শীত এক মায়া

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 7 Dec 2023

4535 বার পড়া হয়েছে

Shoes

গুটি গুটি পায়ে শীত এসে পড়েছে। জানালায় কান পেতে শুনি ঝরাপাতার কান্না। জলদি জলদি পড়ে আসছে বিকেলের আলো। টুকরো রোদ্দুর ছুঁয়ে দেয় বিকেলের চায়ের কাপ। আর মাত্র ক’দিন! শীতের চাদরে জড়োসড়ো হবে রোদ ভেজানো চিবুক। ধানের শীষে বইবে খামখেয়ালী বাতাস। ঘাসের গায়ে মাথা রাখবে শিশির। ভালোবাসার কাঙাল আমরা অসহ্য গরম থেকে রেহাই পেতে  শীতকে বড়ো নিজের করে পেতে চাই। শীতের গায়ে হেলান দিয়ে নষ্টালজিক হই। তাইতো শীত বড়ো আপন। শীত বড়ো প্রশ্রয়ের। এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে আসন্ন শীত নিয়ে রইলো ‘শীত এক মায়া’।

শিশির  স্নানের পর

সন্ধ্যা লাগার মুখে এক রহস্যের চাদর যেন কোনো অলৌকিক মায়ায় আকাশ থেকে নেমে আসতে থাকে ধরায়। কোমল শিশির পরশ ভিজিয়ে দেয় পৃথিবীও প্রান্তর। বুকের ভিতর এক খর পাটাতন ভিজতে থাকে আমারও।

লুৎফুল হোসেন, লেখক

ছোটো হয়ে আসতে থাকা কর্কটের ভ্যাপসা আর্দ্রতা আর কর্কশ গরমের দাপুটে দিন ফিরতি পথ ধরে চটচটে ত্বকের আস্তানা ছেড়ে। গ্রীষ্মকে হটাতে সময়ের সীমানা অতিক্রম করে সন্তর্পণ শীত দখল নিতে শুরু করে প্রহরের। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের পথ ধরে সে গোধূলির দিকে হাঁটতে থাকে কদম কদম; মাথার ভিতর আমার ডানা মেলতে থাকে চঞ্চল প্রজাপতি। মৃদুমন্দ হিমেল বাতাস যখন চুম্বনে প্রবল এলোমেলো করে দিতে থাকে, ভালোবাসা ছাড়া কীসের জন্যে আর আকাঙ্ক্ষারা জেগে থাকে তখন!

সাঁঝ গড়িয়ে রাত যতই চেপে বসতে থাকে, নাকে ভেসে আসে শিশির স্নাতবৃক্ষ-পত্র-পল্লবের এক আশ্চর্য সোঁদা সুবাস। দিন পেরুলে চাঁদের সখ্যে সেইখানে এসে মিশে খেজুর গাছে হাঁড়ি বসাবার ঘ্রাণ। সেই গন্ধ নাকে লেপটে থাকে নির্ঘুম ভোর অব্দি। ভোরতো নয় যেন কোন আয়েশি সম্রাজ্ঞীর ধীরতম লয়ে ঘুম ভাঙবার পরব। অমন প্রতি ভোরে স্মৃতিরা এক ছুটে চলে যায় নানা বাড়ির উঠোন কিনারে মাটির ঘর-বারান্দায়— সারি দিয়ে বসে থাকা তুতো ভাইবোনদের মিছিলে। মুখ থেকে চিমনির মতো ধোঁয়া বের করবার একটা প্রতিযোগিতা হতো রোজ। সেই আসর ভাঙতো ধোঁয়া ওঠা পিঠা জুড়িয়ে যাবার আগে ভাগে নাশতা খেয়ে নেবার জন্য মুরুব্বিদের তাড়ায়। মুখ ধুতে গিয়ে পুকুর ঘাটে আমরা তখন সবগুলো পুচকা- পুচকি একেক জন হয়ে উঠি বিশাল দার্শনিক। ধ্যানস্থ হয়ে দেখি — গোটা পুকুরটাকে যেন কেউ চুলায় চড়িয়ে দিয়েছে,  আর জলের শরীর থেকে রাগ লহরীর শুরুর মতো ধীর লয়ে নেচে নেচে উঠে যাচ্ছে বাষ্প- মেঘ। অমন 'কল্যাণ ঠাট'  উদাস সকালে রোজ বুকের ভিতর মেলে দিতো যে বিহ্বল বৈরাগ্যের কপাট। শীত আসতে শুরু করলে আজো তা কাঁপায়। হিমে নয়,  শৈশবের উৎসব স্মৃতিময় জীবনের গানে, তারুণ্যের ছায়া মেলে রক্তে জেগে ওঠা প্রেমে। অঘ্রাণের শেষ দিন গুলো আমার পৌষালি কুসুম উষ্ণ রোদের আগমন প্রহর প্রতীক্ষা, গোপন সঞ্চয়ে উষ্ণতার আধার, তারুণ্যের উন্মাতাল সময়ের তীব্রতম শিহরণ— শীত আগমনী মানেই আরাধনার খোলা চুল রোদে শুকাবার পর ঝরা পাতার ওড়া উড়ি শেষে ক্লান্ত সন্ধ্যা - বাতাস।

