ক্লাপারবোর্ড

মোঃ জুলফিকার আলী

প্রযুক্তি লেখক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 31 Aug 2023

12460 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সিনেমা বা যে কোনো শুটিং শুরুর আগে ক্যামেরার সামনে একটা ছোট কাঠের বোর্ড ধরা হয়। সেখানে শট, সিন ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য লেখা থাকে। কেনো এই বোর্ডটা শুটিংয়ের সময় ব্যবহার করা হয়? আমরা সবাই দেখি কিন্তু বিষয়টার অর্থ অনেকেরই জানা নেই।

আজ প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো সেই বোর্ড নিয়ে ‘ক্লাপারবোর্ড’। 

চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ভিডিও প্রযোজনায় এই বোর্ডটি ব্যাবহার করা হয়। এটি শব্দ এবং চিত্রের সমন্বয় নিশ্চিত করতে সাহায্য করে এবং চলচ্চিত্র বা ভিডিও প্রযোজনার সময় দৃশ্য এবং দৃশ্য গ্রহণের সংখ্যা নথিভুক্ত করতে সাহায্য করে।  ভিডিও শুট করার সময় সিন নম্বর , টেক নম্বর এই শব্দগুলো বলে ক্যামেরার সামনে এই বোর্ডটি ধরা হয় এবং খট করে শব্দ করা হয়। এখন ভিডিও তোলা যতটা সহজ অতীতে অতটা সহজ ছিল না। এখন যে ভিডিও ক্যামেরা এমনকি মোবাইলেও কোন ভিডিও যখন রেকর্ড করা হয়, তখন তার শব্দও বেশ পরিষ্কারই আসে। যদিও মোবাইল বা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার করা ছোট ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে প্রফেশানাল ভিডিও শুট করা হয় না। তখন কাজটা এতটা সহজ ছিল না।

একটা সময় ছিল যখন একটা যন্ত্রের মাধ্যমে ভিডিও আর অডিও একসাথে আসতো না। ডিজিটাল সিনেম্যাটোগ্রাফির আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত, যখন একটি ভিডিও শুট করা হতো, তখন ভিডিও এবং অডিও পৃথক যন্ত্রের মাধ্যমে পৃথক মিডিয়াতে রেকর্ড করা হতো। সেই ক্ষেত্রে ভিডিও যন্ত্রের ভিডিও আর অডিও যন্ত্রের অডিওকে ঠিকভাবে ছন্দে আনবার জন্য কিছু একটার দরকার ছিলো। সেক্ষেত্রে ভিডিও যন্ত্রে ক্ল্যাপারবোর্ডের দৃশ্য আর অডিও যন্ত্রে ক্ল্যাপারবোর্ডের এই শব্দটার মাধ্যমে খুব সহজেই ভিডিও আর অডিও কে শনাক্ত করে তাদের ঠিক ছন্দে মেলানো সম্ভব হতো।

পরবর্তী সময়ে ভিডিও ক্যামেরাতেই শব্দ রেকর্ড করা গেলেও সে শব্দের সাথে পারিপার্শ্বিক অন্যান্য অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দও এসে যায়। সেগুলোকে কাটানোর জন্য অডিওকে আলাদা রেকর্ড করা হয়। সেক্ষেত্রেও রেকর্ডারে তোলা অডিও আর ভিডিও ক্যামেরাতে তোলা ভিডিও যখন এডিট করা হয়, তখন তাদের মধ্যে ছন্দ মেলাতে ক্ল্যাপারবোর্ডের শব্দ শোনা হয়। আর এই জন্যই শুটিংয়ের সময় ক্ল্যাপারবোর্ড ব্যবহার করা হয়।   

ক্ল্যাপারবোর্ডের উৎপত্তি ১৯শ শতাব্দীর শুরুর দিকে। প্রথম দিককার বোর্ডগুলি ছিল সহজ কাঠের বাধা অনেকটা "স্লেট বোর্ড" এর মতো যাতে দৃশ্য নেওয়ার সংখ্যা লেখা থাকত। ১৯১০-এর দশকে, কব্জাযুক্ত স্টিকগুলি ক্ল্যাপারবোর্ডে যোগ করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার স্টুডিও প্রধান এফ. ডাবলিউ. থ্রিং (অভিনেতা ফ্র্যাঙ্ক থ্রিংয়ের পিতা) প্রথম ক্ল্যাপারবোর্ড ব্যবহার শুরু করেন। পরে শব্দ প্রকৌশলী লিওন এম. লিওন চিন্তা করলেন যে থ্রিং-এর কাঠের স্লেট বোর্ডের সঙ্গে কাঠের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি ক্ল্যাপারবোর্ড তৈরি করবেন। আর সেখান থেকে এখনকার ক্ল্যাপারবোর্ডের জন্ম হয়।

একটি ক্ল্যাপারবোর্ডে সাধারণত দুটি মৌলিক অংশ রয়েছে: "স্লেট" এবং "ক্ল্যাপার স্টিকস" । স্লেটটি একটি সমতল পৃষ্ঠ যাতে দৃশ্য নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য লেখা থাকে। ক্ল্যাপার স্টিকস হচ্ছে কব্জাযুক্ত দুটি স্টিক যা উপরের এবং নীচের অংশগুলি একসাথে আঘাত করা হয় আর এসময় একটি শব্দ তৈরি হয় । আধুনিক সময়ে প্লাস্টিক অথবা ডিজিটাল ক্ল্যাপারবোর্ডের ব্যবহার দেখা যায় । আধুনিক সংস্করণ হলো ডিজিটাল স্লেট, যা স্লেটের LED ডিসপ্লেতে সময়কোড জেনারেটর সহ সময়কোড ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়।

