বাঙালির ছিদ্রান্বেষণ

প্রাণের বাংলা

,

প্রকাশ: 13 Nov 2025

685 বার পড়া হয়েছে

Shoes

ক্রিটিক শব্দটাই এখন মনে ভয় জাগায়। এ কথা চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায়, এই শব্দটার সঙ্গে এখন শুধু পরশ্রীকাতরতা, ছিদ্রান্বেষণ আর ঈর্ষার বসবাস। সমালোচনা বা ক্রিটিসিজমের সেই দিন আর নেই যখন গঠনমূলক সমালোচনা যে কোনো কাজকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিতো। ধরিয়ে দিতো ত্রুটির জায়গাটা। এখন সমালোচনার অন্য নাম ছিদ্রান্বেষণ। সমালোচক মানেই যেনো এমন একজন মানুষ যে ভুল করে ঝিঙে ভেবে কাঁচামরিচ খেয়ে ফেলে ঠিক করেছে, এই ঘটনার শোধ নিতে হবে।কার ওপর শোধ তোলা? কেউ তো তাকে ঝিঙে ভেবে মরিচ খেতে বলেনি। বাঙালির ভিতরে এই ধ্বংসাত্নক প্রক্রিয়া বরাবরই বিরাজমান ছিলো। এখন দিনে দিনে তা প্রবল হয়ে উঠেছে। এই বাঙালি বিদ্যাসাগর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত কাউকে নিষ্কৃতি দেয়নি। ফরাসী দেশে পরনিন্দা করতে গিয়ে বলা হয়, ডিমের গায়ে লোম নেই, তার মানে এটা ডিম নয়। ডিমের গায়ে লোম! পরনিন্দার বা নোংরা সমালোচনার এটি হতে পারে বড় দৃষ্টান্ত। কেউ একজন ভালো কাজ করে সামনে এগিয়ে গেলেই তাকে কাঁকড়ার মতো পেছন থেকে টেনে ধরা বাঙালির স্বভাবে পরিণত হয়েছে। অথবা বলা যেতে পারে, রোগে পরিণত হয়েছে।
এই ছিদ্রান্বেষণ বা পরনিন্দা নিয়ে এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো, ‘বাঙালির ছিদ্রান্বেষণ’।

