কফির কাপে ঝড়…

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 13 Jun 2024

2085 বার পড়া হয়েছে

Shoes

এ কাপ অফ বিটার কফিনিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ এখনওঅনেক আছে। বাঙালীর কাছে চায়ের কাপে ঝড় বিষয়টা বেশি পরিচিত ছিলো বহুকাল ধরে। হালে চায়ের কাপ সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে কফির পেয়ালা।রাত-বিরাতে কফির দোকান এখন সরগরম। চায়ের কাপে রাজনীতি নাম পাল্টে হয়ে গেছে কফির কাপে রাজনীতি। পথের পাশে হাড় জিড়জিড়ে চায়ের দোকানে গরম চায়ের কাপে জীবনের স্বপ্ন পোড়ানোর দিনগুলি এখন মৃত সৈনিকের ভূমিকায়। ভাববেন না কফির ইতিহাস নিয়ে কেচ্ছা গাইতে বসেছে এই লেখা। তবে কফির কাপ সামনে নিয়ে কেচ্ছা গাওয়ার বিষয়টা এই সময়ে কম হয় না! কফির আভিজাত্য এখন চায়ের কাপের ঝড়ও থামিয়ে দিয়েছে প্রায়। ‘ওভার এ কাপ অফ কফি’ এই কথাটা অপ্রত্যক্ষ অর্থ দাঁড়িয়েছে  বোঝাপড়া, আঁতাত।

ক্যাফে সেন্ট্রাল

বোধ করি তাই আজকাল কফির রাজনৈতিক জোরটা বেশি, জোরালো কফিকে ঘিরে অর্থনীতিও। এই লেখার মূল উদ্দেশ্যও বহু বছর আগের এক রাজনৈতিক কফিখানার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করানো । তাই এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে কফি অথবা কফির পেয়ালায় ঝড় নিয়ে রইলো ‘কফির কাপে ঝড়’।

কয়েকটা চা পাতা অল্প জলে দিয়ে একটু ফুটিয়ে কাপে ঢেলে নিতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাকি কাপটি ভর্তি করতেন দুধ-চিনিতে। অভ্যাস ছিলো কফিরও, বানানো হতো একই কায়দায়। অল্প ঘুমিয়ে নিয়ে আবার কাজে বসার আগে রোজ দুপুর দু’টো নাগাদ অনেকটা দুধ আর চিনি দেওয়া এক কাপ কফি খেতেন তিনি। এ ভাবে কেনো কফি খাওয়া জিজ্ঞেস করলেই না কি উত্তরে বলতেন, সকলেরই তো কথা রাখতে হবে। মহাত্মা গান্ধি তাঁকে বলেছিলেন, প্রয়োজনীয় ঘুমটুকু যেন হয়। আবার বউমা প্রতিমাদেবী শ্বশুরমশাইকে বলেছিলেন, একটু করে কফি খেতে। অথচ কফি খেলে ঘুম আসবে না। আর ঘুমোতে চাইলে কফি খাওয়া উচিত নয়! তাই যাতে কফি খাওয়া হয় এবং ঘুমও আসে, দু’দিক রক্ষা করতে নাকি অল্প কফিতে অনেকটা দুধ মিশিয়ে পান করতেন তিনি।

রবীন্দ্রনাথের দুপুরের সেই কফির সঙ্গে অবশ্য রাজনীতির কোনো লেনাদেনা নেই। কিন্তু ভিয়েনা শহরে ১৯১৩ সালে ‘ক্যাফে সেন্ট্রাল’ নামে কফির দোকানটি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলো রাজনৈতিক কারণে আলোচিত-সমালোচিত মানুষের নিয়মিত উপস্থিতিতে। সেই কফিখানায় কফিতে চুমুক দিয়েছেন যোশেফ স্তালিন, অ্যাডলফ হিটলার, লিওন ট্রটস্কি আর মার্শাল টিটো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর নানা রোজনৈতিক উত্থান পতন আর দু‘টো বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদের নাম।

১৯১৩ সালের জানুয়ারী মাসের দুপুর। বাইরে শীত থৈ থৈ করছে। ক্যাফে সেন্ট্রালের ভিতরে বসে আছে ছোটখাট দৈহিক আকৃতির একজন মানুষ। তিনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। একটু পরেই সেই কফিখানার দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করেন আরেকজন মানুষ। তার হাতে একটা ছোট কাঠের সুটকেস; নাকের তলায় মোটা গোঁফ। রুক্ষ চেহারার মানুষটি সোজা এসে অপেক্ষমান মানুষটির টেবিলে বসেন। যিনি ঢুকলেন তাঁর নাম ছিলো যোশেফ স্তালিন। আর অপেক্ষমান মানুষটি রুশ ভাষায় ‘প্রাভদা’ পত্রিকার সম্পাদক লিওন ট্রটস্কি। তারা দুজনেই তখন ভিয়েনা শহরে ফেরারী।