 

শীত আমার প্রেমিক হয়

শীত আমার প্রেমিক হয়। গরমের মতো ক্লান্তিকর দমবন্ধতায় আমি হাসফাস করতে করতে ভাবি শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা? আমি একটু দম ফেলতে চাই। গরমের ক্লান্তি থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়ে মুখ লুকাতে চাই কুকড়ে যাওয়া ঠাণ্ডায়। শীত বড়োই আলসে। তার আমাকে ক্লান্ত করে দেয়ার তাড়া নেই। ঘেমে শ্রান্ত অবসন্ন করে দেয়ার মতো শত্রুতা নেই। অলস উষ্ণতা আছে। মমতায় জড়িয়ে রাখার আহবান আছে। আমারও দেহেমনে প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা আত্মসমর্পণ করি। কিন্তু উপায় নেই। আমার রয়েছে কর্ম।

রুমা মোদক
শিক্ষক, লেখক

কর্মের ডাকে, জগত সংসারের আহবানে আমার তুমুল প্রার্থিত প্রেমিকের বাহুডোর ঠেলে বেরিয়ে পড়তে হয়। শীত আমার প্রেমিক হয়। আমি প্রানপণে তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই অথচ বাইরের কর্মজগতের সঙ্গে তার জন্মের বৈরিতা।

শীতের মাঝে নস্টালজিয়া থাকে। উষ্ণতার আরাম অগ্রাহ্য করে রাত জেগে ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতির নস্টালজিয়া। পরীক্ষা শেষে মামারবাড়ির স্বাধীন দেশে যেমন ইচ্ছে চলার স্বাধীনতার নস্টালজিয়া,নতুন ক্লাসে নতুন বইয়ের নস্টালজিয়া। মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন তো কেবল নস্টালজিয়ার সুখে নাক ডুবিয়ে থাকার জীবন। এর চেয়ে বড় কোন আনন্দের সন্ধান এখনো পায়নি মানুষ।

শীততো উৎসবের কাল। পৌষ পার্বণ থেকে শুরু করে ব্যক্তি কিংবা সামাজিক নানা উৎসবের। আমাদের এই ষড় ঋতুর দেশটায় ক্রমেই দুই ঋতুতে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার বেদনাক্লিষ্ট মানুষ অপেক্ষায় থাকে শীতের। স্বল্পায়ু শীত, এসেই বলে যাই। তবু একে ঘিরে কতো পরিকল্পনা, অপেক্ষা আর কাব্যযাপন।অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহরে শীত বড়োই ক্ষুদ্রায়তন। তবু এই স্বল্প সময়ে স্বল্প আয়ের মানুষের ভোগান্তির অন্ত নেই। যে শীতের জন্য অপার অপেক্ষা আমাদের সে শীতেই একটু গরম কাপড়ের জন্য একটু উষ্ণ আশ্রয়ের জন্য কী আকুতি তাদের।

যখন খুব কাছে থেকে তাদের আকুতি দেখি তখন আমার বিপ্রতীপ আকুতি অপরাধী হয়ে যায়। তবু প্রাকৃতিক নিয়মে শীত আসে। আমি শীতের অপেক্ষায় গ্রীষ্ম কাটাই। শীত আমার প্রেমিক হয়। তাকে কাছে পাবার আকুল আকাঙ্ক্ষা আমার বারবার টুটে যায় জগত সংসারের ডাকে।

 

