস্থা জানায়। পরে অবশ্য অসুখ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন ইনেসা। লেনিন তাকে ছুটি দিয়ে একটি বিশ্রামাগারে পাঠাতে চেয়েছিলেন।

তখন ছুটি না নিলেও ছুটি মিলে যায় ইনেসার। ১৯২০ সালে প্রতিবিপ্লবীদের হামলার মুখে পড়েন তিনি। সহযোগী দুই বলশেভিক অফিসার খুন হয়। পালাতে গিয়ে বেলসান নামে এক গ্রামে কলেরায় আক্রান্ত হন তিনি। তারপর ভালোবাসার মঞ্চে এসে হাজির হয় মৃত্যু।

মৃত্যুর আট দিন পর ইনেসার মৃতদেহের সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ পান লেনিন। গার্ড অফ অনারের পর কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ভালোবাসার মুখ দেখতে গিয়ে কেঁপে উঠেছিলেন লেনিনও। হয়তো তখন হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিলো তাঁর ভালোবাসার চিঠিগুলো।

তথ্যসূত্র ও ছবিঃ দ্য গার্ডিয়ান, রাশিয়া বিয়ন্ড, গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199