পেঁয়াজের পিঁয়াজী

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 21 Nov 2019

1360 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শিব্রাম চক্কোত্তি, মানে বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য হাসির ফোয়ারা শিবরাম চক্রবর্তী হলে বলতেন, পেঁয়াজের পিঁয়াজী অথবা পেঁয়াজ নিয়ে পিঁয়াজী। পীঁয়াজী। বলতে পারতেন, প্যাঁচের পেঁয়াজ। পিঁয়াজী কথাটার মানে কী? সে তো ডাল সহযোগে পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি এক ধরণের সুস্বাদু বড়া। যাকে আমরা চালু কথায় বলি, পেঁয়াজু। তেলে ছেড়ে দিয়ে গরম গরম ভেজে তুললে চেটেপুটে খালাস করতে বেশি সময় লাগে না এই খাদ্যটিকে। অনেকে বেশি মাতব্বরি করার বিষয়টাকে পেঁয়াজী করা বলে থাকেন।কিন্তু এখন তো আমাদের মুখরোচক পেঁয়াজুর পেঁয়াজ নিজেই এত উত্তপ্ত যে তাকে ডাল দিয়ে মেখে অথবা তরকারিতে ফেলে চুলায় চাপানো অসম্ভব। এখন ঝাঁঝ টাঝ বলে লাভ নেই, বলা যেতে পারে পেঁয়াজের আগুনে পুড়ছে এই স্বদেশভূমি। খুন হওয়ার চাইতেও এখন পেঁয়াজ খাওয়া কঠিন কাজ। পেঁয়াজ নিয়ে এই খুনোখুনির মতো একটা ব্যাপার অথবা খুনে পেঁযাজের পাল্লায় পড়ে জেরবার জীবন তার পেছনে কারণের অন্ত নেই। কিন্তু পেঁয়াজ নিয়ে যে আমাদের বুকে কারবালা ময়দানের চাইতেও বেশি শোকের ঝড় বয়ে যাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফেইসবুকের পাতায় নজর রাখলেই সেই মাতম শোনা যায়, ‘হায় পেঁয়াজ, হায় পেঁয়াজ...।

পেঁয়াজ নিয়ে কথার ফুলঝুড়ি থাক।পেঁয়াজের প্যাঁচ খোঁজাও বাদ দিই। বেশি পেঁয়াজী করতে গেলে লেখকের জীবনও নিলামে উঠতে পারে। কিন্তু পেঁয়াজ নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে এই পেঁয়াজ বাবাজী বহু আগে থেকেই মহা গুরুত্বপূর্ণ এক মশলা হয়ে আসন দখল করে আছে। দুনিয়ার আর বাকি দেশ বাদ দিলাম এক জার্মানিতেই নাকি বছরে ৩ লক্ষ টন পেঁয়াজ ঢুকে পড়ে সেখানকার মানুষের পাকস্থলীতে। অবশ্য আমাদের এই বঙ্গ দেশের হিসাবটা ঝট করে পেলাম না। পড়তে গিয়ে দেখা গেলো ইতিহাসেও পেঁয়াজের অবস্থান বেশ সুদৃঢ়। এখন থেকে মাত্র হাজার পাঁচেক বছর আগে প্রাচীন মিশরে পেঁয়াজ ছিলো অপরিহার্য সবজি। এমনকি তারা তাদের দেবতাদের জন্য উপহার সামগ্রীর মধ্যে পেঁয়াজও দিতো। সাংঘাতিক ব্যাপার! পেঁয়াজের পিয়াজীঁর চল তখন থেকেই ছিলো। তারা মনে করতো পেঁয়াজের একটা রহস্যময় শক্তি আছে।

পেঁয়াজ নিয়ে চারপাশে যে মহা শোরগোল চলছে তা নিয়েই এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে রইলো ‘পেঁয়াজের পিঁয়াজী’।

প্রত্নতাত্ত্বিকরা সম্প্রতি একটি প্রাচীন মিশরীয় সমাধি খনন করে দেখেছেন   ৩,০০০ হাজার বছরের পুরনো সেই পেঁয়াজ সমাধির তলদেশে তাজা রয়ে গেছে। বলা হয় যে মিশরীয় ক্রীতদাসরা যখন পিরামিড তৈরি করেছিল, তখন তাদের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে পেঁয়াজ ছিলো, এবং যখন তারা তৃষ্ণার্ত বা ক্লান্ত হয়ে পড়তো তখন তারা তাদের শক্তি ফিরে পেতে পেঁয়াজ ভক্ষণ করতেন। ১৩  শতাব্দীতে ক্রুসেডের সময় সেনা বাহিনীর মধ্যে এই পেঁয়াজ ভক্ষণের চল ছিলো। এসব পড়ে মনে হলো পেঁয়াজের মধ্যে বেশ একটা ভৌতিক আর রহস্যময় ব্যাপার আছে। ফরাসীদের খাদ্যতালিকায় সাদা ওয়াইনের সঙ্গে পেঁয়াজ খাওয়ার চল আছে। তাদের তৈরি পেঁয়াজের সস নামক খাদ্যের সহযোগী পদার্থটি জগৎসভায় বেশ নাম করেছে। জার্মানির একজন সম্রাট পেঁয়াজ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। তিনি নাকি বলেছিলেন, যেদিন তিনি পেঁয়াজ খান না সে গোটা দিন তার মেজাজ খারাপ থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে মধ্যযুগে পেঁয়াজ বেশ মূল্যবান হয়ে ওঠে। তখন বিয়েতেও পেঁয়াজ উপহার দেয়া হতো।

