ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবেরা

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 17 Oct 2019

1900 বার পড়া হয়েছে

Shoes

দানব কাকে বলে?কোথায় তাদের বসবাস?কোন পাহাড়ে, জঙ্গলে অথবা মেঘলোকে তারা তাদের ক্ষিপ্ত চলাফেরা আর আক্রোশে সবকিছু লণ্ডভন্ড করার ইচ্ছা দিয়ে স্তম্ভিত এক রাজত্বের অধিকার কায়েম করে রেখেছে? দানবদের এমনি ধারণা আর বিবরণ আমাদের শিশুমনকে একটা সময়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো রূপকথার বই থেকে উঠে এসে। আর সাহিত্যের রোমান্টিক যুগে বিখ্যাত ইংরেজ কবি পার্সি শেলীর স্ত্রী মেরী শেলী ‘ফ্রাঙ্কেনস্টাইন’ নামে উপন্যাস লিখে তোলপাড় ফেলেছিলেন সাহিত্য জগতে। উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পেশায় ছিলেন বিজ্ঞানী। তিনি বিদ্যুৎ চমকানোর সময় মেঘ থেকে পতিত বিদ্যুৎ থেকে মৃত মানুষকে পুনরুজ্জীবিত করতে গিয়ে ভুলক্রমে একটি দানব সৃষ্টি করে ফেলেন। সেই দানবটি ক্রমান্বয়ে একের পর এক মানুষ হত্যা করতে শুরু করে হতাশা থেকে। একপর্যায়ে বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের স্ত্রী এলিজাবেথকেও হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি তারেই সৃষ্ট সেই দানব। সেই ভয়ংকরদর্শন দানব খুঁজেছিলো তার সঙ্গী। সেই দানবকে নিয়ে লেখা আশ্চরয প্রতিকী উপন্যাসটি পৃথিবীতে আজো বহুল আলোচিত। সেই ভয়াল দানবটির পরিচয়ও দাঁড়িয়ে গেছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হিসেবেই।

পৃথিবীজুড়ে যুগে যুগে মানুষ প্রতিকী অর্থে এই দানব তৈরি করেছে।শাসক, নিয়ন্ত্রক আর স্বৈরাচারী মানসিকতার মানুষ তাদের বর্বরতা আর ক্ষমতার লোভকে চিরস্থায়ী করতে মেরী শেলীর উপন্যাসের মতো তৈরি করছে দানব। এই দানবদের দানবীয় উল্লাসে চমকে উঠেছে শান্তিপ্রিয় মানুষ। তারা ভয় পেয়েছে, প্রতিরোধ করেছে, যুদ্ধ করেছে এই দানবদের ভয়াবহ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধে কখনো মানুষ জয়ী হয়েছে আবার কখনো দানব অথবা দানবরূপী সেই মানুষের দল।

আজকের বাংলাদেশও এমনি কিছু দানবদের উল্লাসমঞ্চ। তারা কেউ-ই একদিনে মাটি ফুঁড়ে বের হয়ে আসেনি। একটু একটু করে তাদের তৈরি করেছে আরেকদল মানুষ। যারা এই দেশকে, দেশের ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে।   

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো দানবদের নিয়ে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবেরা’।

মেরী শেলীর বিখ্যাত উপন্যাসটি লেখার দু‘শো বছর অতিক্রম করেছে। কিন্তু সেই দানবের ছায়া কি আমাদের প্রতিদিনের জীবন থেকে অপসৃত হয়েছে? আমরা চারপাশে কী দেখছি? মেরী শেলীর সেই দানব চরিত্রটি এখন শাসন করছে আমাদের চারপাশ, আমাদের মানসিকতা। পিতা বীভৎস পদ্ধতিতে খুন করছে সন্তানকে, রাজনীতির অনুগত গুণ্ডা বাহিনী পিটিয়ে খুন করছে সহপাঠীকে, ভালোবাসার অপরাধে প্রেমিককে হাত কেটে, চোখ উপড়ে নিয়ে খুন করেছে প্রেমিকার সহদোরেরা, কিশোরকে চুরির অপরাধে খুন করা হয়েছে পিটিয়ে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এমন সব খবরই এখন শিরোনাম। আর শুধু কী বাংলাদেশ? পৃথিবীর কোন প্রান্ত আজ নিরাপদ এই দানবীয় শক্তির বিকাশের হাত থেকে? নিষ্ঠুরতার এই সহজ চাষাবাদ দেখে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের সেই অমোঘ লাইন ‘পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ আজ’।

দানবের ইংরেজি নাম মনস্টার। অভিধানের বিবরণে বলা আছে, দানব হচ্ছে এক ধরণের বিচিত্র জীব যার চেহারা ভয়ঙ্কর এবং যার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা মানব বিশ্বের সামাজিক বা নৈতিকতার জন্য হুমকি স্বরূপ।