কে কোথায় কুয়াশায় হারিয়ে যায়

অক্টোবরের শেষাশেষি এখানে শীত পড়তে আরম্ভ করে। দিন গড়িয়ে বিকেল নামলে দেখা যায়, দূরে গাছগাছালির গায়ে ধূসর একটা ধোঁয়ার আস্তরণ। জনবসতির গায়েও তেমনই একটা ধূসর ধোঁয়ার চাদর। পাথুরে নদীর ডাঙায় যেসব গাছ, তারা পাতা খসাতে আরম্ভ করেছে। তাদের বাকলে চলটা উঠে উঠে ভেতরের সাদা রঙ বেরিয়ে পড়েছে। সেই সাদা রঙকে মনে হয় লম্বা লম্বা সব ডোরাকাটা দাগ। সন্ধ্যের হাওয়ায় কেমন একটা রুক্ষ পোড়া কাঠকয়লার গন্ধ পাওয়া যায়।

অমিতরূপ চক্রবর্তী,
লেখক, পশ্চিমবঙ্গ থেকে

দীপাবলি উপলক্ষ্যে এই আধা গঞ্জ এলাকায় বেশ বড়ো একটা মেলা বসে। এই মেলার সূত্রপাত স্বাধীনতার অনেক আগে। সেই ১৯১৮ সালে। চা বাগান ঘেরা এই অঞ্চলে সেসময় আমোদপ্রমোদের কোনো উৎসই ছিল না। এই মেলাই ছিলো আমোদপ্রমোদের উৎস। চারপাশের চা বাগান থেকে মাইলকে মাইল পথ পায়ে হেঁটে লোকজনেরা আসতো এই মেলায়। সারা রাত মেলায় কাটিয়ে ভোর ভোর ফিরে যেত ঘরে। এখনো এই মেলা বসে। গত দু’বছর অবশ্য অতিমারীর কারণে বন্ধ ছিলো।

এই মেলা চলে ১২ দিন।  মেলা শেষ মানেই পাখনা বিস্তার করে শীতের শুরু। সেই অর্থে এই মেলাকে আমার এখানে শীতের গেটওয়ে বলা যায়। মেলা শেষ, উৎসব উল্লাস হর্ষধ্বনি শেষ, ভারী জমাট শীত এসে যেন এই এলাকায় চেপে বসে। আধুলির মতো দিন কখন গড়াতে গড়াতে টুক করে ফুরিয়ে যায়, সন্ধ্যে হতে না হতেই চারপাশে কেমন একটা নির্জনতা নামে। হঠাৎ কাঙাল হয়ে যাওয়া বাজারে সাদা সাদা বিজলি বাতি জ্বলে। চাইনিজ খাবারের দোকানগুলোয় খাবার ভাঁপানোর বাসনপত্রের চিপি দিয়ে সোঁ সোঁ শব্দে স্টিমের ধোঁয়া ওড়ে। মূল বাজারটা থেকে অক্টোপাসের শূঁড়ের মতো চতুর্দিকে রাস্তা ছড়িয়ে আছে। তার যে কোনো একটি রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলেই দোকান-পসরা শেষ। শীতের ভারী অন্ধকারের শুরু। বাজার ছাড়িয়ে নদীর দিকে যে রাস্তা হাসিমারা, জয়গাঁর দিকে গেছে, সেই রাস্তা ধরে হেঁটে অন্ধকারে ঢাকা ব্রিজের অ্যাপ্রোচে দাঁড়ালে উত্তরে ভুটান পাহাড়ের ক্ষুদে ক্ষুদে লাল বা মেটে রঙের আলোর বিন্দুগুলি দেখা যায়।

