একলা মাদুর…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 16 Jun 2022

1440 বার পড়া হয়েছে

Shoes

মাদুরে একলা পড়ে থাকে দুপুরবেলার কত গল্প! কেনো লিখলাম লাইনটা? নিজেই উত্তর জানি না। মনে হলো দেখতে পেলাম, লাল রঙ করা বারান্দার এক পাশে একটা মাদুর দুপুরের রোদে পাতা আছে। কেউ ছিলো সেখানে কিছুক্ষণ আগেও। সেই উপস্থিতির চিহ্নও পড়ে আছে মাদুরে-আধখোলা একটা বই, হয়তো সেলাইয়ের কাজ অথবা পানের বাটা। বহুকাল আগের ছবি।অথবা কোনো বর্ষাকালের শুরু। বৃষ্টি এসেছে বিকেলে। সন্ধ্যা্য় কে পড়ছে বারান্দায় পাতা মাদুরে? পাশে হ্যারিকেনের মৃদু আলোর পাশে খানিকক্ষণ আগে বিকেলের বৃষ্টিতে ভেজা কদম ফুল!

দরজার আড়ালে গোল করে গুটিয়ে রাখা মাদুর খুলে পেতে দিলে কি কারুণ্য ঝরে পড়ে? আমার মনে হয়,পড়ে। মফস্বলে পুকুরের ধারে যে একলা মানুষটা ছুটির দিনে  ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মাছ ধরতে গিয়ে সব ভুলে বসে বসে বৃষ্টি দেখছে তার একলা আনন্দ দেখো ঝরে পড়ছে মাদুরে। তাকে দেখছে পুকুরের কোনো নতুন মাছ।

মাদুর পেতে পুতুল খেলার স্মৃতি, তাস খেলা। মাদুর পেতে অবেলায় আকস্মিক অতিথিকে ভাত খেতে দেয়া হয়তো কোনোদিন আবার ফিরে মনে পড়ে।মনের মধ্যে সেই মাদুর বাজিয়ে তোলে বিষাদে মোড়া দু’একটি পদ্যের লাইন।

যে শতাব্দীটাকে পেছনে ফেলে এলাম সেখানে মাদুর বড্ড কাছ ঘেঁষে ছিলো। আমরা হয়তো ভুলেই গেছি তার কথা। আমি তো ভাবি, মাদুর বস্তুটা কেমন এক ধরণের নম্রতা শিখিয়েছিলো আমাদের। তারই চিহ্ন হয়তো আজও পড়ে আছে স্মৃতির ভিতরে।

প্রাণের বাংলায় এবারের প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো মাদুর নিয়ে ‘একলা মাদুর…’

১৬০৫-২৭ খ্রীষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর যখন দিল্লীর সম্রাট।তাঁর এক সুন্দরী বেগম তাঁকে একটি মসৃণ মাদুর উপহার দিয়েছিলেন বলে ইতিহাস জানায় আমাদের। কবে কোনকালে রূপসী বেগমের ভালোবাসার অনুসঙ্গ হয়ে উঠেছিলো মাদুর।এই মাদুরই কি আরব্য রজনীর গল্পে বদলে গিয়ে জাদুর গালিচা হয়ে উঠেছিলো! যে গালিচায় চড়ে প্রেমিক কোনো রাজপুত্র উড়ে গিয়েছিলো বাগদাদ নগরীর আকাশ ছুঁয়ে প্রেমিকার খোঁজে?ম্যাজিক কার্পেটের ধারণার সঙ্গে অবশ্য আমাদের নতমুখ মাদুরের বিস্তর ফারাক আছে। বাংলা সাহিত্যে রূপকথার গল্পে মাদুরের উল্লেখ পাওয়া যায়।কখনও মানুষের অবয়বের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাক্ষসদের মাদুরে ঘুমানোর দৃশ্য পাওয়া যায় এই কাহিনিগুলোতে।

মাদুরের অস্তিত্ব আমাদের জীবনে খুব মলিন হয়েই থেকেছে বিগত শতাব্দীতে। গভীর কোনো রাতে ছাদে মাদুর পেতে আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন জীবনানন্দ দাশ। কী দেখতেন তিনি? নক্ষত্র বোঝাই আকাশে তাকিয়ে কী কী বুঝে নিতে চাইতেন কবি?তাঁর বরিশালে মামাবাড়িতে বড় মামা ছাদে মাদুর পেতে শুয়ে শুয়ে আকাশের তারাদের চেনাচ্ছেন, আর জীবনানন্দ বিস্ফারিত চোখে দেখছেন সে সব অগুনতি নক্ষত্র, অসীম- অনন্ত মহাকাশকে।মামাবাড়ির ছাদের উপরের রাতের আকাশ যেন আজীবনের বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিচ্ছে ছোটবেলার জীবনানন্দের সঙ্গে, পরে সেই নক্ষত্রপুঞ্জই ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতার খাতায়। শব্দের পরে শব্দে, দূরতম নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে আলো এসে পড়ছে কবিতায়।

