দু‘শ সেকেন্ডের সেই টেলিফোন কল

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 28 Nov 2024

2625 বার পড়া হয়েছে

Shoes

১৯৩৪ সালের ১৩ জুন মাস। প্রখ্যাত রুশ কথাসাহিত্যিক ডক্টর জিভাগো খ্যাত বরিস পাস্তারনাকের ফ্ল্যাটের ফোনটা বেজে ওঠে। পাস্তারনাক তড়িঘড়ি ফোনের রিসিভার তোলেন। উল্টোদিক থেকে কঠিন কন্ঠে কথা বলে একজন অপারেটর,

জেনারেল সেক্রেটারি কমরেড জোসেফ স্তালিন কিছুক্ষণের মধ্যে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।

ভয় আর আতংক ছিলো তখনকার সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজ জীবনের পরতে পরতে। সেই সময়ে স্তালিনের একটি ফোন কল নিয়ে এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘দু‘শ সেকেন্ডের সেই টেলিফোন কল।

পাস্তারনাকের প্রায় বিষম খাওয়ার অবস্থা। স্তালিন তার সঙ্গে কথা বলতে চান! এরকম তো হওয়ার কথা না। পাস্তারনাক ধরেই নিলেন কোনো বন্ধু তার সঙ্গে রসিকতা করছে। তিনি রিসিভার নামিয়ে রাখেন। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই ফোন আবারও বেজে ওঠে। এবার বেশ ভয় পান পাস্তারনাক। মৃদু কাঁপা হাতে রিসিভার তোলেন আবারও। অপরপ্রান্তে আবার সেই নৈর্বেক্তিক কন্ঠ তাকে জানায়, কমরেড স্তালিন একটু পরেই তার সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর অচেনা ব্যক্তিটি তাকে একটা বিশেষ কোড নম্বর দিয়ে ফোন করতে বলে। খট করে লাইনটা কেটে যায়। বরিস পাস্তারনাক হতবাক হয়ে যান ঘটনার আকস্মিকতায়। কিন্তু আর তো অবিশ্বাস করারও উপায় নেই। তার কাছে তো একটা কোড নম্বরও আছে। এবার ফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে সেই কোড অনুযায়ী ফোন করতেই অপরপ্রান্তে কেউ রিসিভার তোলে। ভারী কন্ঠ বলে ওঠে,

বরিস পাস্তারনাকের
বরিস পাস্তারনাক

স্তালিন বলছি…

জোসেফ স্তালিন
জোসেফ স্তালিন

পাস্তারনাকের ভাষায় ভয় এবং আতংক মেশানো সেই পরাবাস্তব নাটকের আয়ু ছিলো তিন থেকে চার মিনিট। কিন্তু গোটা ঘটনাটার সূত্রপাত ঘটে আরও কয়েকদিন আগে। পাস্তারনাকের কবি বন্ধু ওসিপ মান্দালস্তাম কিছুদিন আগে কয়েকটি কবিতা প্রকাশ করেন। কবিতায় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষের জন্য স্তালিনের নীতিকে দায়ী করেন তিনি। একদিন রাস্তায় পাস্তারনাককে পেয়ে মান্দালস্তাম তাকে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়েই সেই কবিতার কিছু কিছু অংশ আবৃত্তি করে শোনান। ভয় পেয়েছিলেন পাস্তারনাক। তখন স্তালিনের লৌহ শাসনের আওতায় যারাই বসবাস করতেন তাদের সবার অবস্থাই ছিলো পাস্তারনাকের মতো। তিনি সেদিন কবি বন্ধুকে শংকিত হয়ে বলেছিলেন, এই কবিতা তিনি শুনতে আগ্রহী নন। কারণ গোয়েন্দাদের কাছে খবরটা চালান হলে বিশাল বিপদে পড়ে যাবেন তিনি। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত হেঁটে অন্য রাস্তায় চলে গিয়েছিলেন।

কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মান্দালস্তামের বিদ্রোহী কবিতা কেউ একজন ঠিকই পৌঁছে দিয়েছিলো স্তালিনের সিক্রেট পুলিশের দপ্তরে। ১৯৩৪ সালের ১৬ মে সন্ধ্যাবেলা গ্রেপ্তার করা হয় মান্দালস্তামকে। তার ফ্ল্যাটের জিনিসপত্রও তছনছ করা হয় তল্লাশী করার সময়। ওই সময়ে এ ধরণের কাজের জন্য যে কারুর কপালেই জুটতো নির্বাসন অথবা শ্রম শিবিরের শাস্তি। বরিস পাস্তারনাক তখন বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সেদিন তিনি ছুটে যান

ওসিপ মান্দালস্তাম
ওসিপ মান্দালস্তাম

মান্দালস্তামের স্ত্রী নাদেজদার কাছে। তাকে পাস্তারনাক পার্টির উঁচুমহলে কোনো নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নাদেজদা সঙ্গে সঙ্গে  ক্রেমলিনে ফোন করলেও অপরপ্রান্ত থেকে ঠাণ্ডা নীরবতার হাওয়া ছাড়া আর কিছুই পাননি।

কিন্তু থেমে যাননি পাস্তারনাক। বন্ধুর জন্য কমিউনিস্ট পার্টি অফিসের বারান্দা আর গুপ্ত পুলিশের দপ্তরে তাকে বেশ কিছুদিন ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। পাস্তারনাক মান্দালস্তামের খোঁজ বের করার জন্য এবং সাজা মওকুফ করানোর জন্য পার্টির বড় নেতা নিকোলাই বুখারিনের সঙ্গেও দেখা করেন। কিন্তু কোথায় তার বন্ধু? যেন এক ধূসর কুয়াশা মোড়া ভারী পর্দার অন্তরালে হারিয়ে গেছে কবি।
তবে মান্দালস্তামকে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যেতে দেননি পাস্তারনাক। প্রায় এক মাস ধরে খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় তাকে উরাল পাহাড়ের কাছে একটি অখ্যাত শহরে রাখা হয়েছে। তার কপালে শ্রমশিবিরের অভিশাপ নেমে আসেনি। এই টানাপোড়েনে অবশ্য মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন মান্দালস্তাম। ওই সময়ে তিনি একটি ব্যর্থ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

এতসব ঘটনার পরেই বরিস পাস্তারনাকের কাছে ফোন করেছিলেন স্তালিন। তিন থেকে চার মিনিটের সেই কথোপকথনে স্তালিন খুব ঠাণ্ডা গলায় জানতে চেয়েছিলেন মান্দালস্তাম সম্পর্কে। সংক্ষেপে বলেছিলেন মান্দালস্তামকে নির্বাসনে পাঠানো হয়নি।
কথার শেষে স্তালিন হঠাৎ প্রশ্ন করেছিলেন,

মান্দালস্তাম কি আপনার বন্ধু?

প্রশ্নটা শুনে ভয়ে গুটিয়ে যান পাস্তারনাক। সেদিন স্তালিনের সঙ্গে কথা বলার সময় বলতে পারেননি, হ্যাঁ, সে আমার বন্ধু। পাস্তারনাকের উত্তর ছিল,

কবিদের অনেক বন্ধু থাকে।

এর পর কথা শেষ না করেই স্তালিন রিসিভার নামিয়ে রাখেন। পাস্তারনাক আবার সেই নম্বরে ফোন করেন। কারণ তিনি দেখা করতে চেয়েছিলেন স্তালিনের সঙ্গে। ফোন করার পর শোনা যায় অপরপ্রান্ত থেকে যান্ত্রিক কন্ঠস্বর জানাচ্ছে নম্বরটি সঠিক নয়।


তথ্যসূত্রঃ কুইন্টাস কার্তিয়াস
ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199