চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 12 Dec 2024

1740 বার পড়া হয়েছে

Shoes

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। কেমন এক রুদ্ধশ্বাস আর গুমোট পরিস্থিতির  নাগপাশে আটকা পড়েছে ঢাকা শহর। রাস্তাগুলো মৃতের শরীরের মতো। পাকিস্তানী সেনাভর্তি ট্রাকের সুগম্ভীর শব্দ অনুপস্থিত। বাড়িগুলো যেন সমুহ বিপদ থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। অস্বস্তিকর নীরবতার বিশাল একটা চাদর আকাশ থেকে নেমে এসে সবকিছুকে আবৃত করে ফেলেছে। আগের দিন ১৫ ডিসেম্বরও ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো আকাশটাকে ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলেছে।

অ্যান্টিএয়ারক্রাফট গানের একটানা গুলি ছোঁড়ার শব্দ, যুদ্ধবিমানের বাতাস চেরা চিৎকার আর বিষ্ফোরণের গম্ভীর শব্দে এই শহরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে আচমকা এক নীরবতা এসে বেঁধে ফেলেছিলো শহরটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে। শহরের বাসিন্দাদের সবার মনেই একটা প্রশ্ন---পাক বাহিনী কি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে? আমার দেশের নাম হবে বাংলাদেশ?

বাংলাদেশের বিজয় দিবস এক এক ভীর অনুপ্রেরণা নিয়ে জেগে থাকে বুকের মধ্যে আজও। এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রইলো ‘তোমার আকাশ তোমার বাতাস’।

স্কুলের ছাত্র আমি। বাইরে এই দুর্যোগ, বিপদ আর একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম প্রক্রিয়ার কতটুকুই বা বুঝি তখন? কিন্তু ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর যে সময়টা অতিক্রম করতে হয়েছিলো আমাকে তার তীব্রতা, মৃত্যুর নিষ্ঠুর অন্ধকার, যুদ্ধে চলে যাওয়া মানুষদের জন্য স্বজনদের দীর্ঘশ্বাস, অনিশ্চয়তা আর ভয়ের অনুভূতিটা তো ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম। বালক মনে একটি যুদ্ধ আর তার সহযাত্রী ধ্বংসযজ্ঞ গভীর ক্ষত তৈরি করেছিলো। যুদ্ধের আগুনের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছিলাম আমি। তার আগে দেখেছি একটি স্বাধীন দেশের আকাঙ্খা বুকে নিয়ে মানুষের উত্থান বাঁধন ছেঁড়ার ডাকে কী ভীষণ উদ্দাম। ২৫ মার্চের পর জন্মস্থান ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম পরিবারের মানুষদের হাত ধরে। গ্রামগুলিও তখন আর নিরাপদ নয়। যুদ্ধ আর পাকিস্তানী বাহিনীর নির্যাতনের ফাঁদটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। চলে যেতে যেতে পথে পথে দেখেছি পুড়ে যাওয়া বাজার, মানুষের ঘর,। ঘরের পোড়া কাঠের সার সার খুটি দেখে মনে হয়েছিলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেক মৃত মানুষ। চিরচেনা দৃশ্যপট পাল্টে গিয়েছিলো অসহায় এক বালকের চোখের সামনে। গভীর অন্ধকারে লঞ্চে নদী অতিক্রম করার সময় তীরবর্তী গ্রামে আগুন দেয়া হয়েছে। অন্ধকারে ভূতের চোখের মতো জ্বলছে আগুনের চোখ। আমি কি ভুলতে পেরেছি? ভুলতে পেরেছি নিখোঁজ স্বজনের স্মৃতি, পালাতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া কোনো শিশুর গল্প? গ্রামের বাড়িতে গভীর রাতে বাড়ির গোলাঘরে বসে সেই অচেনা গেরিলা যোদ্ধাদের ভাত খাওয়ার দৃশ্য? তাদের সবার কি ফেরা হয়েছিলো বেঁচে থাকা স্বজনদের কাছে? সেই যোদ্ধাদের সঙ্গে তো পূর্ব পরিচয় ছিলো না। তারাও চিনতো না আমাদের। কিন্তু তবুও তারা শুনেছিলো অসহায় মাতৃভূমির ডাক। অস্ত্র হাতে নক্ষত্র থেকে ঝরে পড়া আগুনের মতো তারা মিশে গিয়েছিলো যুদ্ধের মাঠে। একদিন এই জমিনের ওপর ঝরেছিলো তাদের পবিত্র রক্ত।

যুদ্ধ মানুষের জীবনে অসংখ্য বিচ্ছেদ ডেকে আনে। ভয় আর অসহায়ত্বের ভিতর দিয়ে একজন ব্যক্তি মানুষের যাত্রা শুরু হয়ে মিশে যায় বহু মানুষের যাত্রায়। আমাদের বিজয় দিবসের ৫৩ বছরে পৌঁছে আজকে কথাগুলো খুব সহজেই ভাবতে পারছি। এই নিরাপদ ভাবনাটুকুর জন্যও অত বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষদের লড়াই করতে হয়েছিলো, জীবন দিতে হয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালবেলা এরকম ভাবনার অবকাশ কারুর মধ্যেই ছিলো না। মনে পড়ে, ওই অস্বস্তি আর আতংক মেশানো সকালবেলা আমি উঠানে কাটা ইংরেজি ডব্লিউ অক্ষরের মতো ট্রেঞ্চটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। ভয় করছিলো খুব। আকাশ থেকে বিমানের বোমা বর্ষণ শুরু হলে ওখানে গিয়েই আশ্রয় নিতে হবে জানতাম। মনে হচ্ছিলো এবার আর কেউ বেঁচে থাকবে না।

এখন মাঝে মাঝে ভাবি, আমার সেই প্রাণের ভয়, কষ্ট, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার বোধ তো এদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছেন, যারা যুদ্ধ করেছেন তাদের চাইতে বেশি নয়। ১৬ তারিখ বিকালে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধারা যখন সার বেঁধে শহরে প্রবেশ করছিলেন আর উল্লাসে গুলি ছুঁড়ছিলেন তাদের দেখে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে কেঁদে ফেলেছিলাম। তাদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছিলো, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন আপনারা?’

এখন স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি। এই দেশের আকাশের নিচে আমাদের বেড়ে ওঠা। এই বাতাসের গায়ে আলোর নাচন দেখে দেখে হেসে ওঠা। কী পবিত্র এই জন্মভূমি আমার। কী পবিত্র এই দেশের মাটি আজও আমার কাছে আজও।

ছবিঃ গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199