ভালো না-বাসার কাল

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 13 Aug 2020

1265 বার পড়া হয়েছে

Shoes

মহামারি প্রেমকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় কখনো কখনো। পাখির নীড়ের মতো যে নারীর চোখ সে-ও রুগ্ন ভেবে প্রেমিককে প্রত্যাখ্যান করতে পারে। সময়টাই এমন, অবিশ্বাসের, ভয়ের, আড়ালে থাকার। এই সময়ে কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। প্রেমে প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা সহ্য করা যায় কিন্তু এখন তো বিশ্বাসও অসুস্থ।রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ লিখেছেন, ‘‘বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এই তো জীবন’’। আবুল হাসান লিখছেন,‘‘আমি তোমার ওখানে যাবো’’। তার ওখানে যাওয়াও তো নিষেধ এখন। চুম্বন তো আরও বর্জিত। কবি শহীদ কাদরীর সেই অমোঘ লাইন দিয়ে লেখাটার সূচনা করা যায়,‘‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই, কিন্তু শান্তি পাবে না’’। কবিরা আসলেই ভবিষ্যতদ্রষ্টা। এতকাল আগে কবি জেনে গিয়েছিলেন, শান্তি না-পাবার যন্ত্রণা! তখন করোনার সংক্রমণ থাকলে কবিরা কী লিখতেন কে জানে?

করোনার অসুখী সময়ে এবার প্রাণের বাংলার প্রচ্ছদ আয়োজনে রইলো ‘ভালো না-বাসার কাল’।

শেক্সপিয়রের রোমিও আর জুলিয়েট যাজক ফ্রায়ার লরেন্সের সাহায্যে গোপনে বিয়ে করেছে। কিন্তু দুই পরিবার এই প্রেমকে স্বীকার করে না। স্ত্রীর সঙ্গে ঠিকঠাক মিলনও হয় না, ভেরোনা শহর থেকে রোমিও বহিষ্কৃত হয়। ফ্রায়ার লরেন্স বুদ্ধি বার করেন, জুলিয়েটকে একটি ঔষধি দেন। ওটি খাওয়ার পর জুলিয়েট মড়ার মতো পড়ে থাকবে, কিন্তু মৃত্যু ঘটবে না তার। বাড়ির লোকজন তাকে কবর দিতে পারিবারিক সমাধিস্থলে নিয়ে আসবে, যাজক গোপন চিঠিতে রোমিওকে ভয় পেতে বারণ করবেন। চিঠি জানাবে, জুলিয়েট বেঁচে আছে।

এইখানেই মহামারির খেলা। তখন প্লেগের ভয়ে যাজকরা কোয়ারেন্টাইনে, অতএব ওই চিঠিটাই রোমিওকে দেওয়া যায়নি। নাটকের পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে ফ্রায়ার লরেন্স জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘কিন্তু চিঠিটা? রোমিও পেয়েছে তো?’’ যাজক ফ্রায়ার জন উত্তর দেন, না, ‘নর গেট আ মেসেঞ্জার টু ব্রিং ইট দি,/ সো ফিয়ারফুল ওয়্যার দে অব ইনফেকশন’। সংক্রমণের ভয়ে কোনও বার্তাবাহক যেতে চায়নি। অতঃপর জুলিয়েটের মৃত্যুকে সত্য ভেবে রোমিওর আত্মহত্যা। জুলিয়েট প্রেমিক ও স্বামীর মৃত ঠোঁটে চুমু খায়, ‘আই উইল কিস দাই লিপস’, তার পর নিজের বুকে ছুরি বসিয়ে দেয়, ‘ও হ্যাপি ড্যাগার... লেট মি ডাই।’ ইটালীয় প্রেমিক-প্রেমিকার কালজয়ী ট্রাজেডির জন্যে দায়ী আসলে প্লেগ।

