পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন...

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 12 Mar 2020

1685 বার পড়া হয়েছে

Shoes

হাসপাতাল, ওষুধ, ইনজেকশন, কালো মৃত্যু হয়ে আসা দুঃস্বপ্নের মতো ইঁদুর, জ্বর, ভয়ংকর কুষ্ঠ, কলেরার করাল ছায়া-মানুষের ইতিহাস দীর্ঘ অসুখের ইতিহাসও। গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটস পাঁচের শতকে খুঁজেছিলেন অসুখের সূত্র। লিখেছিলেন অসুখ অলৌকিক কোনো কাণ্ড নয়, এর কারণ নিহিত আছে আমাদের চারপাশেই।

১০ হাজার বছর আগে মানুষ সভ্যতা গড়ে তুলতে বেছে নিয়েছিলো কৃষিকে। ঘর বানিয়েছিলো, চাষাবাদ করেছিলো, চাষাবাদের সূত্র ধরে শুরু হয়েছিলো পশুপালন। মানুষের বসতিই একদিন টেনে এনেছিলো অসুখকে। মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিয়েছিলো অসুখও। নৈকট্য, অপরিচ্ছন্নতা আর স্পর্শের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা মানুষকে সেই প্রাচীন কালে উপহার দিয়েছিলো অসুখ। জীবাণুর বিস্তার ঘটতে শুরু করেছিলো মানুষের শরীরে, মনে।

আজও সেই অসুখের ছায়া মানুষকে এক গভীর বিপন্নতার মতো তাড়া করে চলেছে। পৃথিবীর ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ। পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।  

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘অসুখ’।

প্রাচীন পৃথিবীতে অসুস্থততার সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে আছে কয়েকজন চিকিৎসকের নাম। তারা হলেন গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটস, গালেন, মধ্যপ্রচ্যের ইবনে সিনা। এরা অসুখ নিয়ে, মানবদেহে অসুখের বিস্তার নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন রোগের লক্ষণ।কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্র যেমন পৃথিবী থেকে যুগে যুগে নির্মূল করতে চেয়েছে অসুখ তেমনি অসুখও ছোট করে এনেছে তার ফাঁস, চেপে ধরতে চেয়েছে জীবনকে। ১৩০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপ এবং এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়া এই রোগ শুধুমাত্র ইউরোপের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিলো। ইতিহাসে এই রোগের নাম ‘ব্ল্যাক ডেথ’। ১৩৪৭ সালের এক ভোরবেলা সিসিলির মেসেইনা বন্দরে ১২ জাহাজ এসে ভেড়ে। জাহাজগুলো এসেছে কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে। সেই ভোরে বন্দরে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা চমকে গেলেন। জাহাজে কারা মৃত পড়ে আছে? তাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে রক্ত আর পুঁজ।যারা বেঁচেছিলো তাদেরও পড়ছিলো অন্তিম শ্বাস।তারা সবাই জাহাজের নাবিক।রক্ত হিম করা সেই ভয়ংকর মৃত্যুদৃশ্য দেখে ভয়ে চমকে উঠেছিলো বন্দরে ভিড় করা মানুষ। সেখানকার সরকার তড়িঘড়ি জাহাজগুলোকে ‘মৃত্যুদূত’ বলে আখ্যা দিয়ে বন্দর থেকে সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে মৃত্যু বাতাসে, স্থলে। পরবর্তী পাঁচ বছর এই মৃত্যু তাড়া করে ফিরেছিলো গোটা ইউরোপকে। অবশ্য এই ঘটনার চার বছর আগেই ভয়ংকর রোগটি ছড়িয়ে পড়েছিলো চীন, ভারত, তৎকালীন পারস্য আর সিরিয়ায়।

পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জেনেছেন, ‘ইয়েরসিনা পেস্টিস’ নামে এক ধরণের রোগজীবাণূ থেকেই এই ভয়ংকর রোগের উত্থান। আমরা এখন যাকে প্লেগ বলে থাকি। এই রোগ বাতাসে ছড়ায়। এতে আক্রান্ত পোকামাকড় অথবা পশু বিশেষ করে ইঁদুরের কামড় থেকেও দ্রুত সংক্রমণ ঘটতে পারে প্লেগের।

ষোড়শ শতকের দিকে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিলো আরেকটি রোগ।মানুষের শরীরে অজ্ঞাত কারণে ঘামের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে মৃত্যু। এ রোগের নাম দেয়া হয়েছিলো ‘পিকার্ডি সোয়েট’। খুবই রহস্যময় ছিলো সেই অসুখ। হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো কিন্তু কেউ অসুখের কারণ জানতে পারেনি।মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৫৭৮ খৃষ্টাব্দের পর্ এ রোগের ভাইরাসটি আপনাতেই উধাও হয়ে যায়।ভাইরাসের আগমনের কারণ, উৎপত্তি কোনোকিছু সম্পর্কেই আর কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। তবে এই রোগের উৎপত্তি এবং হাওয়া হয়ে যাওয়ার ১০০ বছর পরে আবার তা দেখা দেয় মূল উৎপত্তিস্থল ফ্রান্সের পিকার্ডি অঞ্চলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ না-হওয়া পযর্ন্ত অদ্ভুত এই অসুখটি তার থাবা বিস্তার করে রাখে ফ্রান্সে। প্রায় ৬,০০০ হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়।

