মোনালিসার গোয়েন্দারা

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 23 Aug 2023

2695 বার পড়া হয়েছে

Shoes

প্যারিস শহরের লুভ জাদুঘর থেকে ১৯১১ সালের আগাস্ট মাসে চুরি হয় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসা।সেটা ছিলো রোববার রাত।ঘটনা ঘটার প্রায় ২৬ ঘন্টা পর বিষয়টা টের পায় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। ছবিটা দেয়ালের যেখানে ঝুলতো জায়গাটা শূন্য। হৈ চৈ পড়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে। ফরাসি পুলিশ নামলো তদন্তে। বন্ধ করে দেয়া হলো ফ্রান্স থেকে বের হওয়ার সব সীমান্ত। কিন্তু চোর কোথায়?

দা ভিঞ্চির আঁকা সেই পৃথিবী বিখ্যাত ছবি চুরির ঘটনার বয়স দাঁড়িয়েছে ১১২ বছর। সেই সময়ে ছবি উদ্ধারের জন্য ফরাসি গোয়েন্দা পুলিশের নানান তৎপরতা নিয়ে এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘মোনালিসার গোয়েন্দারা’।

জাদুঘরে শূন্য দেয়াল

১৫১৭ সালেই ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিস চার হাজার স্বর্ণমুদ্রায় কিনেছিলেন বিশ্বখ্যাত ছবিটি। যা মোটামুটি ৪ কেজি সোনার সমতুল্য। পরবর্তী সময়ে মোনালিসার মালিক হন নেপোলিয়ন। তাঁর মৃত্যুর পর ল্যুভর মিউজিয়মে রাখা হয় ছবিটি। ততদিনে ছবিটি পৃথিবীর ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বে  অমূল্য হয়ে উঠেছে।এরকম চিত্রকর্ম জাদুঘর থেকে উধাও হয়ে যাওয়ায় গোটা পৃথিবীতেই তোলপাড় শুরু হয়েছিলো। প্রথমে জাদুঘরের রক্ষীরা ভেবেছিলো নিয়মিত ঝাড়মোছের কাজে ছবিটি সরানো হয়েছে। কিন্তু কয়েক ঘন্টা পরেও মোনালিসা জায়গা মতো ফিরে না আসায় বেজে ওঠে সতর্ক ঘন্টা।

গোয়েন্দারা খুব বেশি ক্লু পায়নি চুরির ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে। একজন রক্ষী ভিতর থেকে খুলে ফেলা দরজার হাতল পেয়েছিলো জাদুঘর থেকে বের হওয়ার পেছনের সিঁড়িতে। একজন কাঠমিস্ত্রী জানিয়েছিলো কয়েকদিন আগে জাদুঘরেরই কেউ একজন তাকে ডেকে এনেছিলো হাতলটা মেরামত করতে।সেটা আটকে যাচ্ছিলো বারবার। আরেক রক্ষী পেছনের রাস্তা থেকে একটা কাঠের বাক্স উদ্ধার করে। গোয়েন্দারা বাক্সের গায়ে আঙুলের ছাপ খুঁজে পায়। চিত্রচোরকে ধরতে দায়িত্ব দেয়া হয় গোয়েন্দা বিভাগের অফিসার আলফান্সো বার্তেলিয়নকে। আলফান্সো তদন্তে নেমেই ঘটনার দিন জাদুঘরে কর্মরত ছিলো এমন ২৫৭ জন কর্মচারীর আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেন পেশাদার অপরাধীদের ছাপের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য। ফরাসি পুলিশ মোলিসার ছবি সম্বলিত ৬,৫০০ লিফলেট বিলি করে শহরে। কেউ চোর আর ছবির সন্ধান দিতে পারলে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে তার জন্য ৪০,০০০ ফ্রাঁ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সব উদ্যোগ ফিরে আসে শূন্যতায়। মোনালিসাকে নিয়ে চোর উধাও।