ছেলেবেলায় দেখতাম শীতের আসছি আসছি করা শুরু হতেই কোনো রোদোজ্জ্বল দিনে সম্বৎসর দেয়ালে গায়ে গা লাগিয়ে উঁচু মাথার কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে ফেলা হতো। আলমারির পাল্লা খোলা যে কী উৎসাহের আর রোমাঞ্চের ছিলো! মনে আছে আলমারি খোলার সময় মাসির গায়ে লেপ্টে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মাসি আলমারি থেকে টেনে টেনে নামাতো উলের সোয়েটার, লাল-নীল ছাপ দেওয়া চাদর, শাল, লেপের ওয়ার। আলমারির ভেতর থেকে কাঠ আর ঠাসিয়ে রাখা জামাকাপড়ের মিলিত একটা ভ্যাপসা গন্ধ আসতো। এইভাবে শীতের পোশাক-আষাক বের করার সময় হঠাৎ ঝট করে বেরিয়ে পড়তো আমারই কোনো ভুলে যাওয়া শার্ট বা মোটা কাপড়ের বড়োদের কোনো প্যান্ট, যেটা সেসময় দিব্যি আমি পরতে পারবো বা এইরকম পোলো গলার ভেস্ট। আলমারির একেবারে নীচের তলায় ভাঁজ করে রাখা থাকতো দিদিমার নিজের হাতে তৈরি অসংখ্য কাঁথা। ক্ষুদে ক্ষুদে ফোঁড়ে তার চারদিকে চওড়া কল্কা, মাঝখানে ফুল। কখনো সুতোর রঙ বদলে একপ্রস্থ একপ্রস্থ সেলাই। বরাবর দেখেছি দিদিমার দারুণ বাতিক ছিলো এই কাঁথা তৈরির ব্যাপারে এবং তাঁর সেলাইয়ের হাতও ছিলো নিপুণ। সেই কাঁথাগুলো ব্যবহার হতো না বলে বছরের পর বছর একইভাবে ঠাসা থাকতো আর ওইভাবে ঠাসা থাকতে থাকতে ভাঁজের কোনায় ধুলো আর কাঠের গুঁড়োর মরিচা ধরতো। একবার পেলাম একটা হাত-কাটা কোটের ভেতরে যে ওয়েস্টকোট পরে- সেরকম একটি জামা। সেই জামাটি বোধহয় কিনেছিলো আমার ছোটমামা এবং তাকে বাতিল করেছিলো। সেই ওয়েস্ট কোট মার্কা জামা পেয়ে এবং তার ভোগের স্বত্ব পেয়ে সে আমার কী আনন্দ!

শীতের প্রসঙ্গ উঠলে আমার ছোটবেলার মাঠে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা কতগুলি খেজুরগাছের কথা মনে পড়ে। মাঠটি ছিলো পাড়ার অঞ্জলিমাসীদদের। সেই মাঠের সীমানায় ছিলো বাসকপাতার ঝোপ আর ট্যাঁরাব্যাঁকা বাতাবিলেবুর গাছ। খেজুরগাছগুলি ছিলো ভেতরের দিকে। সারা গায়ে কুমিরের আঁশ। পাতাগুলো চারপাশে হেলেদুলে ছড়িয়ে থাকতো। কয়েকটা ডাল একেবারে পাতাসুদ্ধ হলুদ হয়ে ঝুলতো। সেই মাঠে ধুনকরেরা এসে পুরোনো তুলো ধুনাই করে নতুন তুলো মিশিয়ে শীত পাড়ি দেবার জন্য তৈরি করে দিতো লেপ, মাথার বালিশ। তুলো যখন ধুনাই করতো, ঢ্যাঁয়াও ঢ্যাঁয়াও করে তুলো ধুনাইয়ের যন্ত্রের শব্দ হতো সারাদিন। দিন গড়িয়ে যেতো। দুপুরে খাবার পরেই শীত লাগা আরম্ভ হতো। লেপ টেনে যখন ঠাণ্ডা পা গরম করার জন্য চেষ্টা করছি, শুনতাম মাসি তারের কাপড় টেনে তুলতে তুলতে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। মুখোমুখি বাড়িটা থেকে পুরুষালি গলায় কে যেন কাকে ধমক দিচ্ছে। কখনো এইসব ছাপিয়ে কানে আসতো দূরগামী ট্রেনের হুইশিল। কেমন যেন মনে হতো, এই শব্দ বা দৃশ্যাবলীর সীমানা অবধিই পৃথিবীর যা কিছু। তার বাইরে আর নেই।

কেন জানি না, শীতে আমার বিষাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। কোনো কোনো দিন এমনও হয়, সারাদিন কিছুই ভাল লাগছে না। কোনো কোনো দিন ঘুম থেকে দেখি ভূতুড়ে কুয়াশা চতুর্দিক ঝাপসা করে রেখেছে। মাথার ওপরে আকাশ ততোধিক ধূসর। সেই ধূসর কুয়াশার মধ্যে একটিই মেঠোপথ যেন দেখা যায় শুধু। এঁকেবেঁকে সেই মেঠোপথ বহুদূর গিয়েছে। সেই পথে আবছা কয়েকজন হেঁটে যাচ্ছে। কারা তারা? তারা হয়তো সেইসব নিকটাত্মীয়, বন্ধু বা কখনো ভাললাগার মানুষ- যাদের সঙ্গে আজীবন আর কোনোদিন সাক্ষাৎ হবে না।