গ্রিক ও রোমানদের সভ্যতায় পেঁয়াজ খাওয়ার প্রচলন ছিলো ভালোভাবেই। মেরিলিন মনরো পেঁয়াজ খেতেন কি না সে তথ্য জানা না গেলেও প্রাচীন রোমের এক বিখ্যাত খাদ্যরসিক এপিসিয়াসের লেখায় প্রথম পেঁয়াজের উল্লেখ পাওয়া যায়। একদা রোমের অভিজাত মানুষদের খাবারের তালিকায় এই পেঁয়াজ হাজির হতো নিত্যদিনের সবজি হিসেবে।

গ্রিক চিকিৎসক পেডানিয়াস পেঁয়াজের রস ব্যবহার করে ওষুধ তৈরি করতেন বলে শোনা যায়।এতেই বোঝা যায় হালকা গোলাপী মোড়কে জড়ানো এই মশলাটি শুধু বাঙালির রান্নাঘরে নয় সভ্যতার নানান স্তরেই নিজের গুরুত্ব প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলো। তাহলে আর আমাদের দোষ কোথায় পেঁয়াজকে অমূল্য হতে দেখে হাহাকার করায়?

পেঁয়াজের চাষাবাদ পৃথিবীতে ঠিক কবে শুরু হয়েছিলো তা নিয়ে অবশ্য নানা মুনির নানা মত আছে। মত আছে রান্নাঘরে পেঁয়াজের ব্যবহার নিয়েও। মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার প্রায় সাত সহস্রাব্দ আগের ব্রোঞ্জ যুগের কিছু মানববসতিতে সবজি হিসাবে পেঁয়াজের ব্যবহারের কিছু নমুনা পাওয়া গিয়েছে। আরেক দল গবেষকের মতে, ইরান ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বপ্রথম পেঁয়াজের চাষ করা হয়। ইতিহাসবিদরা বলছেন, প্রাচীন ইতিহাসের গোড়ার দিকে চাষ হওয়া কিছু ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ ছিলো অন্যতম। সহজেই নানা জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া, ধীর পচনশীলতা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় প্রাচীন মানুষের কাছে পেঁয়াজ ছিলো প্রয়োজনীয় একটি খাদ্য। আমেরিকান পেঁয়াজ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রাচীন মানুষের তৃষ্ণাও মেটাতো পেঁয়াজ। যখন সব পুষ্টিকর খাদ্য ফুরিয়ে যেত তখন খাওয়ার জন্য আগে মানুষ পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতো।

চিকিৎসকরা তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, পেঁয়াজ ভক্ষণে মানুষের উচ্চরক্তচাপ কমে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে তো রেকর্ডের দড়ি ছিঁড়ে পেঁয়াজ সাধারণ মানুষের রক্তচাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের গোপন গুদামে (যেসব গুদামের হদিশ গোয়েন্দারাও জানে না) পেঁয়াজ ঘুমাচ্ছে এখনো। পচেও যাচ্ছে জমানো পেঁয়াজ। এই অস্থির বাজারকে শান্ত করতে প্লেনে করে উড়িয়ে আনা হয়েছে পেঁয়াজ। কিন্তু এই কাণ্ডের হোতারা কিন্তু দাঁতে পেঁয়াজের রস মাখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

পেঁয়াজ নিয়ে এখন আলোচনা সর্বত্র। চায়ের কাপে ঝড়ের বদলে এখন উঠেছে পেঁয়াজ খোসায় ঝড়।সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি বিয়েতে নবদম্পতি উপহারও পেয়েছেন পাঁচ কেজি পেঁয়াজ। বাঙালির রসবোধকে আটকাতে পারে এমন সংকটের বোধ হয় জন্মই হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেঁয়াজকে কেউ কেউ হীরার চেয়েও মূল্যবান বলে অভিহিত করেছেন। কেউ কেউ জেমস বন্ড আর মাসুদ রানাকে হায়ার করতে চাইছেন কম দামে পেঁয়াজ সংগ্রহের জন্য। একজন ক্রেতা মজা করে বলেছেন, এতদিন শুনেছি ডাক্তাররা বলেন পেঁয়াজ নাকি মাথায় চুল গজাতে সাহায্য করে। কিন্তু এখন দেখছি মাথার বাকি চুল ফেলে দিতেও পেঁয়াজের জুড়ি পাওয়া ভার।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199