আফজাল হোসেন
অভিনয় শিল্পী ও লেখক

যাদুকরী স্বভাব

কলের গান বা গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজিয়ে যারা নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকটা শুনেছে বা যারা যাত্রাপালাটা দেখেছে, তারা জানে- শেষের দিকে নবাবের সাথে কি ঘটেছিল। যারা ঘটিয়েছিল পরিচয়ে তারা বাঙালী। কিছু বাঙালী তাদেরই নবাবের সাথে দূর্দিনে চরম দূর্ব্যাবহার করে দারুণভাবে মজা লুটেছিল- ভাবা যায়। সে ঘটনা কাল্পনিক না সত্য, সে তর্কে না গিয়েও বলে দেয়া যায়, বাঙালী চরিত্র নরম শরমে নির্মিত বলা হয় বটে- তা উপরে উপরে। ভিতরে নানা অসুন্দর আর নির্মমতার পরিমানও যথেষ্ট। অন্যের ভালোতে তাদের মনখারাপ, অস্বস্তি হয়। নিজ নিজ শ্রী তে যারা অতি মুগ্ধ অন্যের শ্রী তে তাদের কাতর হওয়ারই কথা। এমন স্বভাবের কারণে সুখ সয়না। সুখে থাকলে ভূতে কিলায় এ কথার উৎপত্তি এমনি এমনি হয়নি। সন্মানিতজন অসন্মানিত হলে সুখের সুড়সুড়ি যারা পায়- নিশ্চয়ই তারা স্বাভাবিক নয়। এতটাই অস্বাভাবিক- বিপদগ্রস্থ মানুষের জন্য দুঃখিত হওয়ার বদলে কড়কড়া আনন্দলাভ করে, তাদের নিয়ে ভয়ানক ঠাট্টা করা পছন্দ তাদের। মনে পড়ে, নবাব ধরা পড়েছেন, তাঁকে ঘিরে রেখেছে অত্যন্ত সাধারণ কিছু মানুষ। তাদের মধ্য থেকে একজন হি হি হেসে নবাবের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিতে চায়। অন্য একজন বলে, তোমার জন্য কাঁটা দিয়ে সিংহাসন বানিয়ে রেখেছি নবাব। তারপর সকলে হিহি খিক খিক করে বিদঘুটে ভঙ্গীতে হেসে নবাবকে অপমান করতে পারার আনন্দ দারুণভাবে উপভোগ করে। খুবই বিমর্ষ গলায় বাংলা বিহার উড়িষ্যার হেরে যাওয়া অধিপতিকে বলতে শোনা যায়, তোমাদের জন্য আমি কম ত্যাগ স্বীকার করিনি- তার পুরষ্কার কি এই কাঁটার তৈরি সিংহাসন আর জুতার মালা! এরকম ঘটনা হয়তো ঘটেছিল কিংবা আদৌ ঘটেনি। হয়তো পুরো ঘটনাটাই নাটক জমানোর জন্য বানানো, কাল্পনিক। ধরে নেয়া যাক, দ্বিতীয় ধারণাই সত্য- বানানো বা কাল্পনিক। তা যদি হবে, এমন কল্পনা রচনাকারের মগজে তো এসেছিল! লেখক মনে মনে দৃশ্য সাজায় তারপর লেখে। তা হাওয়া থেকে আসে, নাকি মানুষ দেখে শেখা, সঞ্চয় করা অভিজ্ঞতাই প্রকৃত উৎস। লেখক, নাট্যকার খারাপ করে ভাবেনি, খারাপের জোগান মানুষের স্বভাব, চরিত্র থেকে পাওয়া। সেই কবে থেকে অনেক মানুষ এরকমই। আচার ব্যবহারে কুচুটে, ভাব ভাষায় চুড়ান্ত অসুন্দর। এমন অসুন্দর অনেকেই সাধ করে, ভালোবেসে, আগ্রহ নিয়ে হয়। মন্তব্য করে কারো বারোটা বাজাতে চাওয়া এদের নিত্যের ব্যাপার। কারও বিরুদ্ধে বলার জন্য , কাউকে ছোট করার জন্য কোনও নির্দিষ্ট কারণ পেতে হয়না- আত্মসুখ প্রাপ্তির জন্য পরম উৎসাহে, অতি আনন্দে মানুষ মানুষের বিরুদ্ধে মন্দ কথা বলে। অনেকের এমন দশা, পেটের ভাত হজমের জন্য মানুষ খুঁজে নিয়ে নিকটের বা দূরের কারও সম্পর্কে খানিক বাজে কথা বলে নেয়। একই কাজ ঘুম না হলেও করে, কিচ্ছু করার নেই বলেও করে। করে কোনও কারণ ছাড়াই- এমনি এমনি। এমন উদ্ভট আনন্দপ্রাপ্তির খায়েশ, স্বভাব বহু পুরানো কিন্তু পুরানো বলে জং ধরে যায়নি। এমন স্বভাব যেনো খাঁটি ইস্পাত দিয়ে তৈরি- প্রতিদিনের ব্যাবহারে চকচকে থাকছে। একটা সময়ে মন্দ বলে বেড়ানোদের এড়িয়ে চলতো মানুষ। এখন সমাজে এমন স্বভাবীদের দাম বেড়েছে। এখন সম্পর্ক তৈরি ও সুদৃঢ় হয় কুৎসা গাওয়ার যোগ্যতা থাকলে। গাওয়ার ক্ষেত্রও বেড়ে গেছে। খবর প্রচার, পরিবেশনাতে কিংবা টেলিভিশনের রাজনৈতিক আলোচনা অনুষ্ঠানে ব্যাপক হারে তার ব্যাবহার লক্ষ্য করা যায়। রাজনৈতিক মঞ্চ আর ধর্মীয় ভাষনেও অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা অনুপস্থিত নয়। তা যে বক্তা যত ভালো পারে সে ই বিশেষ আগ্রহের বক্তা হয়ে ওঠে। বিশেষ হয়ে ওঠা যায় বলে পরচর্চ্চা, পরনিন্দা, কুৎসা গাওয়ার প্রবনতা হৈহৈ রৈরৈ করে বেড়েই চলেছে। আমাদের নীতি, প্রীতি বাড়েনা এক চুলও, দুদ্দাড় করে বেড়ে চলেছে দোষ ধরা বা ফুটো খোঁজার অভ্যাস। বেড়েই চলেছে রটনা করা, কুৎসা গাওয়া, মানুষকে ছোট বানানো আর অসন্মান করার অভ্যাস। এমন অভ্যাসের সমালোচনা করা যাবেনা আর। কতজনের কত সমৃদ্ধি ঘটিয়ে দিচ্ছে যে যাদুকরী স্বভাব- তা মন্দ বললে ঘাড়ের উপর মাথা থাকবেনা।