প্রতিবার শীত আসে। গাঢ় ধূসর কুয়াশা পড়ে আর ওই মেঠোপথের ঝাপসা মূর্তিগুলোর সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে।

 শীতে শান্তির পরশ

শীতে ঘনো কুয়াশা নেমে আসে গাছের পাতায়, ঘাসে,  শিশির বিন্দু জমা হয় পাতায় পাতায়। দেখে মানুষের মন ভরে ওঠে। শীতের সময় বৃষ্টি হয়না বললেই চলে। শীতে রাত বড়ো হয় দিন হয় ছোট। দেশে তখন বয়ে যায় উত্তরের ঠান্ডা হাওয়া। এসময় মানুষ আনন্দ পায় বনভোজন এবং আনন্দ ভ্রমণ করে। শীতের সবচাইতে মজার খাবার খেজুরের রস। যদিও খেজুর গাছের সংখ্যা গ্রামগঞ্জে এখন অনেক কমে আসছে। এ সময় শীতের অতিথি পাখির  আগমন হয় আমাদের দেশে  চিড়িয়াখানার জলাশয়ে এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরে।

ভোলানাথ পোদ্দার
(অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার)

ছোট বেলায় মায়ের আচল ধরে শীতের অপেক্ষা করতাম। শীত এলে মায়ের প্রথম কাজ ছিলো পিঠা পুলি তৈরী করা। মা যে পিঠা তৈরী করতো তার মধ্যে ছিলো সরা  পিঠা, কলার বড়া পিঠা, চান্দোশা পিঠা ইত্যাদি। পিঠাগুলি ছোট সময় মায়ের হাতেই খেয়েছি, তারপর আর সেভাবে খেতে পারিনি। আরো আকর্ষণীয় ছিলো খেজুরের গুড়ের পায়েস। মনে হতো এ পায়েস তৈরী হয়েছে মধু মিশ্রণ করে।   বাড়িতে দেখেছি শীত এলেই মা  লেপ নিয়ে রোদে দিয়েছে । কম্বল ট্রাংক থেকে বের করছে। চারদিকে  শীতের সাজ সাজ রব।আমরা মজা কর

লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমাতাম। এখন যে ঘুমুইনা তা নয়, তবে ছোট বেলায় মাকে দেখলেই মনে শান্তি নেমে আসতো। শীত যেনো শীত মনে হতোনা।

শীত নিয়ে গ্রামের বয়স্ক রাখুব ভয় পেতো। এক শীত গেলেই তারা ভাবতো তাদের আর একটা বছর বেঁচে থাকা হলো। শীত নিয়ে সেভাবে কেউ ভাবেনা এখন । শহরে শীতের সময় নেমে আসে উৎসবের আমেজ, ঘরে ঘরে অনেক আইটেম রান্না করা হয়, পিকনিক করা হয় এবং আনন্দ ভ্রমণ করা হয়। শীতে সাগর থাকে শান্ত তাই অনেকে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটে যায় সাগর পাড়ে।

ছেলে বেলার একটা ঘটনা এখনো আমার মনে পড়ে, তখন আমি স্কুলে পড়তাম। ঢাকা থেকে গ্রামে গিয়েছে এক মেয়ে ও তার ভাই, আটসাট শীতের পোশাক পরে। আমাদের গেট থেকে নামতে গিয়ে মেয়েটি তার হাই হিল স্যান্ডেলে স্লিপ কেটে একদম খালের ঠান্ডা জলে গিয়ে পড়লো। আর উঠতে পারছেনা!

তার ভাই ও নেমে যেতে ভয় পাচ্ছে। তখন আমাদের গ্রামের এক যুবক শীতের ঠান্ডা জলে নেমে তাকে উপরে নিয়ে এলো। ভিজে জুবুথুবু অবস্থা। মেয়েটি যুবকটি কে একটুও কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে বরং চিৎকার করে বললো ‘খাল একটু ভালো করে কাটতে পারেন না’। আমরা সবাই হেসেছিলাম মেয়েটি আরও বিরক্ত হয়ে গেলো।

অনেক বিদেশি লেখক শীতকালকে নিয়ে বিভিন্ন ভাবে মূল্যায়ন করেছে, টম এলেন লেখেন ‘ শীত আমাদের চরিত্র গঠন করে এবং আমাদের সেরাটি বের করে আনে’। অনামিকা মিশরা লেখেন, ‘শীত মৌসুম নয়, এটি একটি উদযাপন’।

