ডার্ক ট্যুরিজম

মোঃ জুলফিকার আলী

প্রযুক্তি লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 7 Nov 2024

5135 বার পড়া হয়েছে

Shoes

আপনি কি অতিথি সেবা এবং ভ্রমণের সাধারণ সীমানার বাইরে কিছু খুঁজছেন? তাহলে ডার্ক ট্যুরিজম হতে পারে আপনার উত্তর। ডার্ক ট্যুরিজম হলো এক ধরনের ভ্রমণ, যার মাধ্যমে মানুষ এমন সব স্থান, সাইট এবং আকর্ষণ খোঁজে, যেগুলো কোনো না কোনোভাবে মৃত্যু, যন্ত্রণা বা ইতিহাসের অন্ধকার মুহূর্তের সঙ্গে জড়িত। কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত, যারা ডার্ক ট্যুরিজমে আগ্রহী তারা এই সকল শোকাবহ স্থানগুলো পরিদর্শন করেন মানুষের অন্ধকার দিক সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লাভের জন্য। এটি অনুসন্ধান করা কঠিন হতে পারে, তবে এটি আমাদের অশান্ত অতীত এবং বর্তমান সম্পর্কে এমন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যা সাধারণত সহজলভ্য নয়। আপনি যদি এর শিক্ষামূলক মূল্য নিয়ে আকৃষ্ট হন বা শুধুমাত্র বিশ্বের অন্ধকার ইতিহাসের প্রতি কৌতূহলী হন, এই ধরনের ভ্রমণ নিঃসন্দেহে একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা প্রদান করবে। তাই আপনি যদি ডার্ক ট্যুরিজমের গভীরে প্রবেশ করতে প্রস্তুত থাকেন, তাহলে প্রস্তুত থাকুন এক অন্যরকম ভ্রমণ অভিজ্ঞতার জন্য। এবারের আমাদের প্রচ্ছদ কাহিনী ডার্ক ট্যুরিজম নিয়েই ।

ডার্ক ট্যুরিজমের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা কিন্তু বিভিন্ন কারণের উপর ভিত্তি করে। প্রথমত, মানুষ প্রায়শই আমাদের ইতিহাসের অন্ধকার অধ্যায়গুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, যেগুলো আমাদের বর্তমান অবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। কৌতূহলী মনোভাব, শিক্ষামূলক আগ্রহ এবং বিভিন্ন মানবিক সংকট ও তাদের প্রভাব নিয়ে উপলব্ধি লাভ করার আকাঙ্ক্ষা অনেক ভ্রমণকারীকে এমন স্থানগুলোতেই আকর্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ বা কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে ভ্রমণ মানুষকে গভীরভাবে মানব ইতিহাসের কিছু কঠিন সত্যের মুখোমুখি হতে সহায়তা করে।

বার্লিন সাচসেনহাউসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প
বার্লিন সাচসেনহাউসেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

এছাড়াও, ডার্ক ট্যুরিজমের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের জীবনের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করতে পারে। যারা এই ধরনের ভ্রমণে অংশ নেন, তারা প্রায়ই মানুষের সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং মানসিক শক্তি সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি অর্জন করেন। উদাহরণস্বরূপ, হিরোশিমার শান্তি মেমোরিয়াল বা "গেনবাকু ডোম" এর মতো স্থানগুলোতে দর্শকরা যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হন এবং শান্তির গুরুত্বকে উপলব্ধি করেন।

একইসঙ্গে, এই ধরনের ট্যুরিজম সাম্প্রতিক বা পুরনো মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করে।  আওকিগাহারা বন বা "আত্মহত্যার বন" মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক। একইভাবে, এমন সব স্থান যেমন সিডির শান্তির জন্য বিখ্যাত কিছু স্থান মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা এবং মমতা জাগ্রত করতে সাহায্য করে।

এছাড়াও, কিছু ভ্রমণকারী ডার্ক ট্যুরিজমে অংশ নেন শুধুমাত্র রোমাঞ্চের জন্য। ভুতুড়ে স্থান বা ঐতিহাসিক স্থানগুলোতে ভ্রমণের রোমাঞ্চ তাদেরকে আকর্ষণ করে। তবে এই ধরনের স্থানে ভ্রমণের সময় সংবেদনশীল এবং সতর্ক থাকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই স্থানগুলো প্রায়শই মানুষের দুঃখ-দুর্দশার সাক্ষী হয়ে আছে।

