ইতি, চায়ের দোকান...

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 1 Jun 2023

4975 বার পড়া হয়েছে

Shoes

শীত আসার মুখে মশার উৎপাত যখন তুঙ্গে তখনও গলির পেটের মধ্যে চায়ের দোকানে সন্ধ্যাবেলা তাদের আড্ডা শেষ হতো না। নড়বড়ে বেঞ্চ, টিন দিয়ে ঘেরা কেরসিনের চুলায় বসানো কেতলি, কনডেন্স মিল্কের কৌটা, পডলিথিনে চিনি আর কয়েকটা চায়ের কাপ নির্বাক হয়ে তাদের গল্প শুনতো। চায়ের দোকানের  সময় তো দালির আঁকা সেই বিখ্যাত গলে যাওয়া ঘড়িতে আটকে থাকে; বোঝা যায় না চলছে না থেমে আছে!

সন্ধ্যাবলা মশার উৎপাত ঠ্যাকাতে বাবলু এক মুখ কেরসিন আকাশে ফোয়ারারমেতো ছিটিয়ে ফেলতো আর তার বন্ধুরা পুরনো কাগজে ধরানো মশালের মতো আগুন এগিয়ে ধরতো, ব্যাস, চোখের পলক পড়ার আগে কেরসিন ছোঁয়া আগুনের বৃত্তে মশাদের সহমরণ।মশা মেরে আড্ডা চালাতে হবে। এক সংসার গল্প তো এখনো বাকি! বহু বছর আগে, খুব বৃষ্টির দিনে চায়ের দোকানের বাঁশের ঝাপ অর্ধেক নামিয়ে সেই আড্ডা চলতেই থাকতো কোনো দুপুর অথবা বিকেলে। চায়ের দোকানের আড্ডা ফুরায় না। লেনিন বলেছিলেন, ‘‘জেলই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়’’। আর চায়ের দোকানের আড্ডাবাজদের শ্লোগান বোধ হয়, ‘‘চায়ের দোকানই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়’’।

পৃথিবীর সবচেয়ে জোরালো আড্ডার জায়গা বোধ হয় তিনটা-চায়ের দোকান, কফির দোকান আর মদের দোকান। কিন্তু বাঙালির কাছে চায়ের দোকানের চেয়ে বড় আড্ডা বোধ হয় আর নেই। রাজনীতি, সিনেমা, প্রেম, ক্রিকেট, বাজারদর, পরচর্চা-খোলায় দেয়া মুড়ির মতো ছটফট করে ফুটতে থাকে চায়ের দোকানে। এই শহরে গলির মোড় থেকে শুরু করে রাজপথে চায়ের দোকানের সংখ্যাটা লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে বলেই মনে হয়। অভিজাত এলাকায় এখন ঝকঝকে চায়ের দোকানে হরেক স্বাদের চা বিক্রি হচ্ছে। মহা উৎসাহে পালিত হচ্ছে চা দিবসও।

কাজী নজরুল ইসলামের চায়ের প্রতি টান ছিলো রীতিমতো কিংবদন্তীতুল্য। কিছুক্ষণ পর পর চা না পেলে তাঁর চলতই না। কথিত আছে, যথেষ্ট পরিমাণ চা ও পান দিয়ে কবিকে একটা ঘরে আটকে রেখে বহু গান লিখিয়ে এবং সুর করিয়ে নিয়েছিলেন গ্রামোফোন কোম্পানির কর্মকর্তারা। কবি নজরুলের চা-প্রীতি প্রসঙ্গে কবি জসীম উদ্‌দীন তাঁর ‘যাঁদের দেখেছি’ স্মৃতিকথায় কাজী নজরুল ইসলামের চায়ের নেশা নিয়ে লিখেছেন, “রাত্রিবেলা এক মুস্কিলে পড়া গেল। চা না পাইয়া কবি অস্থির হইয়া উঠিলেন। এই পাড়াগাঁয়ে চা কোথায় পাইব? নদীর ওপারে গিয়া যে চা লইয়া আসিব, তাহারও উপায় নাই। রাত্রিবেলা কে সাহস করিয়া এত বড় পদ্মা-নদী পাড়ি দিবে? তখন তিন-চার গ্রামে লোক পাঠান হইল চায়ের অনুসন্ধানে। অনেক খোঁজাখুজির পর আলিম মাতব্বরের বাড়ি হইতে কয়েকটা চায়ের পাতা বাহির হইল। তিনি একবার কলিকাতা গিয়া চা খাওয়া শিখিয়া আসিয়াছিলেন। চা-পাতা দেখিয়া কবির তখন কী আনন্দ!”

অসংখ্য চায়ের দোকান ছড়িয়ে আছে এই শহরের আনাচে কানাচে। আড্ডার উত্তর অথবা দক্ষিণ মেরু সেখানে এসে এক বিন্দুতে মিলেও যায়। কিন্তু গল্প হয়ে উঠতে পেরেছে কয়টি দোকান? মনে হয় কাঠ, বাঁশ আর বেড়া দিয়ে তৈরি নিভু নিভু সামান্য চায়ের দোকানের অসংখ্য গল্প আজও অজানার খাতাতেই লেখা হয়ে আছে। চায়ের দোকানে আড্ডার ছায়ায় গভীর ভাবে মিশে থাকে দোকানীর গল্পটাও। কোথায় তার বাড়ি, কোথায় ঘর ছিলো চায়ের দোকানে বসে কেতলি থেকে হাওয়ায় মিশে যাওয়া বাষ্পের মতো সেই গল্পগুলোও হারিয়ে যায়, গেছেও। আড়ালেই থেকে গেছে সত্তরের দশকের শেষ অথবা আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাড়ায় বিখ্যাত হাকিম ভাই অথবা শহীদের জীবনের গল্প। দোকানের দুধ, চায়ের পাতা, কাপ আর কেতলির সম্পর্কের জায়গাটাই বড় হয়ে ওঠে। হয়তো তাদের জীবনেও এমনটাই ঘটেছিলো। আজ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে সেই গল্পগুলোর জানারও কোনো উপায় নেই!

পাড়ার চায়ের দোকানের গল্প তবুও ঘুরেফিরে আসে। কোনো কোনো বর্ষায় কেউ হয়তো খুঁজতে যায় সেই দোকানগেুলো। স্মৃতির কোনো শীতের সকালে জমাট আড্ডার কন্ঠস্বরগুলো কারো কারো শ্রবণে আজও অনুরণন তোলে। কোনো শ্যাওলা ধরা দেয়ালের ধার ঘেঁষে সামান্য চায়ের দোকানে রাজা উজির মারা গল্প পাল্টে যাওয়া শহরের ভাঁজে অবহেলাতেই মুখ লুকায় হয়তো। তবুও চায়ের দোকান গল্প লেখে। বহু মানুষের স্মৃতির পুকুরে পুরনো মাছের মত বুদবুদ ছড়িয়ে যায়।

কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় লিখেছেন,

গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম।

ছবিঃ গুগল ও প্রাণের বাংলা

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199