শীত নিয়ে যে যেমন লেখুক আমাদের মূল্যায়ন হচ্ছে শীতকাল আমাদের ক্লান্ত না করে কর্মঠ করে তোলে।

 

শীত এসে গেল

‘শীত এসে গেল’ তার মানে আমাদের সূর্যিমামার রাগ পড়ে গেছে, তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, তার তেজ কমে এসেছে। শীতের এই আমেজ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে অনুভূত হয়। মজার ব্যাপার হলো, পৃথিবী থেকে চারশো কিলোমিটার উপরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যেসব নভোচারী আছেন তাদের কাছে শীত ঋতু পৃথিবীর আদলে ধরা দেয় না। কারণ, তাদের বসবাস দূর মহাশূন্যের এক ভিন্ন আবহে।

মেহেরুন্নেছা শিক্ষক, লেখক

শীত এসে গেলে প্রকৃতি তার ক্রোধ হারিয়ে ধীরে ধীরে নীরবতায় অবগাহন করবে; সবুজ হারিয়ে রুক্ষ মূর্তি ধারণ করবে। উত্তর গোলার্ধের এই বাংলা মুড়ে থাকবে মিঠাকড়া রোদের আভরণে। আহা আদুরে শীত! তুই নিয়ে এলি পিঠাপুলির উৎসব! পাতা ঝরার উৎসব! শুধু কি তাই? কৃষক মাঠে যাবে ভোরের শুভ্র কুয়াশার চাদর ভেদ করে। কিশোরী কোমল পায়ে মাড়িয়ে যাবে ঘাসের ডগায় সজ্জিত ফোঁটা ফোঁটা শিশির। রাতভর গাছের পাতায় জমতে থাকবে যে শিশির, ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই তা টিনের চালে বৃষ্টির  মতো ঝরতে থাকবে। ধানক্ষেত-শাকসব্জির উপর টলমলে শিশির বিন্দুতে সূর্যের সোনালি রশ্মিকে মনে হবে রাশি রাশি ঝলমলে মুক্তো। কখনো দিগন্তজোড়া মাঠের শেষপ্রান্তে ঘন কুয়াশার স্তরকে মনে হবে সায় দাঁড়িয়ে থাকা শ্বেত পাহাড়ের সারি। আসলে শীত যেন হলুদের বার্তা বহনকারী, মৌমাছির গুঞ্জন সৃষ্টিকারী, প্রকৃতিকে রঙে রঙে রাঙিয়ে তোলার এক বাহারি ঋতু! সরিষা, গাঁদা, সুর্যমুখির হলদে কাব্য যেন কবি হৃদয়ে ঝড় তোলে। আর নুইয়ে পড়া মটরশুঁটি শুধুই জড়িয়ে ধরতে চায় কবির পদযুগল। কনকনে শীত থেকে রেহাই পেতে নগরে-গ্রামে সর্বত্র দেখা যায় জ্যাকেট, মাফলার, সোয়েটারসহ সাজপোশাকের বৈচিত্র্য। দাপুটে শীতের আরেক প্রভাব হলো ঠোঁট ও পা ফেটে যাওয়া। ফলে প্রসাধনীর কদর বাড়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ে যায় শিক্ষাসফরের হিড়িক। লেপের নিচে চলে আধুনিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত কিংবা আসক্ত মানুষগুলোর মোবাইল ঘাটাঘাটি। মূলত শীতের সূচনা ঘটে হেমন্তে যখন মৃদুলয়ে উত্তরীয় হাওয়া বইতে শুরু করে। জমিতে ধান কাটা শুরু হয়। বাতাসে মেলে নবান্নের গন্ধ। খেজুর রসের পায়েসের মিষ্টি ঘ্রাণে মৌ মৌ করে গ্রামের বাড়িগুলো।

প্রিয় পাঠক, এই শীত বন্দনার উপজীব্যতা কাদের জন্য জানেন? কারা সেই সৌভাগ্যবান যারা শীত আসলেই নিজেদের জীবনে বইয়ে দেয় আনন্দের ফল্গুধারা? এর উত্তরটা আমাদের সবার জানা। তবুও বলবো, এইসব সামর্থবানদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে অবশ্যই বর্তায় ব্রাত্যজনদের শীতের কষ্ট অনুভব করা। হয়তো এই সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর কথা ভেবেই কবি সুকান্ত লিখেছেন,