ভিনসেনজো পেরুজিয়া

চুরির ঘটনার প্রায় এক মাস পর গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েন ফরাসি কবি গিয়্যম অ্যাপলোনিয়ার। তারপর আটক করা হয় মিশরের কয়েকজন ছাত্রকে। তারা ফ্রান্সে বেড়াতে এসে ল্যুভ জাদুঘরে গিয়েছিলো। অ্যাপলোনিয়ারকে আটক করার একটি বড় কারণ ছিলো তার তখনকার সেক্রেটারি গ্রে পিঁরেত একদা ছবি চোরের দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। গোয়েন্দাদের জেরার মুখে অ্যাপলোনিয়ার বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলে দেন বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোর নাম। সেই সময়ে গোয়েন্দারা পিকাসোকেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছাড়েনি।

তখন জাদুঘরের দেয়ালের যে জায়গায় মোনালিসার সেই ছবিটা রাখা ছিলো কর্তৃপক্ষ সেই স্থানটা শূন্য রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বহু উৎসুক দর্শনার্থী তখন সেই শূন্যস্থান দেখার জন্য জাদুঘরে ভিড় জমাতো। সেই দর্শক তালিকায় ছিলেন ফ্রানৎস কাফকা।

পরের দুই বছর ফরাসি গোয়েন্দারা গোটা ফ্রান্স চষে ফেলে চিত্রচোরের সন্ধানে। কারণ তারা একটি বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন মোনালিসাকে নিয়ে চোর দেশের বাইরে যেতে পারেনি। অবশেষে ধরা পড়ে চিত্রচোর। গোয়েন্দারা তাকে ধরে প্যারিস শহরে নিজের ফ্ল্যাটে। এক ইতালীয় বংশোদ্ভুত ভিনসেনজো পেরুজিয়া ছিলো সেই আলোচিত চোর।ভিনসেনজো মূলত ছিলো রঙ মিস্ত্রী। মাঝে কিছুদিন একটি প্রতিষ্ঠানে কাঁচ কাটার কাজ করে। এই সূত্রেই সে ল্যুভ জাদুঘরে প্রবেশের অনুমতি পায়। ফরাসি সহকর্মীদের মারাত্নক মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়েছিলো ভিনসেনজো। তাকে সবাই ‘ম্যাকারনি’ বলে ডাকতো। তার বিরুদ্ধে এক পতিতার টাকা লুট করারও অভিযোগ ছিলো। তাকে পুলিশের সন্তেহ হওয়ার কারণ ছিলো ঘটনার দিন সে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলো। গোয়েন্দারা তার ফ্ল্যাটে একটি সুটকেসের ভিতর থেকে উদ্ধার করে চুরি যাওয়া মোনালিসা।

ভিনসেনজো ভেবেছিলো দুই বছরে সব উত্তেজনা থিতিয়ে গেছে। এবার বরং মোনালিসাকে বিক্রি করে দেওয়া যাক। সে তার মায়ের কাছে লেখা এক চিঠিতে অমূল্য এক সম্পদ তার হাতে আসার কথা লিখেছিলো। ১৯১৩ সাল‌ের নভেম্বরে‌ তার লেখা চিঠি পৌঁছায় ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের বাসিন্দা এক আর্ট ডিলারের ঠিকানায়। ৫ লক্ষ লিরা দাম ধরেছিলো ভিনসেনজো মোনালিসা বিক্রি করার জন্য।

তবে আদালতে তার বক্তব্য ছিলো, তাঁর এই চুরির নেপথ‌্যে রয়েছে নিখাদ দেশপ্রেম! যেহেতু মোনালিসা ইতালির শিল্পীর আঁকা, তাই সেটা সেদেশের সম্পত্তি। এমন ছবি ফ্রান্সে থাকবে কেনো? এমন বক্তব্যের কারণেই তাকে মাত্র ১ বছর ১৫ দিনের সাজা দেয় আদালত। পরে ভিনসেনজো মুক্তি পেয়ে যায় জেল থেকে মাত্র সাত মাসেই। অনেকে মনে করেন,  দেশভক্তির গল্প বানিয়ে আসলে সাজা কমানোর চেষ্টাই করেছি‌লো ভিনসেনজো।

ভিনসেনজো মুক্তি পেয়ে ইতালীর হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়। তারপর আবার ফিরে আসে ফ্রান্সে। ১৯২৫ সালে প্যারিসেই মৃত্যু ঘটে শতাব্দীর বিখ্যাত চোর ভিনসেনজো পেরুজিয়ার।

তথ্যসূত্রঃ ওয়াশিংটন পোস্ট

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199