জয়া’র জয়

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 5 Dec 2024

2590 বার পড়া হয়েছে

Shoes
তন্দ্রা চাকমা
তন্দ্রা চাকমা

জয়া চাকমার কথা প্রথম জানতে পারি সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। এরপর অনলাইন পত্রিকায় ওর সাক্ষাৎকার পড়ি। তখন জানতে পারি সে ফিফার বাংলাদেশ থেকে প্রথম নারী রেফারী। একে তো নারী তার উপর আদিবাসী নারী। তাই একজন আদিবাসী নারী হিসাবে তাকে নিয়ে লেখার অদম্য ইচ্ছে ছিলো আমার। সেই সুযোগটাও মিললো গত ১৬ই নভেম্বর । সেদিন ছিলো CHT Welfare Society কর্তৃক সাফজয়ী টিমের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন খেলোয়াড়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। ওখানে গিয়ে জানতে পারি রুপনা, ঋতুপর্ণা ও মণিকার সঙ্গে জয়াকেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে।

আমরা একটু আগে আগেই বেইলি রোডের পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছে দেখি তখন ও লোকজন তেমন এসে পৌঁছাইনি। তাই আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের উপদেষ্টার বাসভবনে গেলাম। এখানে বলে নেই উপদেষ্টার সহধর্মিণী আমার বন্ধু। তাই তাকে হ্যালো বলতে যাওয়া। ওখানে পৌঁছালে সবাই জয়ার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। আমি বসেছিলাম জয়ার পাশে। তখন জয়া ও আর সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প গুজব করে বের হওয়ার সময় তিন খেলোয়াড় রিতুপর্ণা, মণিকা ও রুপনার সঙ্গেও আমাদের দেখা ও পরিচয় হয়।  জয়ার সঙ্গে কথা বলার পর তাকে নিয়ে লেখার ইচ্ছেটা আমার মাথায় আবার আসে। কিন্তু তাড়াহুড়োতে জয়ার ফোন নাম্বার নেওয়া হয়নি। পরে মনে হলো মানবাধিকার কর্মী ইলিরার কাছে ফোন নাম্বার থাকতে পারে। পরে ইলিরার কাছ থেকে আমি জয়ার ফোন নাম্বার পাই।   
আর দেরি না করে ফোন দিলাম জয়াকে। ফেসবুক বন্ধু হলাম। এরপর জয়ার ব্যস্ত সময়ের মধ্যে দুদিন কথা বলে জয়াকে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম। এসব প্রশ্নের উত্তরে অনেক কিছু জেনে ছিলাম আর তার আত্মপ্রত্যয় আমাকে নাড়া দিয়েছিলো। সে শুধু নিজের কথা ভাবে না, সে সবার কথা ভাবে।
প্রাণের বাংলার এবারের প্রচ্ছদে জয়া চাকমাকে নিয়েই রইলো ‘জয়া’র জয়’।

জয়ার জন্ম ‌১৯৯২ সালে রাঙ্গামাটিতে। তাদের বাসা দক্ষিণ কালিন্দীপুরে। বাবা BADC তে চাকরী করতেন । মা একসময় এনজিও কর্মী ছিলেন।
জয়ার প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কাটে কবি অরুণ রায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর রাঙামাটি সরকারী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েন এবং সেখান থেকেই এস এস সি পাশ করেন। কলেজ জীবনের দু'বছর পার করেন রাঙামাটি সরকারী মহিলা কলেজে। এরপর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ইতিহাস নিয়ে। উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি সফলতার সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন জয়া। পরবর্তীতে স্কলারশীপ নিয়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয় নিয়ে পড়তে যান বাণারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ২০২০ সালে । ঠিক দুবছর পর ২০২২ সালে তিনি শারীরিক শিক্ষায় সফলতার সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি তার ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার ডিগ্রির জন্য গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। এ হলো জয়ার  শিক্ষা জীবন ।