‘হে সূর্য!/ শীতের সূর্য

তুমি আমাদের স্যাঁত স্যাঁতে ভিজে ঘরে/উত্তাপ আর আলো দিও,

আর উত্তাপ দিও/ রাস্তার ধারের ওই উলঙ্গ ছেলেটাকে।’

জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় শীতের অনুভূতি লিখতে গিয়ে ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে। ভাবছি কত সংক্ষিপ্ত এই জীবন! বলতে পারেন এই নীল গ্রহটিতে একটা মানুষ কতটা শীতকাল কাটিয়ে পরপারে যাত্রা করে? আমার কাছে শীত মানে আমার মৃত বাবার হিমশীতল শরীরের স্পর্শের বেদনার সঙ্গীত। গত শীতে আব্বা বেঁচেছিলেন অথচ আজ তিনি পৃথিবীর বুকে নেই! শীতের সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর বয়োবৃদ্ধ দাদু-নানুর মাটির হাঁড়ির গনগনে কয়লায় আগুন পোহানোর দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। তখন ঘরের কোনায় ওজুর বদনায় দেয়া হতো দাদা-নানার জন্য গরম পানি। তাঁরা সবাই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন বহু আগেই। তবে কি মৃত্যু আছে বলেই বোধসম্পন্ন মানুষকে জীবনভর বিষন্নতা ঘিরে রাখে?

 

শীত মানে পাতা ঝরা মৌসুম

 

শ্বেতা চট্টোপাধ্যায় শিক্ষক,
লেখক, পশ্চিমবঙ্গ থেকে

দুর্গা ঠাকুর চলে যাবার পর যেমন খারাপের চিনচিনে অনুভূতি বুকের ভেতর তিরতির করে বইতে থাকে, তারই অনুষঙ্গে হাজির হয় কার্তিক মাস। কবি বলেছেন, 'আবার আসিব ফিরে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে..।' চুপিসারে বড় বেলার দৈর্ঘ্য 'ছোট' হয়ে যাওয়া..। দুপুরে খাওয়ার পর্ব শেষ হতে না হতেই হালকা এক শিরশিরে অনুভূতি, দিনের শেষ মুহূর্তে সূয্যি মামার কমলা রঙের আভা মাখিয়ে টুক করে ডুবে যাওয়া, এই সবই নিঃশব্দে সূচনা করে তার আগমনের। শরীরের চামড়ায় টান, ঠোঁটের ব্যক্তিগত রক্তপাত আর ভেতরে ভেতরে আরও একটা পাতা ঝরা মৌসুমের ঢোকা। এইসব মিলিয়েই ‘শীতকাল’ এসে গেলো । ' একরাশ উৎসবের আলো ঝলমলে রোশনাই হঠাৎ করে থেমে যাওয়ার পর সেই শূন্যতাকে আমরা পুনরায় ঢাকতে চাই মায়ের আরেক রূপের আবাহন দিয়ে। তাই কার্তিকের এই নিঃশব্দ পদচরণের সঙ্গেই জোড় বেঁধে আসে শীতকাল। প্রকৃতির নিজেকে নিজের রূপ, রস, বর্ণ, গন্ধ, গুনে সুসজ্জিত করে তোলার মরশুম। কারো কারো কাছে তা ভীষণ ভাবে 'অপেক্ষার ফল' আবার কারো কারোর কাছে তা 'মন খারাপের মরশুম'। মানুষের মধ্যে এই প্রকৃতিগত দৈন্যতা অনেকটাই প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। আসলে,  সহজে কোন কিছুতেই খুশিনা হওয়া মনুষ্য প্রকৃতি আসলে নিজেই বোঝেনা নিজে কি চায়। তাই এই রূপান্তর নিস্তব্ধ ও নিশ্চিদ্র হলেও শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া ফিরে পাওয়ার মায়াও জড়িয়ে থাকে খানিক। প্রকৃতি ও মানুষের এই রূপ বদলের গতি খানিক শ্লথ, কিন্তু দৃঢ় ছাপ রেখে যায় বলা যেতে পারে। এটা একটা জার্নিও বলা যেতে পারে। সন্ধ্যের রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে একটা ঝিম ধরানো গন্ধ লাগে নাকে।  কারো কারো কাছে তা প্রেমের অনুসর্গ আবার কারোর কাছে তা ভাঙ্গা গড়ার স্মৃতি। ঝুমকো,