প্লেগ রোগটাকে শেক্সপিয়র হাড়ে হাঁড়ে চিনতেন। রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট লেখার ঠিক আগের বছরে, ১৫৯৩ সালে লন্ডনে হানা দিয়েছিলো মারাত্মক বিউবোনিক প্লেগ। এই সংক্রামক রোগটির জন্য তখন শহরের থিয়েটার হলগুলি বন্ধ থাকতো, কেউ মারা গেলেই পাড়ার গির্জায় ঢং ঢং ঘন্টা বেজে উঠতো। শুধু ১৫৯৩ নয়, ১৫৯৭, ১৫৯৯, ১৬০৩তে বার‌ংবার এই রোগে লন্ডন প্রায় উজাড় হয়ে গিয়েছিলো। শেক্সপিয়রের জন্মের কয়েক মাস আগে স্ট্র্যাটফোর্ড আপন এভন-এ প্লেগ, মারা গেলেন তাঁর এক দাদা ও দিদি। আশ্চর্যজনক ভাবে বেঁচে যায় ছোট্ট ছেলেটি। ১৬০৩ সালের প্লেগে মারা গেলেন তাঁর বাড়িওয়ালি মেরি মাউন্টজয়। সংক্রমণের বাজারে শেক্সপিয়র তখন ঘরবন্দি হয়ে কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ লিখছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনায় আরও মানুষ মরবে, মানুষের শরীরে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি হবে। অনেকের ধারণা, শেক্সপিয়রের জীবনটাও হার্ড ইমিউনিটির আশীর্বাদ।

একটা ব্যাপার লক্ষ করবেন— শেক্সপিয়রের চরিত্ররা যুদ্ধে, গুপ্তহত্যায়, খুনজখম থেকে আত্মহত্যা, নানা ভাবে মারা গিয়েছেন। কিন্তু প্লেগে নয়। রানি এলিজ়াবেথ, রাজা প্রথম জেমস দু’জনের আমলেই নাটকে প্লেগে মৃত্যু দেখানো যেতো না। সামাজিক ট্যাবু ছিলো।

আলবেয়ার কামুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসকে অনেকে মনে করেন মহামারি নিয়ে লেখা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘‘লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা’ উপন্যাসও একই ঘারানার বলে অনেকে চিহ্নিত করেন। কিন্তু মার্কেজ তো উপন্যাসে বলতে চেয়েছেন, ‘‘প্রেম আসলে কলেরার থেকেও সংক্রামক। যে সংক্রমণ গোপনে তোমাকে আর আমাকে শেষ করে দিলো। আমাদের দু’জনের কাছের মানুষরাও কিছু আঁচ করতে পারল না।’’ কী অদ্ভুত ভাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরার অসুখ হলেও কলকাতা ভালো থাকে না। কিন্তু এখন তো মহামারিতে গোটা পৃথিবীই ভালো নেই। প্রেম উচ্ছন্নে যেতে বসেছে। জড় ও জীবের মাঝামাঝি এক আণুবীক্ষণিক ভাইরাস হঠাৎ গোটা মানবপ্রজাতিকে তটস্থ করে দিয়েছে।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম স্ত্রী ও শিশুপুত্র রেঙ্গুনে প্লেগ সংক্রমণে মারা যায়। তাই এই ভয়ংকর রোগের ছায়া সম্ভবত তাঁর দুটি উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ ও ‘গৃহদাহ’ তে পড়েছে। শ্রীকান্ত সেই উপন্যাসে প্রথম পরিচিত হয়েছিলো কোয়ারেন্টাইন শব্দটার সঙ্গে আর গৃহদাহ উপন্যাসের সুরেশ মারা গিয়েছিলো প্লেগের সংক্রমণে।

ইতিহাসের বাস্তবতা আবার অন্যরকম। তখন এ ধরণের মহামারিতে দিনের পর দিন দোকান-বাজার বন্ধ থাকলে জাহাঙ্গীর আর নুরজাহানের প্রেমকাহিনীতে রসায়ন গড়াতোই না। ১৬১১ সালের মার্চ মাস। পার্সি নববর্ষ বা ‘নওরোজ়’। মুঘল প্রাসাদের মেয়েরা, অভিজাত আমির-ওমরাহের স্ত্রী, কন্যারা এই দিন খেলাচ্ছলে সম্রাটের কাছে নানা জিনিস বিক্রি করে। সম্রাট জাহাঙ্গীর সে বাজারে এলেন। সে দিনই প্রাসাদের সেই মেয়েকে প্রথম দেখলেন তিনি। তাঁর বন্ধু আলি কুলি ইসাজুলুর বিধবা স্ত্রী।

