দেশলাই জ্বালতেই…

ইরাজ আহমেদ

সাহিত্য সম্পাদক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 23 Nov 2023

6675 বার পড়া হয়েছে

Shoes

‘একটা দেশলাই কাঠি জ্বালতে কখনো পার হয়ে যায় এক যুগ

তার মুখ মনে আনতে এক শতাব্দী।’

কার লেখা কবিতার লাইন মনে পড়ছে না এখন। কিন্তু দেশলাই তো বহু বহু বছর ধরে বাঙালির সংসারে প্রয়োজন সৃষ্টি করে চলেছে। মোমবাতি, চুলা, সিগারেট অথবা হুকার আগুনের সঙ্গে দেশলাইয়ের ইতিহাস পুরনো। ঘরের কোণা, ড্রয়ার অথবা চুলার পাশে দেশলাই এক প্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে নিদ্রা যায় আমাদের সংসারে বহু বছর। বললাম নিদ্রা যায়, কিন্তু দেশলাইয়ের কাঠি যখন ফস করে জ্বলে ওঠে তখন অনেক কাণ্ডই ঘটে। কাঠির মাথায় সামান্য আগুনটুকু সৃষ্টি থেকে অনাসৃষ্টি সবই তৈরি করতে সক্ষম। কবি,সাহিত্যিকরা দেশলাইয়ের আগুনকে নানা উপমায় ব্যবহার করেছেন। দেশলাইয়ের স্ফুলিঙ্গ থেকে বিপ্লব ঘটে যাওয়ার সংকেত দিয়েছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।আশা ভোঁশলে বিখ্যাত গান আছে-একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও তাতে আগুন পাবে…। বারুদ আর আগুনের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পর্কিত দেশলাইয় উঠে এসেছে বহু রহস্য গল্পের চরিত্র হয়ে। 

একটা দেশলাইয়ের কাঠি খুব উজ্জ্বল হয়ে পুড়তে পুড়তে পথ দেখায় গভীর অন্ধকারে। একটা দেশলাইয়ের প্রজ্জ্বলিত কাঠি বোমার সলতায় ছোঁযাতেই ঘটে বিষ্ফোরণ। আবার একটা দেশলাইয়ের কাঠি দিনের পর দিন নিরীহ ভাবে চুলা জ্বালতে সাহায্য করে।

দেশলাই আগুনের উৎস হিসেবে ব্যাকডেটেড হয়ে যাচ্ছে। আগুন জ্বালানোর কত কী নতুন প্রযুক্তি এখন মানুষের হাতে। ভাবি, কবে দেশলাইয়ের পাট উঠে না যায় আগুনের খাতা থেকে!

এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘দেশলাই জ্বালতেই…’।

চে গুয়েভারা ধারাবাহিক ভাবে চুরুট খেতেন। তার পকেটে কোন মার্কা দেশলাই থাকতো? এই প্রশ্নের উত্তর এখন খুঁজে বার করতে হলে ঘাটতে হবে ইন্টারনেট। কিন্তু এত তথ্যের তলায় মুখ না-গুঁজেও বলে দেয়া যায় ধূমপায়ী সেই মানুষটা পৃথিবীর দেশে দেশে বিপ্লবের আগুন জ্বালানোর মন্ত্রটা ভালোই জানতেন। আর তিনি কাজটা করেছিলেন দেশলাইয়ের সাহায্য ছাড়াই।

মলোটভ ককটেলের বোতলের মুখে গোঁজা রুমালে আগুন ধরাতে দেশলাই জ্বালতে হয়। দেশলাই জ্বেলে জন কিটস মোমবাতি ধরাতেন। আলোর নিচে বসে ফ্যানি ব্রাউনকে চিঠি লিখতেন।লিখতেন প্রেমের কবিতা।

জীবনানন্দ দাশের ‘শিকার’ কবিতায় সিগারেট জ্বালবার প্রসঙ্গ আছে।আছে টেরিকাটা মাথার চুল আর আগুন জ্বালবার প্রসঙ্গ-‘নক্ষত্রের নিচে ঘাসের বিছানায় বসে অনেক পুরনো গল্প,

সিগারেটের ধোঁয়া

টেরিকাটা কয়েকটা মা্থা…’

উইকিডপডিয়ার তথ্য জানাচ্ছে, দিয়াশলাই হলো আগুন জ্বালানোর লক্ষ্যে ব্যবহৃত কাষ্ঠ শলাকাবিশেষ যার অগ্রভাগে সামান্য বারুদ লাগানো থাকে। শলাকার বারুদ প্রান্তটি উপযুক্ত খসখসে তলে ঘষা দিলে আগুন জ্বলে ওঠে। চলতি ভাষায় একে দেশলাই বলেও উল্লেখ করা হয়। এটি পরিপূর্ণ, নিয়ন্ত্রিত পন্থায় আগুন জ্বালানোর ঘরোয়া পদ্ধতি। সাধারণত: ছোট বাক্সে দিয়াশলাই-এর শলাকা বা কাঠিগুলো সাজিয়ে রাখা হয়। সচরাচর বাক্সের দুই বা এক পার্শ্বে দিয়াশলাই ঘষে আগুন জ্বালানোর খসখসে তল থাকে। নিরাপদ দিয়াশলাই বলতে এমন ধরণের দিয়াশলাই বোঝানো হয় আগুন জ্বালানোর পর যার জ্বলন্ত বারুদমুখ খসে পড়ে যায় না।

