তবুও সন্ধ্যা আসে…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 14 Sept 2023

5990 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সন্ধ্যা আসে। কারো কারো কাছে খুব মন্থর। ইংরেজ কবি টি. এস এলিয়ট তাঁর কবিতায় সন্ধ্যাকে চিত্রিত করেছেন চেতনানাশক ওষুধে নিষ্ক্রিয় একজন রোগীর সঙ্গে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।

সন্ধ্যা্ এক আশ্চর্য সময়; বিশেষ করে আশ্বিনের সন্ধ্যা।শীত আসার আগের সময়ে পশ্চিম আকাশে ফুটে ওঠে কত অজানা নক্ষত্রের ইশারা। এই কোলাহলে বিদীর্ণ শহরের কোথাও পরিত্রাণ পেতে উঁচু কোনো ভবনের ছাদে উঠে গেলে জানা সম্ভব হয়, আকাশের নরম শরীরে অন্ধকারের পর্দা নেমে এলে কী অপরূপ হয় তার ছবি। উচ্চতা থেকে নিচে গাড়ির আলোয় ঝলসে ওঠা শহর। হর্নের আর্তনাদ, বাড়ি ফেরার তাড়া, অসহিষ্ণু মানুষের ভিড়। সন্ধ্যার সুযোগ কোথায় সেখানে ধীরে নেমে আসার? সন্ধ্যা সেখানে রাত্রির হাত ছেড়ে দেয়া্ প্রেমিকা। সন্ধ্যা এমন এক সময় যখন আলো আঁধারকে আলিঙ্গন করে।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘তবুও সন্ধ্যা আসে’।

বহুদিন আগে এক গ্রামের নিশ্চল জীবনের সন্ধ্যায় কেউ পূবের ঘরের বারান্দায় বসে কালি মাখা লন্ঠনগুলো কাপড় দিয়ে মুছে পরিস্কার করে আলো জ্বালতো। এ ঘর-ও ঘরে আলো রেখে যেতো নিঃশব্দে।তখন উঠানে আশ্বিনের ম্লান কুয়াশার আয়োজন। বিশাল কড়াইয়ে দুধ জ্বালে বসতো। কাঁচা কলার বড়া ভাজার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো বাড়িময়। কে ফেরেনি এখনও মানিক নগর বাজার থেকে? কার জন্য হ্যারিকেন রাখা আছে অন্ধকার বাঁশঝাড়ের কাছে?

সন্ধ্যা কি পথ হারানো একটা সময়? একটা প্রেমের চিঠি অন্ধকারে ভুল করে এক জানালার বদলে অন্য জানালায় রেখে আসা?পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার জোনাকির আলোর উৎসব দেখা?

সন্ধ্যা হচ্ছে সূর্যাস্তের ঠিক কয়েক মুহূর্ত পরে গোধূলির সময়ে রাতের ঠিক আগের অবস্থান। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায়, সন্ধ্যা সেই সময় যা ঠিক সূর্যাস্তের পর ও রাতের ঠিক আগে ঘটে। সন্ধ্যার শেষদিকে যখন পৃথিবী এমন একটি বিন্দুতে অবস্থান করে যখন তার কেন্দ্র স্থানীয় দিগন্তের ৬ ডিগ্রি অবস্থানে থাকে।

আশ্বিন মানের হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেছে বিকালের শেষে। নিভু নিভু আলোয় বেঁচে থাকে গ্রামের বাজারের কয়েকটা দোকান। কাঠের ভাঙা সেতু পার হলে তিসি ক্ষেত। কেমন ঝাঁঝালো গন্ধ ওঠে। তারপর মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে আছে অন্ধকারে। বাড়ি ফিরতে পারবো তো? জীবনানন্দ লিখেছেন, তবুও সন্ধ্যা আসে। অনিবার্য সন্ধ্যার আগমনের কথাই তো লিখেছেন।যেন আর কোনো পথ নেই সন্ধ্যার আসা ছাড়া। প্রকৃতির নিয়মে সত্যিই তো কোনো পথ থাকে না।

কবিদের ভাবনার মতো করে সন্ধ্যার কোনো্ স্থান নেই শহরে। আলু-পেঁয়াজের দরদাম করতে করতে সন্ধ্যা আসে এই শহরে। উদ্ভিন্ন যুবতীর মতো ভ্যান থেকে মুখ বাড়ায় চালকুমড়া অথবা ঢেঁড়স। তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে অনেক কথার লেনদেন দোকানীর সঙ্গে।সেথানে সন্ধ্যার জীবন ক্ষণস্থায়ী।কখন আসে আর কোন পথে রাত্রির অন্তরালে হারিয়ে যায় বোঝা মুশকিল। কিন্তু তবুও সন্ধ্যা আসে শহরে। কোনো কোনো নির্জন পথে ফুটে থাকে টগর। দ্রুত রিকশার বেল বাজে, অফিস ফেরৎ ঘড়ি সময় দেখায়।সন্ধ্যার চরিত্রে সব সময় তাড়ার পোশাক পরা। ‘‘মাধবী এসেই বলে, যাই’’। সবাইকে যেন একটা পরিণতির দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে সন্ধ্যা। একদা এই শহরে রুমালে কয়েকটা বকুল ফুল যত্নে ঢেকে কাউকে কাউকে বাড়ি ফিরতে দেখা যেতো সন্ধ্যার হাত ধরে। জানালার পাশে ডেকে যেত টিনের বাক্স হাতে হট প্যাটিসওয়ালা।কোনো গলিতে হেঁটে যেতে ধূপের ঘ্রাণ ভেসে থাকতো। পড়ার বই রেখে হারমোনিয়ামে কারো গলা সাধার স্বর ঘড়িতে সময় দেখাতো সন্ধ্যা সাড়ে ছ‘টা।

গ্রামের জীবনে সময়ের বালাই নেই। সন্ধ্যাবেলা মাঠ পার হতে গিয়ে বৃষ্টি নামলে গাছের তলায় আশ্রয় জোটে। কত কী মনে পড়ে তখন! একা সন্ধ্যার অন্ধকারে বিড় বিড় শব্দে গাছের পাতায় বৃষ্টি ঝরে। ধুয়ে যায় দূরে প্রাইমারি স্কুলের দেয়াল, খড়ের গাদা আর বিকেলের স্মৃতি।হঠাৎ বৃষ্টি থেমে গেলে অনেকদিন আগের কোনো গ্রামের জীবনে হ্যারিকেন হাতে কাউকে খুঁজে আসে বাড়ির লোক। মসজিদের চাপকলে হাত-পা ধুয়ে ঘরে ফেরে সন্ধ্যা।

শহুরে কফির দোকানে অথবা তারকা চিহ্নের তকমা লাগানো বিশাল হোটেল বাড়িতে সন্ধ্যার অবসর নামে হয়তো জটিল কোনো ব্যবসায়িক আলাপের মাঝে। ব্যস্ত টেলিফোন, ছুটে চলা গাড়ি, বাসের ভিড় সন্ধ্যার মৃদু নেমে আসাকে অনেক উজ্জ্বল আলোর কিনারায় খুন করে। সন্ধ্যার অপেক্ষা বলে আর কিছু নেই আজ। সবই রাতের প্রস্তুতি। শুধু সন্ধ্যাবেলা কোনো নির্জন ছাদে একা হয়ে জেগে থাকে মাধবীলতার ঝাড়।

ছবিঃ সালমান সিদ্দিকী প্রত্যয়, গুগল ও প্রাণের বাংলা

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199