ডার্ক ট্যুরিজমের এই বিশেষ প্রকৃতি ভ্রমণকারীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। এমন স্থানে ভ্রমণ কেবলমাত্র ঐতিহাসিক আগ্রহের জন্য নয়, বরং সেই ঘটনাগুলো সম্পর্কে মানুষের উপলব্ধি এবং বোঝাপড়া বাড়ানোর জন্য হওয়া উচিত। তাই, ডার্ক ট্যুরিজমের উদ্দেশ্য হিসেবে শুধুমাত্র বিনোদন নয়, বরং অতীতের দুঃখজনক ঘটনার প্রতি শ্রদ্ধা জানানোও অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।

ডার্ক ট্যুরিজমের মাধ্যমে ভ্রমণকারীরা আমাদের ঐতিহাসিক ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারেন। এই স্থানগুলো মানুষের ইতিহাসে অনাকাঙ্ক্ষিত অধ্যায় হিসেবে থেকে গেলেও, এগুলো একেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা স্থল, যা আমাদের মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

প্রিপিয়াত, ইউক্রেন

ডার্ক ট্যুরিজমের শুরু আসলে নির্দিষ্ট সময় বা ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তবে ধারণাটি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ১৯৯০-এর দশকের দিকে। "ডার্ক ট্যুরিজম" শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৯৬ সালে, যখন গ্লাসগো ক্যালেডোনিয়ান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন লেনন এবং ম্যালকম ফোলে তাদের গবেষণায় এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তাদের মতে, এই ধরনের পর্যটনের মূল উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে সেইসব স্থান সম্পর্কে কৌতূহল ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা, যেখানে মৃত্যু, দুঃখ ও ধ্বংসের মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে।
ডার্ক ট্যুরিজমের ঐতিহাসিক শিকড় আরও প্রাচীন যুগ পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। শত শত বছর আগেও মানুষ বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র এবং ঐতিহাসিক ঘটনার স্থান পরিদর্শন করতেন। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগে যখন কোনো বড় যুদ্ধ বা ট্রায়ালের পর জনসম্মুখে শাস্তি দেওয়া হতো, তখন মানুষের ভিড় জমতো সেইসব স্থানগুলোতে। একধরনের সামাজিক কৌতূহল এবং রোমাঞ্চ থাকতো এমন ঘটনার প্রতি, যা অনেকটা ডার্ক ট্যুরিজমের প্রাথমিক রূপ বলা যেতে পারে।

ডার্ক ট্যুরিজমের বিকাশের বিভিন্ন ধাপ:
* ধ্বংসাত্মক ঘটনাগুলোর স্থান: ডার্ক ট্যুরিজমের ধারণা মূলত গড়ে ওঠে এমন স্থানগুলোকে ঘিরে, যেখানে অতীতে বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটেছে। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, পার্ল হারবার, এবং হিরোশিমা-নাগাসাকির ঘটনাস্থল পরবর্তীতে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
* প্রাকৃতিক ও প্রযুক্তিগত দুর্যোগ: কিছু ডার্ক ট্যুরিস্ট সাইট প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা প্রযুক্তিগত দুর্ঘটনাগুলোর কারণে পরিচিত হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, চেরনোবিল পরমাণু বিপর্যয়ের স্থান এবং জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিপর্যয়ের স্থান পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। এর পেছনের কারণ হচ্ছে মানুষের মধ্যে সেই ঘটনাগুলোর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষা এবং এক প্রকারের উত্তেজনা।
* ঐতিহাসিক নিপীড়নের স্থান: বিভিন্ন নিপীড়নের ইতিহাস বহনকারী স্থানগুলোও ডার্ক ট্যুরিজমের আওতায় পড়ে। যেমন, কম্বোডিয়ার "কিল্ডিং ফিল্ডস" বা রুয়ান্ডার গণহত্যার স্থানগুলিতে মানুষ এসে সেই ট্র্যাজেডির বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে চান।
* ভূতুড়ে ও অতিপ্রাকৃত স্থান: ডার্ক ট্যুরিজমের আরেকটি অংশ হলো ভূতুড়ে ও অতিপ্রাকৃত স্থান, যেখানে স্থানীয় কিংবদন্তি ও লোককাহিনীগুলোর ভিত্তিতে পর্যটকদের আগ্রহ জন্মায়। স্কটল্যান্ডের এডিনবরার ভূতুড়ে স্থান, জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট এবং মেক্সিকোর "পুতুলের দ্বীপ" এই ধরনের স্থান দেখা।