শম্পা রেজা
সঙ্গীত ও অভিনয় শিল্পী

এটা তো রোগের মতো

দুই বাংলার মানুষের মধ্যে এই ছিদ্রান্বেষণের সংকট আছে। আমাদের দেশের বেলায় এই সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি সমস্যা। সবাই দু‘টি দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। পাকা খেয়ে, বুভে অথবা না-বুঝে তারা এ দেশের স্বাধীন অস্তিত্বকে আর চায় না। পাশাপাশি এই প্রবণতার সঙ্গে অশিক্ষা যুক্ত হয়ে তা এখন কুশিক্ষায় পরিণত হয়েছে। আমি তো বলবো বাঙালি তার মানসিক জগতে রোগে আক্রান্ত। একটি রোগ হলো, লোভ আর অন্যটি হিংসা। বেশি সংখ্যক মানুষের মনকে এই দুটি উপাদান আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই অনুভূতিগুলো মনের অন্য ভালো অনুভূতিকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে, দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এটা ক্যানসারের মতো। আর তাই মানুষ অন্য আরেকজনের ভালো কাজটাকেও সন্দেহের চোখে দেখছে। তার আস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, আমাদের সবাইকে তার নিজস্ব জীবনের ক্ষণগুলোর মূল্য বুঝতে হবে। মুহূর্তগুলোকে ভালো কাজ দিয়ে সাজাতে হবে। তবেই হয়তো এই প্রবণতা থেকে ফেরার পথটা আমরা খুঁজে পাবো।
পরচর্চা বলি আর ছিদ্রান্বেষণ বলি, এটা তো রোগের মতো। এই রোগ আমাদের মনে বাসা বেঁধে শরীরকেও অসুস্থ করে দিচ্ছে। এর মূল কারণ, কেনো এরকম প্রবণতা বাড়ছে তার কারণটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদেরই।

কনকচাঁপা
শিল্পী

ছিদ্রান্বেষণ! বড়ই অদ্ভুত একটি শব্দ!

প্রায় সঠিক বাংলা বানান ভুলে যাওয়া বাংলাদেশের মানুষের শত শত পুরনো একটি অতিপ্রিয় অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম অভ্যাসগত কাজ এই ছিদ্রান্বেষণ! নিজের চারিত্রিক দূর্বলতা, অর্থনৈতিক সংকট, জ্ঞানের অভাব, বিদ্যাশিক্ষার অপ্রতুলতা যা কিছু থাকুক তাতে কোন অসুবিধা নেই, অন্যের ছিদ্র পথ পেলেই সেখানে চোখ রাখাতেই যেন স্বর্গ সুখ!

আগে একটা সময় ছিলো যখন গ্রাম্য কুচুটে ঝগড়াতে মাঝ বয়েসী মহিলা যাদের কিনা সারাটা দুপুর অথবা পুরো দিনমান দু’টো চাল ফুটানো আর তাতে দু’টো আলু গুঁজে দিয়ে তা ঠেসে মেখে এক থাল ভাত বেড়ে দেয়া, আর তার পরেই পান মুখে দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ থাকতো না। তাদের অতি জরুরি একটাই কাজ যাকে বলা যায় বাধ্যতা মূলক কাজ তা ছিলো এই ‘ছিদ্রান্বেষণ’।

হয় তো একজনের সন্তান পরীক্ষার ফলাফল খুব ভালো করছে তখনই তার মনে সন্দেহ জেগে উঠতো এই ভেবে, যে কিভাবে এমন ফলাফল হলো? ব্যাস, শুরু হয়ে গেলো ছিদ্রান্বেষী অভিযান।কোন নবদম্পতি খুব সুখে আছে শুরু হয়ে গেলো পাড়ার সেই মহিলাদের দলগত ছিদ্রান্বেষণ। কিন্তু পরে আর এই পরচর্চা মূলক অসামাজিক কিন্তু নিয়মিত সামাজিক কাজটি আর অলস দুপুরে পান খাওয়া মহিলাদের কুক্ষিগত থাকলো না। এটা চলে গেলো আপামর জনতার কাছে।সবাই যেন এই কাজকে জাতীয় দায় ভেবে নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে লাগলো। এই ছিদ্রান্বেষণ কত মানুষের জীবন দূর্বিষহ করে তুলেছে, কতো বালিকার গলায় ফাঁস পড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। এখন আমরা সামাজিক মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছিদ্রান্বেষণ করি এবং নিজ দায়িত্বে তা ছড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব পালন করি। কে কাকে বিয়ে করলো, কে অনেক বড় পদে কর্মকর্তা হয়ে গেলো, কার বিদেশ যাওয়া একদম নিশ্চিত হয়ে গেলো, কে পরকীয়া করলো সব আমাদের জানতে হবে। আবার একজন জানলে আরেক জনকেও জানাতেই হবে। এগুলো ভাবনা বাস্তবে রূপান্তরিত করতেই যেন আমাদের যত ব্যস্ততা!

