স্বৈরাচার স্বৈরাচার…

মোঃ জুলফিকার আলী

প্রযুক্তি লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 14 Nov 2024

6535 বার পড়া হয়েছে

Shoes

স্বৈরশাসন হলো এমন একধরনের শাসনব্যবস্থা, যেখানে একক ক্ষমতাবান নেতা বা দল জনগণের ওপর কঠোর শাসন চাপিয়ে দেয় এবং তাদের অধিকাংশ গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। ইতিহাসে বিভিন্ন সভ্যতায় স্বৈরশাসকরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে এবং জনগণের জীবনে ভীতির পরিবেশ তৈরি করেছে। ক্ষমতার মোহন পারদ বল নিজেদের মুঠোর ভিতরে ধরে রাখতে তারা পদদলিত করে বিরুদ্ধ মত। ক্ষতবিক্ষত করে স্বাধীনতা, খুন করে মানুষের স্বাধীন স্বপ্ন। এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো পৃথিবীজুড়ে স্বৈরাচারী শাসক আর তাদের সময়ের রুদ্ধশ্বাস গল্প।   

প্রাচীন যুগের স্বৈরশাসকেরা
মিশরের আখেনাটন তার শাসনামলে ধর্মীয় সংস্কার চালু করে সাধারণ জনগণের আস্থাভাজন হতে ব্যর্থ হন। প্রাচীন মিশরে বহুদেবতার পূজা প্রচলিত থাকলেও আখেনাটন একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, যা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে। চীন সম্রাট চি’ন শিহ-হাং-তি কঠোর আইন এবং বাধ্যতামূলক শ্রম দিয়ে প্রাচীর নির্মাণ করলেও তার শাসনকালে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। তিনি কনফুসিয়ান দর্শন নিষিদ্ধ করেন।
আশারিয়ার সিন্নাকেরিব সিংহাসন ধরে রাখতে বিভিন্ন প্রতিবেশী রাজ্যের ওপর আক্রমণ চালান। রোমের কুখ্যাত সম্রাট নিরোর নির্যাতন ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। তার খেয়ালী আচরণ রোমের সমাজকেই বিপর্যস্ত করে দেয়।  আততিলা দ্যা হুন শুধু সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য পৃথিবীর বহু শহর ধ্বংস করেন এবং গণহত্যা চালান।

মধ্যযুগীয় অন্ধকারে
মধ্যযুগে রোমের ক্যালিগুলা এবং তৃতীয় রিচার্ডের নাম স্বৈরাচারী শাসক হিসাবে সুপরিচিত।  ক্যালিগুলা তার উদ্ভট শাসন আর ক্ররতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তৃতীয় রিচার্ড ব্রিটেনে নিজের অবস্থান শক্ত করতে অনেককে নির্মমভাবে হত্যা করেন। রাশিয়ার জার আইভান দ্যা টেরিবল তার শাসনকালেমানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার চালান।

রেনেসাঁ ও আধুনিক যুগের একনায়কেরা
ইউরোপীয় রেনেসাঁ এবং তার পরবর্তী সময়ে প্রুশিয়ার ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ও ফ্রান্সের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে ব্যাপক দুর্ভোগের সৃষ্টি করেন। ফ্রান্সের রবেসপিয়েরে গিলোটিনের মাধ্যমে বহু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করেন, যা ফরাসি বিপ্লবের সময় তাকে কুখ্যাত করে তোলে। স্পেনের ফ্রান্সিসকো পিজেরো ও হার্নান কর্তেস লাতিন আমেরিকার অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে স্থানীয় জনগণকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখেন।

ঊনবিংশ শতাব্দীর কুখ্যাত সব ছায়া
উনবিংশ শতাব্দীতে জার্মানির দ্বিতীয় কাইজার উইলহেম এবং রাশিয়ার জার প্রথম পল নিষ্ঠুর শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করে তাদের সাম্রাজ্যকে বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয় লোপেজ পারাগুয়ে তার শাসনকালীন সময়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেশকে ধ্বংসাত্মক অবস্থায় নিয়ে যান। আফ্রিকার শাসক শাকাজুলু সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধে আশক্ত হয়ে পড়েন। উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিন তার শাসনামলে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার নির্দেশনা দেন।  আমিনের শাসনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা, এবং অত্যাচার ব্যাপকহারে ঘটেছিলো। তার শাসনাবসানে উগাণ্ডার অর্থনীতি এবং সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। 