এই আলি কুলিকে একদা তিনিই ‘শের আফগান’ পদবি দিয়েছিলেন। বর্ধমানে জায়গীর দিয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের বন্ধুত্বের মর্যাদা রাখেনি সে। সময়মতো খাজনা দেয়নি। উল্টো সেনাধ্যক্ষ খুবুকে খুন করেছিলো। খুবুর অনুচররাও ছেড়ে দেয়নি। তাদের তরবারিতে লেগেছিলো শের আফগানের শেষ রক্ত। অতঃপর শের আফগানের বিধবা স্ত্রী মেহেরুন্নিসা ও সন্তানদের বর্ধমান থেকে মুঘল প্রাসাদে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সেটা ১৬০৭ খ্রিস্টাব্দ।

চার বছর পর নওরোজ়ের সেই বাজার থেকে বদলে গেলো ইতিহাস। জাহাঙ্গীরের সম্রাজ্ঞী হয়ে সিংহাসনে বসলেন মেহেরুন্নিসা। তাঁর নতুন নাম তখন নুরজাহান!

জ্বর আর সেল্ফ কোয়রান্টিন রাজদম্পতিকেও ছাড় দেয়নি। এই বিয়ের পরই দুরারোগ্য রোগে মারা গেলেন জাহাঙ্গীরের সুহৃদ আফজ়ল খান। তাঁর বাবা আবুল ফজল একদা আকবরের বিশ্বস্ত ছিলেন। রোগশয্যায় আফজ়লকে আর চেনা যাচ্ছিল না। তাঁর সারা গায়ে ফোস্কার মতো গোটা বেরিয়ে গিয়েছিলো।

রোগের সেটাই শুরু। বছর দেড়েক পর খোদ সম্রাট আক্রান্ত। ইংরেজ পর্যটক উইলিয়াম ফিঞ্চ তার লেখায় জানাচ্ছেন, লাহোর যেতে যেতে তিনি সম্রাটের মৃত্যুসংবাদের গুজব শুনলেন। চোর, ডাকাত, ফৌজদার সবাই অরাজকতার সুযোগে লুটপাটে নেমে পড়েছে। মহামারির মিথ্যা গল্প তখন ছড়িয়ে পড়েছিলো চারদিকে। এমন গল্প আজকের দিনেও প্রবল সত্য।

সম্রাট তখন প্রথম ধাক্কাতেই ‘সেল্ফ কোয়রান্টিন’-এ চলে যান। নুরজাহান ছাড়া আর কেউ তাঁর ঘরে প্রবেশ করবে না এমনই ছিলো সম্রাটের নির্দেশ। সেখানে বোধ হয় অসুখের বিরুদ্ধে ভালোবাসারই জয় হয়েছিলো।  ‘নুরজাহান বেগম ছাড়া কাউকে জানতে দিইনি, অন্যদের চেয়ে ও আমাকে বেশি ভালবাসত,’ আত্মজীবনী তুজ়ুক-ই-জাহাঙ্গীরি’তে লিখে গিয়েছেন সম্রাট। প্রেম বরাবর দুঃসাহসী। তিন ফুট দূরত্ব, স্বকীয়া-পরকীয়ার যাবতীয় ‘সোশ্যাল ডিসট্যান্স’ সে এক মুহূর্তে ঘুচিয়ে দেয়।  রাস্তায় বেরনোর সময় সরকারি নির্দেশে মাস্ক পরা মেনে চলা যায় কিন্তু করোনাকালে ভালোবাসারও লকডাউন? এখন তো রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের পাগল মেহের আলীর মতো বুকের ভেতরে কেউ ডেকে বলে যায়, ‘‘তফাৎ যাও, সব ঝুটা হ্যায়’’। কিন্তু ভালোবাসা কি এভাবে দূরত্বে বেঁচে থাকবে নতুন এক পৃথিবীতে? মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন তাহলে কোথায় যাবেন?

ছবিঃ গুগল

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199