তখন হাসপাতালে…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 11 Jul 2024

3815 বার পড়া হয়েছে

Shoes

লম্বা করিডোর। ফ্যানের বাতাসে দরজায় দরজায় ঝোলানো সাদা পর্দা উড়ছে। ম্লান বৈদ্যুতিক আলো ছড়াচ্ছে ক্লান্ত বাল্ব যতোটা সে পারে। আলোর প্রায় প্রবেশ নিষেধ ওয়ার্ডগুলোতে। রক্ত, ওষুধ, ম্পিরিট আর পাগলামীর গন্ধ মেখে এক একটা হাসপাতাল যেনো মৃত্যুর চেয়েও ভারী হয়ে ওঠে।

অনেক অনেক বছর আগে আমাদের হাসপাতালগুলোর ছবি এরকমই ছিলো। সেই কবে বাঙ্গুর সাইকিয়াস্ট্রি ইন্সটিটিউটের একটা বেডে বসে কবিতা লিখছেন বিনয় মজুমদার। কলকাতা শহরের এক হাসপাতালে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন সুচিত্রা সেন।  ফ্রাঞ্জ কাফকা আশাহীন শুয়ে আছেন ডাক্তার হফম্যানের স্যানেটরিয়ামে। তার ফুসফুস ক্ষয় হয়ে গিয়ে আর পৃথিবীর তাজা হাওয়া টেনে নিতে পারছে না। ডাক্তারদের আর কিছুই করার নেই।

হাসপাতালে তাদের গল্পগুলো ভয়ংকর, হতাশায় নুয়ে পড়া, ক্ষতবিক্ষত। ভেঙে পড়া সময় ঘুরছে কোথাও টেনে দেয়া শেষের সীমানায় পৌঁছানোর জন্য।

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সাহিত্যিকদের হাসপাতাল বসবাসের কাহিনি নিয়ে ‘তখন হাসপাতালে’।

কবি বিনয় মজুমদার তখন বেশ অসুস্থ হয়ে সাইকিয়াস্ট্রি ইন্সটিটিউটে ভর্তি। হাসপাতাল থাকতে চাইতেন না। বার বার ফিরতে চাইতেন শিমুলপুর গ্রামে। হাসপাতালে বসে লেখার প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘‘আমাকে হাসপাতালে পুরে সৃষ্টিকর্তা কী পরীক্ষা করলেন কে জানে!কী দুরূহ পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে এবং পাঠক পাঠিকাগণের কাছে। পরীক্ষায় পাশ করেছি বোঝা যায়। কবিতা লেখা আমি মাঝে মাঝে ছেড়ে দিই। তারপর এমন এমন কাণ্ড ঘটে যাতে ফের লিখতে বাধ্য হই। এই বইখানাও তেমনি জোর করে লেখানো। কবিতা না লিখে বছর চারেক ছিলাম। তারপর আমাকে হাসপাতালে পুরে কাগজ এবং কলম দিয়ে বলা হলো-‘কবিতা লিখলে ছাড়া হবে নচেৎ নয়।’

কবির মাথার ভিতরের নির্জনে তখন বয়ে চলেছে উচ্ছন্নতার স্রোত। কিন্তু তবুও লেখা হয়ে গেলো ‘‘আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়’’-এমন চরণ।

ঋত্বিক ঘটক মদ্যপান ছাড়তে পারছেন না। ঘুরেফিরে হাসপাতালের বাসিন্দা হতে হচ্ছে। হাসপাতালে অসহায় মানুষটা ছটফট করছেন। তেমন কেউ আর তাকে দেখতে যায় না। তখন হাসপাতালে পথ্য নিয়ে ঋত্বিককে দেখতে যেতেন সুচিত্রা সেন। কেউ জানতেও পারেনি নায়িকার সেই উপস্থিতির কথা। সুচিত্রা সেন কাউকে জানাতেও চাননি। শোনা যায়, বেডের পাশে  কখনো শুধু ঋত্বিক ঘটকের হাত ধরে বসে থাকতেন তিনি। তারপর একটা সময়ে নিঃশব্দে বিদায় নিতেন। হাসপাতালে লাইট, ক্যামেরা আর অ্যাকশনের বাইরে হাহাকারে মোড়া নৈঃশব্দ সঙ্গী হয়ে থাকতো বাংলা সিনেমার অসাধারণ সেই পরিচালকের।

জীবনের শেষ ছয়টা সপ্তাহ কাফকা কাটিয়েছিলেন ডা. হফম্যানের স্যানেটরিয়ামে। প্রদীপ নিভে আসছে তখন। কাঁপা কাঁপা জীবনের শিখা ছায়া ফেলছে স্যানেটরিয়ামের একটা ঘরের বিবর্ণ দেয়ালে। বন্ধু ফেলিক্স ওয়াল্টেশ কাফকাকে দেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন তখনকার সময়ে বিখ্যাত ফুসফুস বিশেষজ্ঞ ডা. হাইনরিখ নিউমানকে। তিনি রোগীকে দেখে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, তার আর কিছুই করার নেই। তখন কাফকা আর ভালো ভাবে কথা বলতে পারছেন না। কিন্তু ছোট ছোট চিরকুট লিখে চারপাশের মানুষদের সঙ্গে কথা বলছেন। সেসব চিরকুট প্রমাণ দেয় তার মাথা তখনও সক্রিয় ছিলো। তারপর চলে আসে ১৯২৪ সালের ৪ জুন। মৃত্যুর গহীন অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছেন কাফকা। তখন পাশে দাঁড়ানো ২০ বছরের ছোট ডোরা; কাফকার জীবনের শেষ ভালোবাসার নারী। ডোরার মনে হলো কাফকা কিছু বলতে চাইছেন। ঝট করে কাগজ-কলম বের করে লিখে নিতে চাইলেন। অষ্পষ্ট ভাবে একটা বাক্য বলতে গিয়ে শেষ করতে পারলেন না কাফক।জীবন প্রদীপ নিভে গেলো।

Jibanananda Dasবাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল কবি জীবনানন্দ দাশ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন হাসপাতালে-ই। ট্রামের ধাক্কায় আহত, প্রায় মুমূর্ষু তখন তিনি। বেডে শুয়ে মৃত্যুর আগে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন। মাথার ভিতরে তার তখন হয়তো মৃত্যুমাখা নক্ষত্র থেকে ছাই ঝরে পড়ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই কবিতার লাইন

আবার যেন ফিরে আসি

কোনো এক শীত রাতে

একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে

কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারায়।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199