কয়েকটি কারণ মানুষকে ডার্ক ট্যুরিজম গন্তব্যে অন্বেষণ করতে পরিচালিত করে:
ঐতিহাসিক আগ্রহ: অনেকে এই সাইটগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বিশ্বের উপর তাদের প্রভাব সম্পর্কে জানতে আকৃষ্ট হন

চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা
চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনা

ব্যক্তিগত প্রতিফলন: অন্ধকার পর্যটন মৃত্যু, দুঃখ এবং মানব অবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিগত প্রতিফলনের জন্য একটি স্থান প্রদান করতে পারে।

সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া: এই স্থান পরিদর্শন করা বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে।

থ্রিল-সন্ধানী: কিছু লোক কেবল ম্যাকব্র এবং রহস্যময়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

ডার্ক ট্যুরিজমের নৈতিক বিবেচনা
ডার্ক ট্যুরিজম একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা হতে পারলেও, এটি সংবেদনশীলতা এবং সম্মানের সঙ্গে যোগাযোগ করা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে কিছু নৈতিক বিবেচনা রয়েছে:
ভিকটিমদের প্রতি সম্মান: সর্বদা এই স্থানগুলির সঙ্গে যুক্ত মানবিক দুঃখ মনে রাখুন এবং অসম্মানজনক আচরণ এড়িয়ে চলুন।

দায়িত্বশীল খরচ: এই স্থানগুলির সংরক্ষণে ইতিবাচক অবদান রাখা স্থানীয় সম্প্রদায় এবং ব্যবসায়ীদের সমর্থন করুন।

শিক্ষামূলক উদ্দেশ্য: ওই সব স্থানের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য শিখতে এবং বুঝতে চেষ্টা করুন।

মনোযোগী ফটোগ্রাফি: বিশেষ করে সংবেদনশীল এই  জায়গাগুলিতে ছবি তোলার বিষয়ে সচেতন হন। অন্যদের দুঃখকে সেনসেশনালাইজ বা শোষণ করা এড়িয়ে চলুন।

শীর্ষ ডার্ক ট্যুরিজম গন্তব্য
আলকাট্রাজ দ্বীপ, যুক্তরাষ্ট্র: আলকাট্রাজ দ্বীপটি সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরে অবস্থিত এবং এক সময় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার একটি কারাগার। এটি ১৯৩৪ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত একটি ফেডারেল কারাগার হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে এমন সব কুখ্যাত অপরাধীদের রাখা হতো, যারা পালানোর জন্য বিখ্যাত ছিলো। আল কাপন, "মেশিন গান" কেলি এবং রবার্ট "দ্য বার্ডম্যান" স্ট্রাউডের মতো অপরাধীরা এখানে বন্দি ছিলেন। কঠোর নিরাপত্তা, ঠাণ্ডা জলরাশি এবং কঠিন জীবনযাপনের জন্য এটি দুর্ভেদ্য বলে মনে করা হতো। আজ আলকাট্রাজ একটি জাদুঘরে পরিণত হয়েছে, যেখানে দর্শকরা কারাগারের ইতিহাস এবং বন্দিদের কাহিনী সম্পর্কে জানতে পারেন। এখানে কারাগারের কক্ষে দাঁড়িয়ে দর্শকরা এক ধরণের ভীতিকর অনুভূতি পেতে পারেন এবং বন্দিদের কঠোর জীবন কেমন ছিলো, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন।

