শীতকাল ভালোবেসে…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 2 Jan 2025

3705 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শীতকাল কাকে ভালোবাসে? সেই সকালটাকে ভালোবাসবে যে খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে ধূসর রঙের একটা মাফলার গলায় জড়িয়ে আলাভোলা পাড়ার চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে উস্কোখুস্কো দৃষ্টি মেলে বসে থাকবে অনেকক্ষণ? দুধ আর অনেক চিনি মেশানো রঙ মিলান্তি চা খাবে টোস্ট বিস্কুট ডুবিয়ে, অযথাই অসংখ্য কথা বলবে যেন তার তার আর কিছুই করার নেই আজ? নাকি এই কুয়াশায় মোড়া চারপাশের পেটে ছুরি চালানোর মতো রোদ উঠলেও তার আলস্য কাটবে না? সেই সকালটা এর পর কোথায় কোথায় যেন যাবে। ভুল বাসে উঠে ইংলিশ রোডের মোড়ে নামতে গিয়ে তার মনে হবে, আজ তো এদিকে আসার কথা ছিলো না!
নাকি শীতকাল এরকম বেভুল সকাল ভালোবাসবে না? ব্যস্ত টেবিলে দ্রুত কফির কাপ, সংক্ষিপ্ত কামড় স্যান্ডুইচে, তাড়াহুড়োতে স্যুটে সসের দাগ নিয়ে ছোটা পথঘাট, স্পার্টাকাসহীন জীবনের ব্যাকুল বাঁশি বাজা সকালেকে ভালোবাসবে?

জীবন এরকমই। টস করা একটা পয়সার কোন দিকটা শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে সামনে আসবে কেউ তা জানে না। কিন্তু তবুও আমরা বাঁচি জীবনের এইসব শীতকালে। কোথাও যেতে চাই। আবার কোথাও-ই যাবার কথা ভাবি না। শীত তেমন করে না ঝাঁপিয়ে না পড়লেও আমরা শীত ভালোবাসি। রান্নাঘরে কপি আলুর মাখামাখি ঘ্রাণে, উদাস চায়ের দোকানে, পড়ে ফেলা বইয়ের পাতায়, জীবনের সব গুঢ় আয়োজনে আমরা শীতকালের কাছে যেতে চাই। ছাদে লেপ রোদে দিই মধ্যবিত্ত আয়োজনে।

প্রিয় শীত নিয়ে এবার প্রাণের বাংলার প্রচছদ আয়োজনে রইলো, ‘ক্যালেন্ডারে সব তারিখ শীতকালের’।
শীতকাল কি জমিয়ে রাখা অনেক স্মৃতির হাতবাক্স আমাদের? কত কী মনে পড়ে শীত এলে। কেউ প্রশ্ন করবেন, শীত কি আর আসে? এ শহর, এ জীবন, এই ভূগোলের পাল্টে যাওয়া জলবায়ু কোথায় যেন শীতের হাত ছেড়ে দিয়ে প্রতিবার একা একা আসে ক্যালেন্ডারের পাতায়। বিনয় মজুমদার লিখেছেন, ‘‘মৃত্তিকাসংলগ্ন মেঘ এখনো কুয়াশারাশি বলে অভিহিত হয়’’। সেরকম কুয়াশারাশি আজও নেমে আসে মাটির কাছাকাছি? মানুষ হারিয়ে যায় ঘন কুয়াশায়। পথঘাট, চেনা বাড়ি এমনকি পোষা কুকুরটার আলস্যকেও দেখা যায় না তেমন কুয়াশা বহুকাল দেখিনি। কোনো বছর নভেম্বর মাসের মাঝখানে হঠাৎ বৃষ্টি নামে আবার কখনো নামে না। কেউ গুন গুন করে ‘নভেম্বর রেইন’ গানটা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। স্মৃতি তো তাই। মনের অতলে একটা পুরনো গান শীতের বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে। কারো মুখ অপেক্ষা করে? শুকিয়ে আসা পুকুরের পানিতে নাক তুলে শ্বাস নেয়া নৌকা, হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানের পুরনো আলমারির গায়ে মাকড়সার জাল বা কাচের ফুল তোলা বাটিতে দুধ লাউয়ের নরম অপেক্ষা করে কারো জন্য। শীত আসে আবার শীত চলেও যায়। কিন্তু স্মৃতি থেকে যায় গত বছরের ক্যালেন্ডারে মৃদু কথোপকথন হয়ে।

মশা ভর্তি লিফট, লো ভোল্টেজ বাল্ব, কোনো গভীর রাতে হাসপাতালের সাদা করিডোরেও শীতকালের স্মৃতি থেকে যায়। এই শহর নাম ভুলে যায় মানুষের। তারপর মানিব্যাগে খুচড়ো টাকার মতো খোঁজে সম্পর্কের ইতিবৃত্ত। সদ্য সাহিত্যে নোবেল পাওয়া হান কাং তার ‘দ্য হোয়াইট বুক’-এ ছোট্ট গদ্য ফগ-এর প্রথমেই লিখছেন, ‘‘খুব ভোরে এই শহরের ভূতেরাও কি জড়িয়ে নেয় মাফলার?’’। ভোর অথবা রাতেও শীতের মধ্যে সত্যিই মনে হয় শহরটার পথে ভূতেরা হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছে অথবা অফিসে যাচ্ছে। তাদের কনুইয়ের কাছে ক্রিম না মাখার অপরাধে সাদা হয়ে আছে। চুলে খুস্কি, জুতায় গত রাতের বমির ছিটে।
শীতকালে পানশালাগুলিও বেপরোয়া হয়ে ওঠে আরও। কুয়াশার মতো সিগারেটের ভারী ধোঁয়া মেঝেতে শিকড় ঢুকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। একটু ঝুঁকে পড়া মাথাটা জায়গা মতো বসিয়ে বের হতেই দেখি রাস্তায় তখনও বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কয়েকটা গোলাপ বিক্রি করছে একা বালিকা। তার উচ্ছন্নে যাওয়া চোখের দৃষ্টিতে কবে থেকে লেগে আছে বাড়ি ফিরে ভাত খেতে পাওয়ার স্বপ্ন। ওর শীত করে না? ঠাণ্ডা হাওয়া শূন্য পথের দখল নিতে নিতে জানায়, না, ওদের শীত করতে নেই। শীতকাল এদেরও ভালোবাসে? মৃতের হাড়ের মতো সাদা শীতে ওদের শরীর কেঁপে ওঠে। শীতকাল কাকে ভালোবাসে?
এক ঘোরের অ্যালবাম হয়তোবা। সেখানে পাতায় পাতায় কত ছবি আটকানো! শীত আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু সে আমাদের উঠানে ভালোবাসা ফেলে রেখে যায়। বছরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে শীতকাল সবাইকেই ভালোবাসে বোধ হয়।

ছবিঃ ছবিঃ আব্দুল মোমিন ও ফেইসবুক থেকে

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199