কত রকম খবর যে আমরা এভাবে পাই এবং ছড়াই! আমরা শিল্পীরা এই ছিদ্রান্বেষণের সবচেয়ে বড় ভুক্ত ভোগী।সাধারণ দর্শক শ্রোতা বেশীর ভাগই যারা আপাতদৃষ্টিতে আমাদের ভালোবাসে তারা আমাদের জীবন যাত্রার বেড়া ফুটো করে চোখ রাখে এবং প্রায় প্রতিটি কর্মকাণ্ডে ছি ছি ক্কার করে। আমরা বাঁচলেও দোষ, মরলেও দোষ, বিয়ে করলেও দোষ, না করলেও দোষ। সুন্দর জামা পরলেও দোষ, না পরলেও দোষ। আমরা রিক্সাতে চড়লেও দোষ, গাড়িতে চড়লেও দোষ।আমাদের অসুখ হলেও ছিদ্রান্বেষীরা বলবে শিল্পীদের এতো অসুখ হয় কেন! সব চেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার এই যে তারা আমাদের কবরের কল্পিত ফুটোতেও চোখ রেখে শাস্তির রকমফের সহ দোজখের স্তরও দেখে ফেলে। এগুলো মনগড়া সংবাদ ভিডিও বানিয়ে তারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে পয়সা আয় করে আর বাকি ছিদ্রান্বেষীরা মনের আনন্দে হা হা রিএ্যাক্ট দেয়। এই ছিদ্রান্বেষণে এমন শান্তি সুখ পায় যেমন পাওয়া যায় যৌন মিলনে।

চঞ্চল চৌধুরী
অভিনয় শিল্পী

অথচ ছিদ্রান্বেষণ এর একমাত্র বৈধ অনুমোদন প্রাপ্ত মানুষ একজন গলফ খেলোয়াড়। যারা কিনা একটা ছিদ্র বা গর্ত খুঁজে টার্গেট করে তাদের বল নিখুঁত ভাবে ফেলবে এবং আকাঙ্ক্ষিত পয়েন্ট তুলবে! আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য খুবই নীচের দিকে ধাবিত।যা থেকে পরিত্রাণ পেতে খুব শিগগিরই জাতীয় ভাবে চিকিৎসা দরকার। আর দরকার নিজের চরিত্রের আসল ধরনের নাম ‘ছিদ্রান্বেষী’ বানান শেখা। তার চেয়েও জরুরি নিজের জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করে নিজের সংসার, সংসারের সদস্য এবং তাদের পুরো পরিবারের আসল ধরন বুঝতে চেষ্টা করা। কারণ সত্যিকার অর্থে অন্যের ছিদ্র খুঁজতে গিয়ে তারা ইতোমধ্যেই জীবনের অনেক দামী সময় হেলায় অবহেলায় অযাচিত কাজে ব্যয় করে বড় একটা ফুটো তৈরি করে ফেলেছে যা কিনা তারা নিজেরা দেখেনা কখনোই।

আসুন, ছোট এই জীবন, নিজেকে, নিজের পরিবার কে চিনি, জীবন উপভোগ করি নিজের মনের আনন্দে। ছিদ্রান্বেষণ আমাদের জীবন থেকে অনেক সময় কেড়ে নিচ্ছে অনর্থক ভাবে এই কথাটিও বুঝতে শিখি। স্রষ্টা আমাদের সবাইকে ভালো রাখুন।