১৫৪৫ থেকে ১৫৪৮ সালের মধ্যে এক অদ্ভুত অসুখে মেক্সিকোর ৮০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়। এই অসুখটিকে মানব ইতিহাসের সবচাইতে ভয়াবহ মহামারি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্থানীয়রা এ অসুখের নাম দিয়েছিলো ‘কুকুলেজটেলি’।

সেই সময়ে মেক্সিকোর ‘নিউ স্পেন’ নামক অঞ্চলটি জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মন্দিরের পুরোহিতদের তখন একটাই কাজ ছিলো বড় বড় গর্ত খুঁড়ে সেখানে মৃতদেহ মাটিচাপা দেয়া। প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় পরে বিজ্ঞানীরা এই অসুখটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারা সেই অদ্ভুত অসুখের পেছনের কারণ ছিলো হাম, গুটি বসন্ত অথবা এক ধরণের তীব্র জ্বর। স্পেনীয়রা যখন মেক্সিকো দখল করে অসুখটি তাদের হাত ধরেই মেক্সিকোতে আসে।

প্রাচীন পৃথিবীর আরেকটি রোগ কলেরা।হিপোক্রেটস যে অসুখের তালিকা তৈরি করেছিলেন তাতে কলেরা রোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগের ডাইনোসরের দেহাবশেষে ব্যাপক গবেষণা করে একটি প্রাচীন রোগের সন্ধান পেয়েছেন। তারা এই রোগের নাম দিয়েছেন ল্যাঙ্গারহান্স সেল হিস্টিওসাইটোসিস। তারা বলছেন এই রোগটি এখনো মানুষের জন্য বিপজ্জনক। কারণ এ রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই। ডাইনোসরদের পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়ার পেছনে এই রোগের বড় ভূমিকা থাকতে পারে।বিজ্ঞানীদের আশংকা, এখন পৃথিবীতে যেভাবে প্রাচীন রোগগুলো আবার দেখা দিতে শুরু করেছে তাতে এই রোগটি যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে মানবজাতিও বিলুপ্ত হতে পারে।

পৃথিবী উত্তপ্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া বরফের অতল থেকে জেগে উঠতে শুরু করেছে। গবেষকেরা আশংকা করছেন এই প্রক্রিয়াটি ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।
সহস্র বছর ধরে বরফে আটকা পড়ে আছে কিছু কিছু জীবাণু। এদের ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানেন না বিজ্ঞানীরা। তারা কী ধরণের ক্ষতি করতে পারে আমাদের, সে ব্যাপারেও তারা নিশ্চিত নন। সাইবেরিয়ার গলতে থাকা পার্মাফ্রস্টের মাঝে গবেষকেরা ইতোমধ্যেই দেখা পেয়েছেন কিছু বিপজ্জনক ভাইরাস, যাদের রয়েছে হাজার হাজার জিন। একটি ভাইরাস ২০১৫ সালে আবিষ্কার হয় এবং তখনো তার মাঝে প্রাণীকে আক্রান্ত করার ক্ষমতা ছিলো। সৌভাগ্যবশত তা মানুষের জন্য ক্ষতিকর ছিলো না।
এমনও চিন্তা করা হচ্ছে যে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া কিছু প্রাচীন রোগ আবার ফিরে আসতে পারে। কারন পার্মাফ্রস্ট জীবাণু আটকে রাখে এবং এসব জীবাণু থাকে সুপ্ত অবস্থায়, আবার উত্তাপের উপস্থিতিতে জীবিত হতে পারে তারা। ১৯১৮ সালে আলাস্কার তুন্দ্রা অঞ্চলে কবর দেওয়া লাশের মাঝে স্প্যানিশ ফ্লু ভাইরাস খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। ১৮৯০ এর দিকে সাইবেরিয়ান একটি শহরের অর্ধেক মানুষ মারা যায় স্মলপক্স হবার কারণে। তখন কোলাইমা নদীর তীরে পার্মাফ্রস্টের মাঝে তাদেরকে কবর দেওয়া হয়। সেই জায়গাটার বরফ এখন গলতে শুরু করছে।

সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদ আশিস নন্দী বলছিলেন, “গোটা বিশ্ব জুড়ে এক বিষাদ-যোগ চলছে। এটা পৃথিবীর নতুন অসুখ। লোকে চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছে, থেরাপি-কাউন্সেলিং করছে। কেন এই অসুখ? আশিস নন্দী মনে করেন, এখন গোটা পৃথিবী এক ধরনের নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেমে আক্রান্ত। মানুষ পাগলের মতো সুখ খুঁজছে কখনও শপিং মল-এ গিয়ে, কখনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে বুঁদ থেকে, কখনও নেশার খপ্পরে গিয়ে।
অতীতে কি তবে মানুষ বেশি সুখী ছিলো? সভ্যতা ও বিজ্ঞানের বিকাশ যত হয়েছে, আমরা কি ততো অসুখী হয়েছি? এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মহাভারতে রাজা যুধিষ্ঠীরের কাছে ধর্মরাজ প্রশ্ন করেছিলো সুখী কে? যুধিষ্ঠীর উত্তর দিয়েছিলেন, যে ব্যক্তির কোনো ঋণ নাই, যে সন্ধ্যাকালে সামান্য শাক রন্ধন করিয়া খায় এবং যে অপ্রবাসী নয় সে-ই সুখী। তাহলে সেই সুখী মানুষ কোথায় খুঁজে পাবে এখন পৃথিবী? অসুখ তো বাসা বেঁধেছে মানুষের হৃদয়ে, বাসা বেঁধেছে শরীরে।এক করোনা ভাইরাসই তো নাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর সকল নিরাপদ তন্দ্রা।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট
ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199