আমার কৌতূহল বেশী ছিলো কি করে তিনি প্রথমে খেলোয়াড় ও কোচ হিসাবে নিয়োগ পেলেন । তাই জয়া আমার কৌতূহল নিবারণের জন্য আবার স্কুল জীবনে ফিরে গেলেন । তিনি  বললেন, আমি যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম তখন থেকেই খেলতে ভালবাসতাম স্কুলে খেলাধুলা হলে সব সময় নাম দিতাম এবং কিছু না কিছু পুরস্কার পেতাম । আমি সব ধরনের খেলাই খেলতাম যেমন, কারাতে, ব্যাডমিন্টন , টেবিল টেনিস, লং জাম্প ও ফুটবল । সেজন্য আমি একবার বিকেএস পিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম এবং এটলেথিক্স এ নির্বাচিত হই। কিন্তু ভর্তির ডেট ওভার হওয়ার কারণে আর ভর্তি হতে পারিনি ।তাছাড়া আমি যেহেতু গার্লস গাইড ছিলাম তাই সব ধরণের খেলা খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ২০০৫ সালের দিকে আন্তঃজেলা মহিলা ফুটবল প্রতিযোগিতা সারা বাংলাদেশে শুরু হয়  বাংলাদেশ মহিলা ক্রীড়া সংস্থার মাধ্যমে । রাঙ্গামাটি জেলা টিমের সদস্য হিসাবে আমিও নির্বাচিত হই এবং ঢাকায় খেলতে আসি । সেবার আমাদের রাঙ্গামাটি জেলা টিম অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয় । সেই ২০০৫ সালের আপরাজিত চ্যাম্পিয়ন টিমকেই ২০০৬ সালে ডাকা হয় জাতীয় দলের খেলোয়াড় নির্বাচন ক্যাম্পে । ক্যাম্প একবছর চলে । আমি জাতীয় দলে নির্বাচিত হই কিন্তু খেলা শুরুর দিকে আমার এস এস সি পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারনে আমি বাড়ি চলে যাই । ২০০৮ সালে জাতীয় দলে আবার ডাক পাই । তখন থেকে আমি ন্যাশনাল টিমে অন্তর্ভুক্ত হই  এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত খেলি ।এরপর একটা ইনজুরির কারণে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ে যাই। আমি জাতীয় দলে থাকা অবস্থায় রেফারী ও কোচ হওয়ার ট্রেনিং সম্পন্ন করি । জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর মন খারাপ হয়েছিলো , কারণ আমি ফুটবলকে তখন ভালবেসে ফেলেছি, তাই ফুটবলের সঙ্গে থাকার জন্য আমি রেফারী হওয়ার লাইনটা বেছে নেই । অবশেষে ২০১৩ সাল থেকে রেফারী  হয়ে ম্যাচ পরিচালনা শুরু করি। কিছুদিন পর আমি সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ার একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ পরিচালনার সুযোগ পাই । সেই ম্যাচে গিয়ে আমি জানতে পারি বাংলাদেশ থেকে ফিফার কোন রেফারী নেই । আমি বুঝতে পারি রেফারিং করলে আমি ফিফা রেফারী হতে পারবো। আমি যেহেতু জাতীয় দলে  ছিলাম এবং অনেক প্রশিক্ষণও পেয়েছি তাই আমার তো দেশকে কিছু দিবার আছে । এই দায়িত্ব বোধ আমাকে ফিফা রেফারী হতে প্রেরণা যোগায় । একবার শ্রীলঙ্কা গিয়ে দেখি অনেক ফিফা রেফারী এসেছে । সেখান থেকে জানতে পারি ফিফা রেফারী হতে হলে কি করতে হবে। রেফারী হিসাবে আমাকে অনেক অনুশীলন করতে হবে। আমার অনেকগুলো ধাপ পার হতে হবে ।এইজন্য রেফারী হিসাবে আমাকে অনেকগুলো প্রমোশনাল টেস্ট পরীক্ষা দিতে হয়েছে । সঙ্গে ফিটনেস টেস্টও দিতে হয়েছে । আমি ২০১৬ সালে ন্যাশনাল রেফারী ছিলাম , এরপর ২০১৭ সালে ফিফা রেফারী হওয়ার জন্য এলিজেবল হই । তারপরই ফিফা রেফারী হওয়ার পরীক্ষা দেই কিন্তু অসফল হই, একই ভাবে ২০১৮ সালেও বাদ পড়ি।তবে আমার চেস্টা চলতে থাকে এবং  ২০২০ সালে সফল হই । এর মেয়াদ ছিলো ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আমি ঠিক করেছি আমি আর এটা রিপিট করবো না। কারণ আমার শারীরিক সক্ষমতা কমেছে। আসলে একজন রেফারীকে খেলোয়াড়দের চাইতে বেশি Staminar অধিকারি হতে হয় কারন তাকে পুরো মাঠে দৌড়ুতে হয়, আর সেই সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়ে ম্যাচ পরিচালনা করতে হয়।

আমার প্রশ্ন ছিলো তিনি এরপর কি করবেন ? সে উত্তরে জয়া বললেন, আমি ২০১৬ সালে বি কে এস পি তে চাকরি পাই। বি কে এস পি তে তখন নারী প্রশিক্ষক খোজা হচ্ছিলো । আমি আবেদন করি আর আমার চাকরী হয়ে যায়। তাই আমি ওই চাকরীটাই করবো যতদিন পারি । আর ঐ কাজের মাধ্যমে আমি অনেক দক্ষ খেলোয়াড় তৈরি করতে পারবো।