ঈর্ষা আর আচরণের দৈন্য এই প্রবণতার কারণ

বাঙালির ছিদ্রান্বেষণ প্রবণতা বরাবরই ছিলো। এখন এই সময়ে এসে এই প্রবণতার প্রকাশ বেশি দেখছি। আমার মনে হয়, আমাদের ঈর্ষা আর আচরণের দৈন্য এই প্রবণতা প্রবল হয়ে ওঠার পেছনে কাজ করছে। ‘ও কেনো ভালো কাজ করবে? তার প্রশংসা কেনো করা হবে?’ এই চিন্তাটাই এখন বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে তীব্র ভাবে কাজ করে। একটু যদি পিছিয়ে যাই তাহলে দেখতে পাবো, আমাদের সমাজের ভিতরে অমানবিকতা আর স্বার্থপরতার বিকাশ ঘটেছে। এই ঘটনাটি ধারাবাহিক ভাবেই ঘটেছে। রাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতির অঙ্গন-সব জায়গাতেই এই অবক্ষয়ের ধারা ডালপালা বিস্তার করেছে। এক অদ্ভুত সময়ের ভিতরে আমরা প্রবেশ করেছি। আমি বলছি না, সব মানুষের মধ্যেই এই আগ্রাসন বেড়েছে। কিন্তু এটুকু তো বলা যাবেই বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের মনোজগতে। কেউ যে কোনো ক্ষেত্রেই কোনো ভালো কাজ করলেই তাকেই পেছন থেকে টেনে ধরা হয়। আটকে দেয়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু তার ওই ভালো কাজটি অনুসরণ করে কেউ-ই আরেকটা ভালো কাজ করতে উৎসাহিত হয় না। আমাদের গ্রামে একটা কথা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত আছে-সতীনের বাটিতে বিষ্ঠা গুলে খাবো। বাটিটা তো নষ্ট হবে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সাংবাদিক ও লেখক

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি আমার অভিনীত ‘হাওয়া’ সিনেমার কথা। এই সিনেমা নিয়ে বিস্তর আলোচনা। মামলাও হয়েছে এটির বিরুদ্ধে। কিন্তু এটা তো বলা যায়, দর্শক বহুদিন পর হলে গিয়েছেন সিনেমাটা দেখতে। ভালো একটি নির্মাণের কদর তারা করেছেন। যারা এই সিনেমার বিরুদ্ধাচারণ করছেন পেছন থেকে তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, ‘হাওয়া’ সিনেমা বন্ধ হয়ে গেলে কী ঘটতো? দর্শককে হলে ফিরিয়ে এনেছে যে সিনেমা তাকেই আমরা গলা টিপে খুন করতে চাইছি!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক সমালোচনার ঝড় তুলে দিলেন একদল মানুষ। কেনো? কারণ তারা এভাবেই সস্তায় দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে। নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতে চেয়েছে।আগেও এরকম হতো তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম না-থাকায় এ ভাবে প্রকাশ করা যেতো না। এখন যার যা ইচ্ছে করছে, বলে ফেলছে। এটাও কিন্তু আমাদের ছিদ্রান্বেষণ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ।
আসলে শেষ কথা হলো, দেশপ্রেম। আমরা অন্যের সমালোচনায় মন দিতে গিয়ে ভুলে যাই দেশটাকে ভালোবেসে ভালো কাজ করা প্রয়োজন।

মিলনের গান গাওয়া ভুলেছি আমরা

মাহবুব রেজা
সাংবাদিক ও লেখক

মানুষের জীবনে এবং সমাজে দ্বন্দ্ব সত্য। দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি আসে ঐক্যের সাধনায়। আমাদের দ্বন্দ্ব বিভাজনকে সামনে আনে বেশি করে। অপরের দোষ খোঁজায় যে আনন্দ তাতে প্রতি মুহূর্তে আমরা বিভাজন রেখা তৈরি করে চলেছি। আর এতে করে পারস্পরিক বিরোধের ক্ষেত্র বড় করছি। আমি আর সে, আমরা আর ওরা করতে করতে সমাজকে বানিয়ে ফেলেছি সাদা না হয় কালো, যেন রক্তের গ্রুপ এর আর বি এবং সেটাও নেগেটিভ। বিভেদ আর সংঘাতের দাপট ক্রমবর্ধমান এবং তাই বিরোধের বদলে মিলনের গান গাওয়া ভুলেছি আমরা।

