আমাদের সেই বারান্দায়...

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 11 Oct 2018

1165 বার পড়া হয়েছে

Shoes

এক সময় আমি বারান্দায় ঘুমাতাম। সে অনেক বছর আগের কথা। গায়ে-মাথায়র দ্রুত বড় হয়ে যাওয়ায় ঘর ছেড়ে প্রথমে ঠাঁই হলো বসবার ঘরে, তারপর বারান্দায়। আমাদের সিদ্ধেশ্বরীর ভাড়াটে বাড়ির একফালি বারান্দা।এক পাশে খানিকটা কাঠ দিয়ে ঘেরা, বাকীটা খোলা। তারই মধ্যে চৌকি, পড়ার টেবিল। একতলা বাড়ির বারান্দার পাশেই উঠান। ফুল ফুটে থাকে। আমি রাত জেগে চেষ্টা করি সেই ফুলেদের ফুটে ওঠা দেখতে। তারপর এক সময় ঘুমের ঘোড়সোয়ার আসতো আমাকে দখল করে নিতে। ফুলেরা আমাকে ছাড়াই ফুটে উঠতো। সেই শহরে বারান্দাগুলোরও আলাদা গল্প ছিলো।এতো রকমারী বারান্দার বাহার তখন চোখে পড়তো না। ছোট বারান্দায় থমকে থাকতো কাপড় শুকানোর রোদ, একলা চেয়ার, নিঃশ্বাস ফেলার অবসর আর বই-পড়া বিকেল।
এই শহরে এখন বারান্দার বাহারি স্থাপত্যে চোখ ফেরানো যায় না। বাঁকা, সোজা, কৌণিক-কতরকমের বারান্দা সারি সারি ফ্ল্যাট বাড়ির অনাবশ্যক সঙ্গী হয়ে ঝুলে থাকে একা। অবশ্য ঘর-ঠান্ডা করার যন্ত্রের একটা অংশ বেশীরভাগ বাড়ির বারান্দায় এখন নিশ্চিত চরিত্র।
প্রথম খোলা বারান্দার স্মৃতি নয়া পল্টনে। তখনও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। আমরা উঠে এলাম নয়া পল্টনের এক মাঠের পাশের বাড়িতে।এক প্রাচীরের ভেতরে কয়েকটা বাড়ি, মাঝে মাঠ। সেই একতলা বাড়ির লাল মেঝের বারান্দাটা বড় ভালো লেগেছিলো। তখন তো বারান্দায় এতো গ্রিলের কারাগার তৈরীর কাণ্ড শুরু হয়নি।খোলা বারান্দা আমার দুপুরের সঙ্গী। রেলিংয়ে বসে দূরের পথ দেখতাম। মানুষ হেঁটে যেতো, আসতো ফেরিওয়ালা। আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে একটা ঘর নিয়ে থাকতেন প্রয়াত নায়ক জাফর ইকবাল। তখন তিনি শুধু হোটেলে গিটার বাজান।দুপুরবেলা তাকে দেখা যেতো সেই ঘরের সিঁড়িতে বসে গিটার বাজাতে। বারান্দার রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে সেই গিটার শোনাটাও ছিলো সেই বালক বয়সের গভীর আনন্দের অংশ।
সেই শহরে বড় হয়ে উঠেছি তখন। কৈশোর তাড়া করে ঢুকিয়ে নিয়েছে তার হাতের মুঠোয়। সেই সময় আমরা সাধারণত দোতলার বারান্দার প্রেমে পড়তাম। ঘুরিয়ে বলা হলো। আসলে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কোনো কিশোরীর প্রণয়প্রার্থী হতাম্। থাকি সিদ্ধেশ্বরী পাড়ায়। তেমনি এক দোতলা বাড়ি। উল্টোদিকে লন্ড্রি। সেই ধোলাইখানা আমার প্রিয় জায়গা হয়ে গেলো সেই বালিকার চকিত চাহনি দেখার জন্য। এমনি সব অসংখ্য বারান্দা তখন আমাদের অলস বিকেলগুলোকে অন্যরকম করে দিতো।
সেই শহরে বিশাল খোলা বারান্দাগুলো ছিলো দেখার মতো। কোনো কোনো বারান্দায় চোখে পড়তো আরামকেদারা। কখনো সেই কেদারায় বয়স্ক মানুষরা বসে সকালবেলা পত্রিকা পড়তেন। সামনের ছোট টেবিলে থাকতো ধূমায়িত এক কাপ চা। তেমন দৃশ্য তো এখন এই ঢাকা শহরে ফেরারী।
আমাদের সামনের একতলা ছোট্ট বাড়ি। তার সামনে এক চিলতে বারান্দা। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সেখানে বসতো পাড়ার গুরুজনদের তাস খেলার আসর। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় শুনতে হতো তাদের শাসন আর নানা ধরণের ধমক। কখনো সেখানে বসেই তারা আমাদের দিয়ে এটা সেটা আনিয়ে নিতেন।ছুটির দিনে সেই সহজ সময় এখন আর কোথাও চোখে পড়ে না।
তখন বারান্দাগুলো ছিলো অনেকের কাছে ডাকবাক্সের মতো। এক বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্য বারান্দায় বন্ধুদের সঙ্গে চলতো নানা ইশারায় বার্তা বিনিময়। কে কখন বাইরে বের হবো তারই তোড়জোড়। এতো বছর পার হয়ে এসে এখন নগরীর বিশাল বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ির বারান্দায় মাসে একবারও কাউকে দাঁড়াতে দেখি না। মনে পড়ে, বাড়ি ফিরতে দেরি হলে দাদু দাঁড়িয়ে থাকতেন বারান্দায়। পায়চারী করতেন অস্থির হয়ে। সেই বারান্দা থেকে হয়তো কিছুই দেখা যেতো না পথঘাট। তবুও জানতাম সেই বৃদ্ধা অপেক্ষা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গভীর রাতেও। সেই অপেক্ষার দায় মাথায় নিয়ে কতকাল আর বাড়ি ফিরি না।গলির মাথা থেকে দেখতে পাই না বারান্দার আলোটা জ্বলছে।
বারান্দা মুখোমুখি বসবার অবসর বললেও ভুল করা হবে না। কিন্তু সে অবসরের কাল ফুরিয়েছে এই শহরে।কর্মক্লান্ত মানুষ বাড়ি ফিরে এলিয়ে পড়ে বিছানায়, বসে টেলিভিশনের সামনে। অসুখী বারান্দা অন্ধকারে ফুটে থাকে তার নির্জনতা নিয়ে।

ছবিঃ প্রাণের বাংলা

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199