আলকাট্রাজ দ্বীপ, যুক্তরাষ্ট্র
আলকাট্রাজ দ্বীপ, যুক্তরাষ্ট্র

আউশউইৎজ-বির্কেনাউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, পোল্যান্ড: আউশউইৎজ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের দ্বারা নির্মিত বৃহত্তম কনসেনট্রেশন এবং নির্যাতন শিবিরের একটি কমপ্লেক্স, যা পোল্যান্ডের ওসউইচিমে অবস্থিত। এই শিবিরে লক্ষ লক্ষ ইহুদি, রোমা জনগোষ্ঠী এবং অন্য সংখ্যালঘুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিলো। এটি এখন একটি স্মৃতিসৌধ এবং মিউজিয়াম হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে দর্শনার্থীরা হোলোকাস্ট সম্পর্কে জানার সুযোগ পান। আউশউইৎজের গ্যাস চেম্বার, মৃত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র এবং তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এখনও এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এটি একটি এমন জায়গা, যেখানে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর সাক্ষী হওয়া যায়। আউশউইৎজ শুধু শিক্ষা নয়, বরং মানবিক চেতনা ও সহমর্মিতার গুরুত্বও স্মরণ করিয়ে দেয়।

পুতুলের দ্বীপ (ইসলা দে লাস মুনেকাস), মেক্সিকো: মেক্সিকো সিটির দক্ষিণে অবস্থিত জোচিমিলকো অঞ্চলে "পুতুলের দ্বীপ" নামে পরিচিত একটি স্থান রয়েছে, যা ভয়ঙ্কর ও অদ্ভুত রূপে দর্শকদের আকর্ষণ করে। স্থানটির গল্প শুরু হয়েছিলো, যখন দ্বীপটির একমাত্র বাসিন্দা ডন জুলিয়ান সান্তানা একটি ডুবে যাওয়া মেয়ের পুতুল পান এবং এটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে দেন, মনে করেন যে এটি অশুভ আত্মাকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে। তারপর থেকে তিনি আরও পুতুল সংগ্রহ করে পুরো দ্বীপটিতে ঝুলিয়ে দেন। আজও, এই পুতুলগুলো ঝুলন্ত অবস্থায় ক্ষয়ে গেছে, চোখ এবং মুখ বিকৃত হয়েছে, যা দ্বীপটিকে একটি ভয়ঙ্কর চেহারা প্রদান করেছে। পুতুলের দ্বীপে যাওয়া এক অভিজ্ঞতা, যেখানে দর্শকরা এক ধরনের ভৌতিক অনুভূতি এবং স্থানটির রহস্যময় ইতিহাস উপলব্ধি করতে পারেন।

আওকিগাহারা বন, জাপান: আওকিগাহারা, যা "গাছের সমুদ্র" নামেও পরিচিত, এটি জাপানের মাউন্ট ফুজির পাদদেশে অবস্থিত একটি ঘন বন। অত্যন্ত ঘন গাছপালা এবং শান্ত পরিবেশের কারণে এটি অত্যন্ত রহস্যময় এবং নিঃসঙ্গ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আওকিগাহারা বনটি "আত্মহত্যার বন" হিসেবেও পরিচিত, কারণ বহু মানুষ এখানে আত্মহত্যা করেছেন। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা এবং জাপানের ঐতিহ্যবাহী চেতনা বোধের সঙ্গে এই স্থানের যোগসূত্র রয়েছে। এখানে একটি হাঁটা পথে বা গাছের মধ্যে ঘোরাঘুরি করলে গভীরভাবে একাকীত্ব এবং অজানা শোক অনুভূত হয়। আওকিগাহারা ভ্রমণকারীদের জন্য একটি স্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে তারা মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মহত্যা প্রতিরোধ এবং এই সমস্যার সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সামাজিক বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করতে পারেন।

প্রিপিয়াত, ইউক্রেন: ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর প্রিপিয়াত শহর সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এটি একসময় ছিলো জীবন্ত শহর, যেখানে চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মী ও তাদের পরিবার বসবাস করতেন। কিন্তু দুর্ঘটনার পর শহরটিকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়, এবং আজ এটি একটি ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। শহরের রাস্তাগুলো এখন জনমানবহীন, এবং স্থাপনাগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় যেন একটি পরকালের ল্যান্ডস্কেপে আছেন, যেখানে সময় স্থির হয়ে গেছে। শহরের স্কুল, হাসপাতাল এবং থিম পার্ক আজও দুর্ঘটনার দিনটির সাক্ষী হয়ে রয়েছে, যেখানে খালি খেলার সামগ্রী, ক্লাসরুমের বই এবং পরিত্যক্ত সরঞ্জামগুলো এখনও একই অবস্থায় পড়ে আছে।