ঠিক ওই সময়ে ভিয়েনা শহরের দক্ষিণে ডিমলার মোটর কোম্পানীর কারখানায় তরুণ জোসিপ ব্রিওজ শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পরে তিনি বিখ্যাত হন তৎকালীন ইয়োগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো নামে।এই তিনজন মানুষই তখন নিয়মিত ক্যাফে সেন্ট্রালে আসতেন কফি পান করতে। আর তাদের পাশাপাশি আরেকজন মানুষও প্রায় নিয়মিত হাজিরা দিতেন কফির দোকানটিতে-তিনি অ্যাডলফ হিটলার। তখন ২৪ বছর বয়সের তরুণ হিটলারের স্বপ্ন ছিলো ভিয়েনার আকাদেমী অফ ফাইন আর্টসে ভর্তি হয়ে ছবি আঁকা শিখবেন। কিন্তু হিটলারের কপাল ছিলো মন্দ। দুইবার তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আকাদেমী কর্তৃপক্ষ।

পরবর্তী সময়ে এই কফিখানার ইতিহাস লিখতে গিয়ে গবেষকরা উল্লেখ করেছেন, কফির দোকানটায় কেক, পনির আর কফির সুখ্যাতি ছিলো। সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় স্তালিনকে দেখা না-গেলেও ট্রটস্কি এবং হিটলার হাজির হতেন। অবশ্য তাদের দু‘জনের মধ্যে কোনো কথোপকথনের প্রমাণ গবেষকরা দিতে পারেননি।কিন্তু ক্যাফে সেন্ট্রাল এখনও ভিয়েনা শহরে তর্ক-বিতর্ক আর ঝাঁঝালো আলোচনার বাষ্প ধরে রেখেছে।

পাশের দেশ ভারতের পশ্চিম বাংলায় ‘কফি হাউজ’ কিন্তু এরকমই শিল্প সাংস্কৃতি আর রাজনীতির কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছে।সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের গোড়ার অনেক কথা কফি হাউজের দেয়াল, চেয়ার টেবিল আর কড়া কালো কফির কাপ জানতো। তরুণ রাজনৈতিক কর্মী, কবি, অভিনেতা আর শিল্পীদের মুখর সময়ের বন্দর হিসেবে আজও ব্যবহৃত এই কফি হাউজ।

এখন পৃথিবী জোড়া কফির সুখ্যাতি।কফি দিবসের ব্যানার ধরিয়ে দিয়ে একটা দিনও আলাদা করে রাখা হয়েছে পালনের জন্য। আমাদের এই শহরে ঝকমকে কফির দোকানে নাইট লাইফ জেল্লা ছড়িয়ে বেঁচে থাকে।কনট্র্যাক্ট কিলার থেকে লাভার সবার পথই এখন মিশে গেছে কফিখানার দুয়ারে।প্রেম করতে গেলেও আজকাল কফির দোকান সূচনা সঙ্গীত গেয়ে ফেলে।আর যৌনতা তাহলে ছেড়ে কথা বলবে কেনো? চিকিৎসকরাই তো বলছেন, কফি যৌন শক্তি আর উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। তাহলে শীত গায়ে নিয়ে ফুটপাত ঘেঁষা হাড় জিড়জিড়ে চায়ের দোকান পলাতক হলো?চায়ের দোকানে ছুটির দিনের সকালে দৈনিক পত্রিকা পড়ার সেই আলস্য হারালো বাঙালির জীবনের সংস্কিৃতি থেকে? না, একেবারে নিখোঁজ বলা যাবে না সেই চায়ের দোকানগুলোকে।  ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে তারা এখানে-সেখানে। সন্ধ্যায় হ্যারিকেন জ্বলে, কোথাও কুপি শুধুই। ছায়া ছায়া কিছু মানুষ বসে থাকে উদাস হয়ে নড়বড়ে বেঞ্চিতে। দাগ ধরা ছোট কাপ থেকে ঝড় না উঠুক ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে আজও মিশে যায় তাদের গল্প।কফির পেয়ালার দাপটের পাশে।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199