“জয়া ২০১৫ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক ফুটবল উৎসবে ১০টি ম্যাচ পরিচালনা করেন। ২০১৯ সালে ঢাকায় সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের দুটি ম্যাচে রেফারিং করেন। ভারতের সুব্রত কাপে, নেপাল-ভুটান এমনকি এশিয়ার বাইরে ইউরোপে গিয়েও দায়িত্ব পালন করেছেন জয়া। লেভেল ৩, ২ ও ১ কোর্স শেষ করে বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের রেফারি হন। পরে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা রেফারি হওয়ার ফিটনেস টেস্টে উত্তীর্ণ হন।“ – তথ্যসুত্র উইকিপিডিয়া।

জয়ার সঙ্গে দুদিনের আলাপচারিতায় আমি জায়ার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি ভবিষ্যতে তিনি নিজের অবস্থান কোথায় দেখতে চা্ন ?  তিনি নিজের অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলো কোথায় ও কিভাবে কাজে লাগাতে চান ? জয়া আমাকে বললেন ,যেহেতু তিনি ফিফার রেফারীর কাজ করছেন এটা দেখে আরও অনেকে এটা অর্জন করুক। মানে ফিফার রেফারী হোক । উনার কাছ থেকে শিখে বা উনার  mentoring এর মাধ্যমে কোন নারী খেলোয়াড় যদি ফিফা রেফারী হতে পারে তাহলে উনার স্বপ্ন পূরণ হবে । সবাইতো আর জাতীয় দলের খেলোয়াড় হতে পারবে না, সরকার তো খেলোয়াড় তৈরির জন্য অনেক খরচ করে । খেলার মাধ্যমে যদি কেউ কোচ হয় বা রেফারী হয় তাহলে তিনি খুশী হবেন ।  

ভবিষ্যতে জয়া নিজেকে খেলোয়াড়দের মেন্টর হিসেবে দেখতে চান । তিনি অনেক অভিজ্ঞ মানুষদের সঙ্গে কাজ করেছেন ও উনাদের কাছ থেকে দেখেছে্ন। উনাদের কাজ দেখে তিনি মেন্টর হবার এনার্জি ও পাওয়ার অর্জন করেছেন মানে অভিজ্ঞ হয়েছে্ন । আর তদুপরি উনার   ছাত্রীরা উনার চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত। তিনি চেস্টা করেন সবচাইতে সেরাটা দিতে । জয়া আরও বললেন, “ আমি শুধু খেলা শেখাই না আমার ছাত্রীরা যাতে মানুষের মত মানুষ হয় এবং দেশের সম্পদে যাতে পরিণত হয় আমি সেই চেষ্টায় করে যাচ্ছি । “
জয়ার সঙ্গে দুইদিনের আলাপচারিতায় আমার ভালো লাগার বিষয় হোল জয়ার নিজের অদম্য ইচ্ছা শক্তি আর সবাই যে ধরনের চিন্তা করে সেখান থেকে বের হয়ে তিনি চিন্তা করেন। তিনি মুক্ত চিন্তার অধিকারী । তিনি নিজেকে গণ্ডির মাঝে রাখেনি। ব্যক্তি জয়ার লক্ষ্য সবসময় স্থির ছিলো তাই তিনি অনেক ধাপ পেরিয়ে ফিফা রেফারী হতে পেরেছিলেন । জয়ার  পেশাই নারী শক্তির বহিঃপ্রকাশ । আর এর সঙ্গে তার কথা আর কাজ সেটাকে অনেক উচ্চ মাত্রা দিয়েছে। আমি এবং আমার সঙ্গে আপনারাও নিশ্চয় মনে মনে চাইছেন জয়ার স্বপ্ন পুরণ হউক।

আমার এই লেখা যখন ফাইনাল করছিলাম তখন জয়া আমাকে খবর দেয় তিনি এখন দিল্লিতে আছেন এবং “কমলা ভাসিন স্পেশাল জুরি এ্যাওয়ার্ড-২০২৪” পেয়েছেন । এ এ্যাওয়ার্ডটি  আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৮ টি দেশের মধ্যে থেকে ৪ জন কে এই এ‍্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তার মধ‍্যে ০২ জন পায় স্পেশাল জুরি এ‍্যাওয়ার্ড। এই দুই জনের মধ্যে জয়া একজন ।

ছবিঃ গুগল, ইউএনডিপি

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199