দ্য কিল্ডিং ফিল্ডস, কম্বোডিয়া: খমের রুজ শাসনের সময়, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত, কম্বোডিয়ায় প্রচুর মানুষ নির্মম অত্যাচারের শিকার হন। "কিল্ডিং ফিল্ডস" নামে পরিচিত এই স্থানটি সেই অত্যাচারের একটি নির্মম স্মারক। পল পট এবং তার শাসনের সময়ে হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তাদের মৃতদেহ এখানে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এখন এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে, যা পৃথিবীকে এই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দর্শনার্থীরা এখানে নীরবে দাঁড়িয়ে ভুক্তভোগী মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারেন এবং এই ধরনের মানবিক অপরাধের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থানকে নতুন করে উপলব্ধি করতে পারেন।

প্যারিসের ক্যাটাকম্বস, ফ্রান্স
প্যারিসের ক্যাটাকম্বস, ফ্রান্স

ব্ল্যাক ফরেস্ট, জার্মানি: জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট, বা "শোয়ার্জওয়াল্ড," একটি ঘন, গাঢ় বন যা তার রহস্যময় সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। তবে, এটি শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং জার্মান লোককাহিনী, জাদুটোনা এবং ভয়ঙ্কর কাহিনীগুলোর একটি অন্ধকার ইতিহাসও বহন করে। স্থানীয় কাহিনীগুলোতে এই বনকে ভূত, ডাইনিদের বিচরণক্ষেত্র এবং প্রাচীন জাদুটোনার জন্য পরিচিত স্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই বনে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে এক ধরনের অজানা ভয়ের অনুভূতি কাজ করে। ব্ল্যাক ফরেস্টের গভীরে হারিয়ে গেলে যেন মনে হয় যে এখানকার গাছগুলো অনেক গোপন কথা জানে, যা চিরকাল অজানাই থেকে যাবে। এই বনে ঘোরাঘুরি করাও এক ধরনের ডার্ক ট্যুরিজম অভিজ্ঞতা প্রদান করে।

প্যারিসের ক্যাটাকম্বস, ফ্রান্স: প্যারিসের ক্যাটাকম্বস হলো এক বিস্ময়কর ভূগর্ভস্থ স্থান, যেখানে লক্ষ লক্ষ প্যারিসবাসীর দেহাবশেষ রয়েছে। ১৮ শতকে প্যারিসের কবরস্থানগুলো ভরে যাওয়ার কারণে এখানকার হাড়গুলো এই ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলোতে স্থানান্তর করা হয়। এই সুড়ঙ্গগুলো প্রায় ২০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত, তবে মাত্র সামান্য অংশই পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। ভেতরে প্রবেশ করলে সারি সারি হাড় ও খুলি দেখতে পাবেন, যা একধরনের ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা প্রদান করে। প্যারিসের ক্যাটাকম্বস আজও একটি জনপ্রিয় ডার্ক ট্যুরিজম আকর্ষণ, যেখানে মানুষ অতীতের প্যারিসবাসীদের সাথে এক ধরনের অদ্ভুত যোগাযোগের অনুভূতি লাভ করে।

ডার্ক ট্যুরিজমের মূল উদ্দেশ্য হলো সেইসব জায়গাগুলোর ইতিহাস জানা, যেখানে মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং লড়াইয়ের কাহিনি লুকিয়ে আছে। এটি পর্যটকদেরকে শুধু বিনোদন নয়, বরং ইতিহাস ও শিক্ষার সংমিশ্রণ দেয়। এটি মানুষের মাঝে অতীতের প্রতি সহানুভূতি, সচেতনতা এবং গভীর উপলব্ধির জন্ম দেয়। তবে এমন স্থানগুলিতে পর্যটকদের বিশেষ সংবেদনশীলতা এবং সম্মান বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ছবি: গুগল

 

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199