উঁকি...

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 30 Nov 2023

3215 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সেই ছেলেবেলায় পড়া কাঠের পুতুল পিনোকিএর গল্পে মিথ্যা বলার অপরাধে পুতুলটির নাক লম্বা হয়ে গিয়েছিলো। আমরা এখনও নিজের নাক লম্বা করে গলিয়ে দিই অন্যের ব্যক্তিগত চৌহদ্দিতে। কাজটা আড়াল থেকেই করা হয়। তাই কাজটা উঁকি দেয়া বলেই বেশি পরিচিত। আকাশে চাঁদ উঁকি দেয়, পাহাড় উঁকি দেয়, সূর্যও উঁকি দেয় ভোরবেলা। কিন্তু অন্যের জীবনে উঁকি দেয়ার সঙ্গে অনুপ্রবেশ শব্দটার গভীর যোগাযোগ আছে বলেই মনে হয়।

মানুষ কৌতুহলী প্রাণী। দেখার কিংবা জেনে ফেলতে চাওয়ার আগ্রহ তার অপরিসীম। কিন্তু ‘প্রাইভেসি’ বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধারণা জন্মলাভ করার আগ পর্যন্ত কোনো ধরনের সংকোচ বা অপরাধবোধ ছাড়াই এই অভ্যাসটাকে মানুষ বেশ উপভোগই করেছে। কিন্তু আধুনিক মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিকতার জগতে এই উঁকি দেয়ার বিষয়টা জটিলতার জন্ম দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। সাংবাদিক, গোয়েন্দা অথবা হালের পাপ্পারাৎজিদের নাক অনেকটা সেই গল্পের পিনোকিওর মতোই। তারা নাক গলান অন্যের জীবনে। আর তাতে প্রলয় ঘটে। ঢাকাই ছবির নায়িকা পরিমনি থেকে শুরু করে হলিউডের তারকা প্রয়াত মেরিলিন মনরো কেউ-ই এই উঁকির ভয় থেকে মুক্ত নন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই নতুন যুগে উঁকি শব্দটা ভীষণ শক্তিশালী।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে পাঠকদের জন্য রইলো ‘উঁকি’।

মেরিলিন মনরোর জীবনে উঁকি দিয়েছিলেন সাংবাদিকরা। ক্যামেরার লেন্স তাকে হাতছাড়া করেনি কখনো। আর তাতেই আমেরিকার আলোচিত প্রেসিডেন্ট জন.এফ কেনেডির সঙ্গে মনরোর গোপন প্রেম উঠে এসেছিলো প্রকাশ্যে।১৯৬১ সালে বৃটেনের সেক্রেটারি অফ স্টেট জন প্রফুমো এবং ১৯ বছর বয়সী মডেল ক্রিস্টিন কেলারের প্রণয় কেচ্ছা সাংবাদিকদের উঁকিঝুকিতেই ডানা মেলেছিলো। রাজকুমারী ডায়নার জীবনেও উঁকি দেয়ার মানুষের অভাব ছিলো না। নিজস্ব জীবনে অন্য মানুষের অনুপ্রবেশ তাকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, ‘‘গোপন কথাটি রবে না গোপনে’’। এই অন্তরাল জানার জন্য মানুষের মনের তীব্র ইচ্ছা-ই তাকে বাধ্য করে উঁকি দিতে। অন্যের জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটাতে। পাশের বাড়ির জানালা অনেক গল্প জানে। রবি ঠাকুরের গানের মতো দুপুরে এই জানালার গল্পে প্রকাশিত হয় প্রতিবেশীর হাঁড়ির খবর। একদা বাড়ির বউরাও আধুনিক সময়ের পাপ্পারাৎজিদের চাইতে কম পটু ছিলো না এই উদঘাটনের কাজে। ‘নেই কাজ তো খই ভাজ’ টাইপের অলস দৃপুরে অন্যের চৌহদ্দিতে অনুপ্রবেশ করাই ছিলো তাদের প্রিয় সাধ। মানুষের মনে হয়, অন্যের মুখ ম্লান করে দিতে ভালো লাগে। সেই কবে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন কবিতায়-অপরের মুখ ম্লান করে দেয়া ছাড়া আর কোনো প্রিয় সাধ নেই। আজও তা ভীষণ এক সত্য। উঁকি দেয়ার সঙ্গে ব্যক্তির নিজস্ব নির্জনতা নষ্ট হওয়ার যোগাযোগ আছে। কিন্তু সত্য জানার সঙ্গে বিষয়টার সংঘাতও আছে। সিনে পর্দার খ্যাতিমান নায়িকা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ কোথায় গোপনে কী ঘটিয়ে ফেলছেন আর তাতে কোন স্বার্থ বিঘ্নিত হচ্ছে সেটুকু জানার অধিকার সোধারণ মানুষের আছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে জানার অধিকার সবচাইতে আগে। বিতর্ক থেকেই যায় চায়ের কাপে ঝড় তোলার জন্য। বিংশ শতাব্দীর অলস, শিথিল সমাজ রবীন্দ্রনাথ বৌদির সঙ্গে প্রণয়ে জড়িয়েছিলেন কি না প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু এখন ব্যবচ্ছেদের ছুরি সব অন্তরাল কেটে প্রশ্ন তুলছে। জানতে চাইছে ঠাকুরবাড়ি থেকে কেনো মৃণালিনী দেবীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে ঢাকা-চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিলো?

দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনে ফেলা অথবা জানালাল উঁকি দিয়ে জেনে ফেলা কোনো গভীর গোপন তাহলে কি ফ্যাসিস্ট আচরণ না তথ্য জানার অধিকার?

আধুনিক পৃথিবীর পিনোকিওদের নাক ক্রমেই লম্বা হয়। নাক গলিয়ে তছনছ করে দেয়া হয় অন্যের জীবনের গোপনীয়তা। উঁকি দিয়ে দেখা ঘটায় প্রলয়। সামাজিক যোগাযোগমাধমৈ অন্যের প্রোফাইলে তার অজান্তে ঢুকে পড়ার প্রবণতা রুখতে নিতে হয় প্রতিরোধ ব্যবস্থা। গোপনীয়তার ভিতরেও যে এক ধরণের সৌন্দর্য থাকে তা আর বাঁচিয়ে রাখতে চাই না আমরা।

মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অন্য মানুষের অনুপ্রবেশের ডাক নাম উঁকি এখন মারাত্নক রোগের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এই স্বভাব কখনো হয়ে ওঠে অসুখ।মাছির মতোন ছিদ্রান্বেষণ বলা যেতে পারে এই উঁকি দেয়ার স্বভাবকে।

ছবিঃ গুগল, ইনস্টাগ্রাম  

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199