বিংশ শতাব্দীর উন্মাদেরা
বেনিতো মুসোলিনি ছিলেন ইতালির একজন ফ্যাসিস্ট নেতা।  মুসোলিনি ফ্যাসিজমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচিত এবং তাকে ইউরোপে ফ্যাসিস্ট আদর্শ প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি মনে করা হয়। তার শাসনকালকে ইতালিতে একনায়কতন্ত্র এবং কঠোর শাসনের উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্টালিন সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা হিসেবে দীর্ঘ সময় শাসন করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষমতাকে সংহত করতে কঠোর নীতি প্রয়োগ করেন। স্টালিনের সময়ে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালানো হয়েছিলো, যাকে "গ্রেট পুর্জ" বলা হয়। এই যোসেফ স্তালিনের নেতৃত্বেই রুশ দেশের মানুষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের কুৎসিত আর নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। পরে সমাজতান্ত্রিক এক নায়কতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে স্তালিনই সোভিয়েট সমাজকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে যান। তার নির্দেশে বহু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা করা হয়, সাইবেরিয়ার শ্রম শিবিরে পাঠানো হয় অনেক মানুষকে। হিটলার ছিলেন একজন ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারী শাসক, যিনি নাৎসি জার্মানির শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। তার শাসনামলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং তিনি ইহুদি জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা চালান, যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। তার শাসনকালের সময়কার বিভীষিকাময় নির্যাতন এবং গণহত্যা ইতিহাসে অন্যতম নিষ্ঠুর অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

চীনের প্রভাবশালী কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুং ছিলেন একজন স্বৈরাচারী শাসক। চীনের মানুষকে শোষণ আর বঞ্চনা থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি সমাজতান্ত্রিক চীনের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তিনি লং মার্চ করেছিলেন লাল ফৌজ নিয়ে। সেই লং মার্চে মাও জে দং আর তার বাহিনী পায়ে হেঁটে দশ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে ইয়েনানের পাহাড়ে পৌঁছায় এবং যুদ্ধ শুরু করে তখনকার অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে। পরে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য মাও জে দং কঠোর শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন। পশ্চিমা বিশ্ব তার সমাজতান্ত্রিক কঠোর শাসনব্যবস্থাকে স্বৈরাচারী শাসন বলে আজও অভিহিত করে ইতিহাসের পাতায়।

কম্বোডিয়ার খেমার রুজ নেতা পল পটকে পশ্চিমা ইতিহাস ও গণমাধ্যমগুলো ইতিহাসের ভয়ংকর এক স্বৈরশাসক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। তার শাসনামলে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তিনি কম্বোডিয়াকে একটি কৃষিভিত্তিক সমাজে রূপান্তর করার চেষ্টা করেছিলেন।  

সাদ্দাম হোসেন ইরাকে তার বিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করতেন। তার শাসনকালে ইরানে এবং পরে কুয়েত আক্রমণের ঘটনা ঘটে। ইরাকে বিরোধী শিয়া ও কুর্দি জনগোষ্ঠীর ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালানো হয়েছিলো, যার ফলে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটে।

এই সময়ের দানবেরা
একবিংশ শতাব্দীতে উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল-সাং এবং তার পুত্র কিম জং-ইল তাদের দেশের জনগণের ওপর ভয়ানক দমননীতি চালিয়েছেন। এই শাসকরা নিজেদের শক্তি এবং শাসনকে সংহত করার জন্য নিজের দেশের মানুষকেই কয়েদ করেন ভীষণ এক বলয়ের ভিতরে। এই ঘেরাটোপ আজও উঠে যায়নি।

পাশাপাশি, ইরানের আয়াতুল্লাহ খামেনি তার রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করেন এবং জনসাধারণের মত প্রকাশে বাধা দেন। চীনের শি জিনপিং তার শাসনকালে উইঘুর মুসলমানদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে তাদের মানবাধিকারের লঙ্ঘন করেন। ফিলিপাইনের রডরিগো দুতের্তে তার মাদকবিরোধী অভিযানে ব্যাপক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালান, যা আন্তর্জাতিক সমালোচনা অর্জন করে।

ভেনেজুয়েলার নিকোলাস মাদুরো তার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসাত্মক অবস্থায় নিয়ে যান, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান তীব্র অবনতির শিকার হয়। জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবে তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে বিরোধী দল ও মতকে নির্মূল করে এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বৃদ্ধি করেন। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ তার দেশের গৃহযুদ্ধের সময়ে জনগণের ওপর ভয়ংকর অত্যাচার চালান, যার ফলে লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।

স্বৈরাচারী শাসকদের পতন সাধারণত একাধিক কারণের সমন্বয়ে ঘটে। স্বৈরশাসকদের পতনের ক্ষেত্রে প্রধান কারণগুলো হলো জনমনে চরম অসন্তোষ, অর্থনৈতিক সংকট, আন্তর্জাতিক চাপ, এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা। তাদের কার্যকলাপ সাধারণ মানুষের জীবনে আতঙ্ক এবং সংকট নিয়ে আসে এবং একটি জাতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক স্বৈরাচারী শাসককে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য তীব্র সমালোচনা এবং জনরোষের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199