দেশলাই বহু যুগ আগে এসেছিলো আমাদের এই বঙ্গদেশে। আর তাতে প্রথমেই পাল্টে গেলো বাঙালির পাকপ্রণালী, মানে রন্ধনকর্ম। সন্ধ্যাবেলা ঘরে আলো জ্বালানোও হঠাৎ হয়ে গেলো সহজ কাজ। আর এই দু’টি পরিবর্তন একদা বাঙালির একান্নবর্তী পরিবারের ধারণায় নিয়ে এলো পরিবর্তন। পাল্টে গেলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পৰ্কের সমীকরণ। রান্নাঘরেও আগুন জ্বালানোর কাজটা দেশলাই সহজ করে দেয়ায় তখনকার গৃহবধূর বেশ খানিকটা সময় বাঁচলো। পাশাপাশি হাতে থাকলো স্বামীর সঙ্গে পৃথক সময় কাটানোর অধিকার। কারণ তখন পুরো বাড়ি আলোকিত করার কাজটা ছিলো সময়সাপেক্ষ। ফলে ঘরে ঘরে ইচ্ছে মতো আলো জ্বালানো যেতো না। দেশলাই উসকে দিলো ব্যক্তিগত ঘরে একান্ত আলোর সম্ভাবনাকে। নারীরা দেশলাইয়ের সাহায্যে তখন নিজেদের ঘরে আলাদা আলো জ্বালিয়ে দাম্পত্য সময়কে বেশ অনেকটাই আলাদা করে নেয়ার সুযোগ পেয়ে গেলো। বদলালো ধূমপানের ধরণও। কারণ দেশলাই জীবনে আসার আগে একটি সাধারণ আগুনের উৎস থেকে বাঙালি পুরুষরা হুঁকা ধরিয়ে একসঙ্গে গল্প করতো। দেশলাই কাছে এনে দিলো একা সিগারেটকে। আর তাতে মানুষের দৈনন্দিন সামাজিকতার ধরণের লাগলো পরিবর্তনের ছোঁয়া।

আধুনিক দেশলাইয়ের প্রথম পূর্বাভাস দিয়েছিলেন ফরাসি রসায়নবিদ, জঁহ চাঁসেল, ১৮০৫ সালে। তবে আগুন উৎপন্ন করার সেই উপকরণটিকে ঠিক দেশলাইয়ের মতো ছিলো না। চাঁসেলের উপকরণটির ছিলো দু’টি ভাগ। একটি ছোট বোতলে কড়া দ্রাবকে নিমজ্জিত একটি অ্যাসবেস্টসের টুকরো আর আলাদা ভাবে কতগুলি ছোট কাঠি, যাতে মাখানো থাকত তিন রকমের রাসায়নিক দ্রব্য। এই দু’টিকে একত্র করলেই আগুন জ্বলে উঠতো। সেই অগ্নিসংযোগের প্রক্রিয়াটিও ছিলো অনিরাপদ। তাই এই উপকরণটির বহুল প্রসার ঘটেনি। অবশেষে ১৮২৬ সালে জন ওয়াকার নামক এক ইংরেজ ভেষজ-বিক্রেতা বিশেষ ভাবে তৈরি কাগজের পট্টির উপর রাসায়নিক দ্রব্যে আবৃত কাঠির টুকরো ঘষে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করেন। এই নতুন প্রযুক্তির গণ-উৎপাদন শুরু হয় তখনকার হ্যাব্সবার্গ সাম্রাজ্যের রাজধানী ভিয়েনায় এবং জার্মানির ডার্মস্টাডট শহরে। এর কিছু দিনের মধ্যেই কিন্তু দেশলাইয়ের উৎপাদনের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে উত্তর ইউরোপের সুইডেন। বিশেষ করে জাংকোপিং নামক একটি ছোট্ট শহর। এই সুইডেন এবং ভিয়েনা থেকেই প্রথম যুগে দেশলাই রফতানি হয়ে আসতো ভারতবর্ষে।

কত রকম ছবি দেয়া দেশলাই বাক্সের প্রচলন ছিলো। প্রজাপতি, হাতুড়ি, হ্যারিকেন!ধূমপায়ীদের কাছে প্রিয় মার্কা ছিলো প্রজাপতি।

কবি সুকান্ত দেশলাইয়ের ঐতিহাসিক সম্ভাবনাকে নিয়ে লিখেছিলেন-

আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি

এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না:

তবু জেনো

মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—

বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;

আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।

দেশলাইয়ের কাঠির মাথায় আগুন থেকে কি বিপ্লব আসে? হয়তো আসতো একদা। ঘুমিয়ে থাকা আগুন পকেটে নিয়ে বহু বিপ্লবী তরুণ ঘুরতেন দেশে, প্রান্তরে। আগুন জ্বালবার ইচ্ছা বুকে নিয়ে ঘুমায় দেশলাই। ভিজে যাওয়া দেশলাইয়ের কাঠিও কখনও আগুন ধরিয়ে ফেলতে পারে বোমার সলতায়। তারপর ঘটতে পারে খাণ্ডব দাহন।

দেশলাইয়ের আগুন জ্বালবার একটা বিশেষ কায়দা আছে ধূমপায়ীদের কাছে। বাতাস থেকে আগুনকে হাত দিয়ে আড়াল করে নেয়া। এখন লাইটার দখল করে নিয়েছে দেশলাইয়ের জায়গা। গ্যাসের চুলায় এসে গেছে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। পিছিয়ে যাচ্ছে দেশলাই তার সাজানো আগুন নিয়ে।

তথ্যসূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা, উইকিপিডিয়া
ছবিঃ গুগল

 

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199