আগামীতে ছিদ্রান্বেষণই না আমাদের জাতীয় অনুভূতিতে পরিণত হয়

বাঙালির পরশ্রীকাতরতা কিংবা ছিদ্রান্বেষণের প্রসঙ্গটি এলে আমার পুরান ঢাকার একটা অশ্লীল বুলির কথা মনে পড়ে যায়, যেখানে কিছু করতে না পেরে 'বিহান রাইতে' জেগে থাকার কথা বলা হয়েছে। দিন দিন চারদিকের পরিবেশ, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে করে মনে হয় আমাদের আশেপাশের অনেকেই 'বিহান রাত' থেকে জেগে থাকে। তাদের একমাত্র কাজ হলো যারা ভালো কাজ করবে বা করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে 'পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা' নিয়ে সমালোচনা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। অতি সম্প্রতি 'হাওয়া' সিনেমা নিয়ে এই প্রজাতিদের ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে শংকা জাগে, আগামীতে পরশ্রীকাতরতা আর ছিদ্রান্বেষণই না আমাদের জাতীয় অনুভূতিতে পরিণত হয়!

রোকন রহমান
কবি ও সাংবাদিক

মানুষের কর্মে চিন্তায় যে ফুটো থাকে সেটা কেবল বাঙালিই দেখতে পায়

নাসারন্ধ্রে দুটো ফুটো আছে। আছে দেহের আরও কিছু জায়গায়। কিন্তু মানুষের কর্মে চিন্তায় যে ফুটো থাকে সেটা কেবল বাঙালিই দেখতে পায়। এটা বাঙালির এক মহান ঐতিহাসিক গুণ। স্মর্তব্য যে সমালোচনা আর ফুটো খোঁজা বা ছিদ্রান্বেষণ একই বিষয় নয়। সমালোচনা বাংলা সাহিত্যের একটি বিষয়। সমলোচনা সাহিত্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ কলাবিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে যুগ যুগ ধরে চর্চিত। বাঙালী এই বিশ্বের অতি দরিদ্র নাগরিক হিসেবে বেঁচে আছে শত শত বছর। বাঙালের দারিদ্রতা অর্থের নয়। বাঙালীর দারিদ্রতা তার মননের। যে কোনে সৃষ্টিশীল যে নান্দনিক সৃজনে ছিদ্র অন্বেষণ না করলে বাঙালীর ঘুম আসে না। ডিসোপেন, রিভোট্রিল, ক্লোরন ইত্যাদির ঘুমের ওষুধের পরিবর্তে বাঙালী ছিদ্র খুঁজে ও তা পেয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাতে যায়। নতুবা বাঙালীর ঘুম আসে না। এ এক অদ্ভুত জাতি যেখানে আর্য়ুবেদ হোমিপ্যাথ এলোপ্যাথ সব ব্যর্থ- বাঙালীর ঘুমের জন্য। একমাত্র ছিদ্রান্বেষণই বাঙালীর ঘুমের অব্যর্থ ওষুধ।

সকলে দর্শক এখানে। কেউ যদি কিছু করতে চায় তবেই সর্বনাশ। এটা হয়নি। ওটা হয়নি। ওখানে নারীবিদ্বেষ। ঐ জায়গায় বডি শেমিং। এত গালাগাল এত খারাপ মুখের ভাষা। এবং এখন যোগ হয়েছে প্রাণীপ্রেম। ওরে বাঙালী রে! সম্প্রতি ‘হাওয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। আমি ছবিটি দেখার সুযোগ পাইনি এখনও। কিন্তু এই ছবি যে মানুষকে হলমুখি করতে পেরেছে এতেই আমি প্রীত বোধ করছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম বাঙালীর ছিদ্রান্বেষণের অভূতপূর্ব জোয়ার। শেষ পর্যন্ত ‘হাওয়া’ সিনেমা বন্ধে প্রাণী অধিদপ্তর মামলাও করেছে। এত হাস্যকর জনপদ বোধকরি পৃথিবীর আর কোথাও নেই। একজন তরুণ উদ্যোক্তাকে প্রেরণা না দিয়ে শুধু ছিদ্র অন্বেষণে বাঙালী এত শ্রম দেয় যে অনায়াসে সেই শ্রমে নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারে। স্বীয় দেহের ছিদ্রগুলো ঠিকঠাক রেখে আসুন আমরা ছিদ্রান্বেষণের প্রতিযোগিতায় নামি। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর এক নাম্বার জাতি হিসেবে এই শিরোপা অর্জন করবো।

ছবিঃ সালমান সিদ্দিক প্রত্যয়

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199