ছাতিমফুল এভাবেই হেমন্তের প্রতীক হয়ে থেকে যায় শীতকাল আসার মরশুমে..। শুধুকি তাই ?   আকাশ পানে তাকালেও এই সময় বুকের ভিতর বেজে ওঠে অন্যএক 'সুর'।দূরের আকাশে জ্বলা আকাশ প্রদীপ এই সময় অন্য কারোর অস্তিত্বের কথা মনে করায়।পূর্ব পুরুষ থেকে উত্তর পুরুষের এই অবরোহন যে নিজে অস্তিত্বের কথাই প্রমাণ করে, তার চিহ্ন হিসেবেই মানুষ আকাশ প্রদীপ জ্বালায়। দীপাবলীর আগের রাতে অমানিশার ঘোরও অশুভ শক্তির বিনাশে বাড়িও তার আশে পাশে সেজে ওঠে স্নিগ্ধ প্রদীপের শিখায়।ভালোবাসার মানুষের মুখে সেই আলোক জ্যোতির বিচ্ছুরণে তার মুখের বদল হয় এ  আমাদের বিশ্বাস। দহনে শুদ্ধ হয় ভালোবাসার পরাগ। এইসব কিছুকেই হেমন্তের আগমনের বার্তা ছাড়া আর কিইবা বলা যায় ?

সন্ধ্যেবেলা পাখিদের ঘরে ফেরার গান আর নতুন ধান তোলার পর তার রিক্ত বুকে জমে থাকা কুয়াশার আস্তরণ চুপিসারে জানান দেয় শীতের আগমন বার্তা। বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমে থাকা অভিমান,  আর অনেক আলোর মাঝে অন্ধকারকে ভালোবেসে ফেলা কোন মন যখন চুপিসারে ভিড়ের মাঝে একা হতে চায়, হেমন্তের হিম তাকে শীতল আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে। অভিমানে গলা ব্যথা আর জ্বর সঙ্গী হয় তার। আমরা তাকে ভালোবেসে 'ঋতু পরিবর্তন' নামে ডাকি।

শীত আসার মুখে প্রকৃতি ও সাজায় নিজেকে।সবুজ পাতার খামের ভিতর হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে।রঙিন উজ্জ্বল ফুলের মৌসুম এই শীতকাল।উজ্জ্বল গাঁদা, রক্ত বর্ণ গোলাপ আর বাহারি চন্দ্র মল্লিকা, ডালিয়ায় সেজে ওঠার মরশুম। ফুলফল সবুজ শাক সবজি শীতকাল নিজস্ব বৈশিষ্টে অনন্য।

সকালের ঘাসের আগায় টলটলে মুক্ত  দানার মত শিশির বিন্দু বেলা ফুরোলে অন্তর্হিত হয়ে যায় মিঠে রোদে। সেই আবেশ মেখে মন চলে যায় সুদূর পানে।ন্যাপথলিন  দেওয়া গরম জামার ভাঁজে লুকিয়ে রাখা স্মৃতিরা হঠাৎ করে রোদেলা আদর মাখতে বেরিয়ে পড়ে। আসন্ন শীতের মুখে বন্ধ ডায়েরির পাতা খুলে বেরিয়ে আসে মুহুর্তরা, তাদের কোনোটা রঙিন আর কোনটা ধূসর বর্ণ। এসব মিলিয়ে আমাদের হেমন্ত, শীতের নিস্তব্ধ আগমনবার্তা..। শীতকাল আসলে এক অসম্ভব স্পর্শকাতর সময়। এ সময় সামান্য জখমও বুকের ভিতর পর্যন্ত প্রবেশ করে। মনও শরীরে লুকিয়ে রাখা 'ক্ষত'রা সামান্য আঘাতেই রক্ত পাতে স্নাত হয়। তখন তাদের লুকোতেই বেশি করে প্রয়োজন পড়ে বোরোলিনের... তা সে যতই রূপক অর্থে হোকনা কেন ! কবিতাই বলছে ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা ?’ অর্থাৎ রঙে – রসে -রূপে পল্লবিত হতে এবং প্রকৃতিতে শীতল কিন্তু শরীরে মনে উষ্ণ স্পর্শের কাঙাল যে আমরা সকলেই তা প্রতিবার বোঝা যায় কার্তিকের হিমেল সময় এলে। তারই পূর্ব প্রস্তুতি শুরু হয় দীপাবলির প্রদীপের ওম এ....।

ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199