একটি দানব বা দৈত্য মানুষও হতে পারে, কিন্তু লোককাহিনীতে সাধারণতে দানবের বিবরণ দেয়া হয়েছে, নীচুশ্রেণীর, রূপান্তরিত, বিকৃত, অতিপ্রাকৃত এবং পারলৌকিক প্রাণী হিসেবে।

গ্রিক ও ভারতীয় পূরাণে এই দানবদের নানা কাহিনির বিবরণ আছে। গ্রীক পৌরানিক কাহিনীতে বর্ণীত আছে, ক্রিটের রাজা মিনোস সমুদ্র দেবতা সাদা ষাড় পসেইডনকে বলিদান না করায় মিনোসকে ইশ্বরের মুখোমুখি করা হয় বিচারের জন্য।এই অপরাধে  মিনোসের স্ত্রী পাসিফাইকে শাস্তি দেয়া হয়। পাসিফাই ষাড়ের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে এবং সেই ষাড়ের সঙ্গে মিলিত হয়। পসিফাই ষাড়ের মাথাওয়ালা মানব সন্তান মাইনেটোর জন্ম দেয়।

মানব দানব হলো যারা কখনই সম্পূর্ণ মানব হিসেবে জন্ম নেয়নি। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় গ্রিক দেবী মেডুসা এবং তার বোনের কথা। অথবা যারা কিছুটা অতিপ্রাকৃতিক বা অস্বাভাবিক কারণে তাদের মানবিকতা হারিয়েছে যেমন ওয়ারউলভস। এরা কখনোই মানব সমাজের নিয়মনীতি মেনে চলতে পারে না।

দানবদের নিয়ে প্রাচীন ইতিহাস এবং তাদের সম্বন্ধে সমাজের ভিতরে বিশেষ সাংস্কৃতিক বিশ্বাস নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা মনস্ট্রোফি নামে পরিচিত।

দানবদের কল্পিত কাহিনি নিয়ে যতোই চর্চা আর গবেষণা হোক না কেনো মানুষরূপী আসল দানবদের উত্থানের গল্প তো পৃথিবীতে নতুন নয়। আর যুগে যুগে এই দানবদের উত্থান ঘটেছে রাজনীতির হাত ধরেই। হিটলার নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি করেছিলো বিশেষ ফ্যাসিস্ট বাহিনী। ইতালীর দু:শাসক মুসোলিনীও তাই। দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় এ ধরণের বাহিনীর কথা আজো শোনা যায়। এই বাহিনীগুলো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, কথা বলার স্বাধীনতাকে চিরতরে মাটিচাপা দিতেই ব্যবহৃত হয়েছে। এখন মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান আর ভারতের মতো দেশেও তৈরি হয়েছে এ ধরণের দানবীয় শক্তির বাহিনী। আমাদের স্বদেশভূমিও কি এসব থেকে দূরে থাকতে পেরেছে। মধ্যপ্রচ্য এবং আফগানিস্তানে ইসলাম ধর্মের নামে উগ্রবাদী বাহিনীগুলোর চালানো তাণ্ডবের কাহিনি সবারই জানা।

এই দানব অথবা দানবীয় শক্তির বিকাশের পেছনে রয়েছে ধারাবাহিক নিষ্ঠুরতার ইতিহাসও। কোত্থেকে আসে এই নিষ্ঠুরতা। উত্তরে বলা যায়, সমাজের ভেতরে একটি শ্রেণী প্রতিদিন একটু একটু করে ছড়িয়ে দিচ্ছে নিষ্ঠুরতার বিষাক্ত ওষুধ। পোকা মারার বিষের মতো সেই নিষ্ঠুরতা সমাজগুলোতে তৈরি করছে ভয়ংকর ভারসাম্যহীন এক অবস্থা। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় শঞর অথবা গ্রামে আমরা দেখছি নির্বিকার নিষ্ঠুরতার বিকাশ। প্রোকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র খুন থেকে শুরু করে সুদূর মফস্বলে পিতার হাতে সন্তানের খুন হয়ে যাওয়া কী প্রমাণ করে? প্রমাণ করে আমাদের সমাজে বাসা বেঁধেছে নিষ্ঠুরতা। আর এই নিষ্ঠুরতাকে পুঁজি করে একদল মানুষ বিকশিত করছে দানদের সংস্কৃতি। অনুগত, পেটোয়া বাহিনী তৈরি করে তারা রাজনীতির শ্লোগান তুলে দখল করে নিতে চাইছে মানুষের আত্মা।

কেন মানুষ এত হিংস্র হয়ে ওঠে?কেন অমানুষিকতা এভাবে উন্মোচীত হয়? মানুষের এই অমানবিক আচরণ আসলে তার পাশবিক প্রবৃত্তির প্রকাশ।

মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, এই ধরনের আচরণের পেছনে রয়েছে মানুষের অবদমিত কামনা-বাসনা, যাকে তিনি তুলনা করেছেন অবচেতন মনের খিড়কি খুলে দেওয়ার সঙ্গে। অবচেতনে মানুষ যা কামনা করে, চেতন মনে সে তার শিক্ষা, সভ্যতা, সামাজিকতা আর নৈতিকতা দিয়ে সেগুলো ঢেকে রাখে। সেই অবদমিত কামনা—সরাসরি পূরণ হয় না বলে হিংস্রতা আর নৃশংসতার মধ্য দিয়ে ঘুরপথে পূরণ করার চেষ্টা চলে। কখনো এই হিংসতার প্রকাশ মানুষ একাই ঘটায়। আবার কখনো তা প্রকাশ করতে আশ্রয় নেয় যূথবদ্ধতার। এভাবেই মিলিত হিংসার জোরে তারা খুন করে ফেলে নিজের বহুচেনা মানুষটিকে। ফরাসী মনোবিজ্ঞানী এই হিংস্রতার প্রকাশকে `মবসাইকোলজি বা ক্রাউড সাইকোলজি‘ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই বিজ্ঞানীর মতে মানুষ কখনো এই অবদমিত কামনাকে দলবদ্ধ হয়েও প্রকাশ করে এবং পুরো মানসিকতাটা ছোঁয়াচে হয়ে ছড়িয়ে পড়ে অন্যদের মাঝেও। ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টালে দেখা যায় ১৪৩১ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসী দেশের জোয়ান অব আর্ককে ডাইনি অপবাদ দিয়ে দলবদ্ধ মানুষ পুড়িয়ে মেরেছিলো।

মানুষের মধ্যে এই হিংস্রতা অথবা দানবীয় আচরণকে মনোবিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছে, মানুষ নিজের হতাশা কাটাতে, নিজের অপ্রাপ্তিজনিত হতাশাকে দূরে ঠেলতে তার নিজের চেয়েও দূর্বল কাউকে বেছে নেয় শিকার হিসেবে। আর এই দূর্বলের ওপর হিংস্রতা প্রকাশ করে এক ধরণের তৃপ্তি পেতে চায়।এই তত্ত্বকে বলা হয় ফ্রাস্ট্রেশন-অ্যাগ্রেসন হাইপোথিসিস।কিন্তু যতোই আমরা মানুষের এই অমানুষিকতাকে নানা তত্ত্বের আড়ালে দাঁড় করাতে চাই না কেন পৃথিবী কিন্তু এই দানবীয় শক্তির কাছেই ধরে ধরে আত্মসমর্পন করছে।

কারা তৈরি করছে এই শক্তিকে? তারাই করছে যাদের কাছে ক্ষমতা, লোভ আর যুদ্ধের নেশা আজো শাসনের প্রধান হাতিয়ার। যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখ বন্ধ করে নিজের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু সে পথে কি সফলতা আসে। মেরী শেলীর উপন্যাসে মানুষের তৈরি দানবকে দিয়ে সে কাজটা করা সম্ভব হয়নি। বরং উল্টো দানব নিজের স্রষ্টার জীবন নাশ করতেই উদ্যত হয়েছিলো। যুগে যুগে এই দানবরা তাই করে থাকে। কিন্তু যারা তাদের তৈরি করে তারাই এই সত্যটি বিশ্বাস করতে চায় না।

আমাদের সাহিত্যে, পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে দানবের উপস্থিতি আছে। উপন্যাসের জগতে সুপরিচিত দানবগুলোর মধ্যে আছে কাউন্ট ড্রাকুলা, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের তৈরি দানব, মমি আর জম্বি। দীর্ঘদিন থেকেই সাহিত্যে দানবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মহাকাব্য বেউলফ-এ পানির দানব গ্রেনডেল একজন বিকৃত, নৃশংস, প্রচন্ড শক্তিশালী এক আদিম দানব। এটি শিকার ধরা ও খাওয়ার জন্য রাত্রীবেলা মানব বসতিতে হামলা চালাত। নানা ধরণের কল্পবিজ্ঞানের গল্পেও এই দানব চরিত্রের উপস্থিতি দেখা যায়।

দানবদের গল্প কিন্তু শেষ হওয়ার নয়। পৃথিবীতে ক্ষমতা আর সম্পদের লোভ যত দিন থাকবে সেগুলো রক্ষা করার জন্য দানবদেরও আবির্ভাব ঘটবে। তবে সত্য হচ্ছে এই দানবদের বিরুদ্ধ মানুষের সংগ্রামের গল্পটিও কিন্তু সুপ্রাচীন।

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া
ছবি: গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199