সাধারণত ক্ল্যাপারবোর্ডের যে তথ্যগুলো লেখা থাকে

চিত্রের শিরোনাম: এটি ছবির নাম বা ধারাবাহিকের নাম।

দৃশ্যের সংখ্যা: এটি প্রতিটি দৃশ্যের জন্য একটি অনন্য সংখ্যা।

টেক সংখ্যা: এটি প্রতিটি দৃশ্যের জন্য একটি অনন্য সংখ্যা যা প্রতিটি পুনরাবৃত্তির জন্য বৃদ্ধি পায়।

দিনের তারিখ: এটি ছবি বা ধারাবাহিকের শুটিংয়ের দিন।

সময়: এটি ছবি বা ধারাবাহিকের শুটিংয়ের সময়।

লোকেশন: এটি ছবি বা ধারাবাহিকের শুটিংয়ের অবস্থান।

ডিরেক্টর: ছবির পরিচালকের নাম।

ক্যামেরা অপারেটর: ছবির ক্যামেরা অপারেটরের নাম।

ক্যামেরা কোণঃ ক্যামেরা সেটিংস, স্পেশাল এফেক্টস, গ্রীন স্ক্রীন প্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয় থাকতে পারে। 

এই তথ্যগুলো সাধারণত একটি কালো মার্কার দিয়ে লেখা হয়। ক্ল্যাপারবোর্ডের দুটি অংশ থাকে: একটি সামনের অংশ এবং একটি পিছনের অংশ। সামনের অংশে চিত্রের শিরোনাম, দৃশ্যের সংখ্যা, টেক সংখ্যা, দিনের তারিখ এবং সময় থাকে। পিছনের অংশে লোকেশন, রোল (বা টেপ, এবং ডিএসএলআর শুটার, মেমরি কার্ডের জন্য), পরিচালক এবং ক্যামেরা অপারেটরের নাম থাকে।

ক্ল্যাপারবোর্ড প্রতিটি দৃশ্যের শুরুতে ব্যবহৃত হয়। ক্ল্যাপারবোর্ডধারী ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান এবং ক্ল্যাপারবোর্ডটি বন্ধ করেন। ক্ল্যাপারবোর্ডের কব্জাযুক্ত স্টিকটি বন্ধ করার সময়, ক্ল্যাপারবোর্ডধারী দৃশ্য নেওয়ার সংখ্যাগুলি উচ্চস্বরে বলে। ক্ল্যাপারবোর্ডের কব্জাযুক্ত স্টিকটি বন্ধ করার সময় শব্দ তৈরি হয়। এই শব্দটি শব্দ প্রকৌশলীকে শব্দ এবং চিত্রটিকে একত্রিত করতে সাহায্য করে। ক্ল্যাপারবোর্ডের কব্জাযুক্ত স্টিকটি উপরের এবং নীচের একসাথে বন্ধ করার সময় তৈরি হওয়া শব্দটিকে "ক্ল্যাপ" বলা হয়। এই শব্দটি থেকেই ক্ল্যাপারবোর্ডের নাম এসেছে।এই বোর্ডকে অনেকে ক্ল্যাপস্টিক বলে থাকে।

কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে ক্ল্যাপারবোর্ডের ব্যবহার যেমনঃ

    "The Godfather" এর শুরুর দৃশ্য - ক্ল্যাপারবোর্ডটি দ্য গডফাদার  চলচিত্রের আইকনিক বিয়ের দৃশ্যের শুরুর চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়।

    "Jaws" চলচ্চিত্রে ক্ল্যাপারবোর্ডের ব্যবহার - ক্ল্যাপারবোর্ডটি ফিল্মের বিখ্যাত সৈকত দৃশ্যের শুরুর চিহ্নিত করতে ব্যবহৃত হয়।

    “Star Wars” চলচ্চিত্রে ক্ল্যাপারবোর্ডের - "স্টার ওয়ার্স" চলচ্চিত্রে প্রতিটি দৃশ্যের শুরু নির্ধারণ করতে চ্যাপারবোর্ডটি ব্যবহৃত হয়।

ক্ল্যাপারবোর্ডের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। এটি শব্দ এবং চিত্রের সমন্বয় নিশ্চিত করতে সাহায্য করে, চলচ্চিত্র বা ভিডিও প্রযোজনার সময় দৃশ্য এবং নেওয়ার নথিভুক্ত করতে সাহায্য করে, চলচ্চিত্র বা ভিডিও প্রযোজনার সময় দৃশ্য এবং নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে। ক্ল্যাপারবোর্ড শুধুমাত্র চলচ্চিত্র, টেলিভিশন এবং অন্যান্য ভিডিও প্রযোজনায়ই ব্যবহৃত হয় না, এটি লাইভ থিয়েটার, সঙ্গীত পরিবেশনা এবং অন্যান্য প্রযোজনায়ও ব্যবহৃত হয়।

চলচ্চিত্র শিল্প যত্রই বিকশিত ও প্রযুক্তি নির্ভর হোক না কেন, নিশ্চিতভাবে ক্ল্যাপারবোর্ডের ব্যবহার থাকবে ।

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199