মাদুর থেকে সেই সব নক্ষত্রদের দূরত্ব কত? কেউ কী জানে উত্তর? কিন্তু জীবনানন্দের সেই মাদুরের কাছে হয়তো অনেক গল্প গচ্ছিত রয়ে গেলো, যে সব গল্পের কোনো দেশকাল হয় না। একজন জন্মান্ধ মানুষ চওড়া ফুটপাথের এক পাশে ভিড় এড়িয়ে মাদুর বিছিয়ে আগরবাতি বিক্রি করতো। জ্বালিয়ে রাখা কয়েকটা আগরবাতি সুঘ্রাণ বিলি করতো হাওয়ায়। রাতে চারপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলে মানুষআগরবাতির প্যাকেটগুলো গুছিয়ে একটা ব্যাগে ভরে সেই মাদুরেই শুয়ে পড়তো পথের ধারে। তার অপেক্ষা তখন একজন নিত্যদিনের রুটিন ধরে তাকে এসে নিয়ে যাবে। মাদুরে শুয়ে থেকে সেই জন্মান্ধও কি জীবনানন্দের মতো তার আলোহীন চোখের দৃষ্টি ফেলে আকাশে নক্ষত্রদের নাম মুখস্ত করতো?

গুটিয়ে রাখা মাদুরকে মাঝে মাঝে ম্যাজিক কার্পেটের মতোই মনে হয়। আমাদের একদা যাপিত জীবনের কত জায়গায় যে পাতা হলো সেই মাদুর! বৃষ্টিতে, রোদে, কোনো হেমন্তকালে আলস্যের পাশে বিকেলবেলা পড়ে থাকলো মাদুর মাথার উপর কাঁঠাল গাছটার পাতা পতনের শব্দ বুকে নিয়ে। রাত্রি হলে সম্ভাব্য শীতের আগমনকালের নানান চিহ্ন ধরে রেখে সে মাদুরে ঘুমাতে যেতো কেউ,পাশে রাখা টর্চ লাইট, বিড়ির প্যাকেট আর একটা ট্রানজিস্টার। এখন মনে হয় এই ট্রানজিস্টার বস্তুটাকে মাদুরেই মানাতো ভালো। অনেক রাতে জেগে উঠতো ট্রানজিস্টারের কোনো অজানা স্টেশন ধরার বাসনা। নব ধরে কাটা ঘুরিয়ে বিচিত্র শব্দের জাল ভেদ করে কেউ স্থির করতো গান-যারে, যারে উড়ে যারে পাখি। মাদুরে শুয়ে থাকা মানুষটার পাখি উড়ে কোথায় যায়, কেনো যায়? অনুরোধের আসর শুনতে শুনতে শীতকাল আসে গ্রামে রাত্রিবেলা। শিশির পড়ার শব্দ পেরেকের মতো গেঁথে যায় টিনের চালে। মাদুরে জেগে থাকে মানুষের প্রাণ।

কালিদাস মাদুরে উপুড় হয়ে শুয়ে মেঘদূত কাব্য লিখেছিলেন কি না জানা নেই। তবে মাদুর বস্তুটির মাঝে পুরনো দিনের ছবি আঁকা হয়ে আছে বলে মনে হয়। সে ছবির ভিতরে আন্তরিকতা ঠায় বসে থাকে। থাকে সখ্য, অনেক কথার ঝুড়ি, রাতে মোমবাতি থেকে গলে পড়া মোমের অবশিষ্টাংশ।মাদুর প্রায় হারিয়েই গেলো আমাদের জীবন থেকে। প্রথমে গুটিয়ে রাখা হলো দরজার পেছনে, তারপর একেবারে উধাও। আগে এই শহরের বাড়িগুলোতে মাদুর একটি চরিত্র হয়েই থাকতো নিজের অবস্থানে। মঞ্চে সময় শেষ হয়ে আসলে মাদুর নিম্ন কন্ঠে বললো, বিদায়।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199