স্নানঘরের গান...

প্রাণের বাংলা ডেস্ক

এডমিন ডেস্ক, ঢাকা থেকে

প্রকাশ: 2 Jun 2019

1290 বার পড়া হয়েছে

Shoes

সময়টা ১৯৫৪ সাল। আবেদনময়ী মনরো একেবারে নিরাভরণ হয়ে এসে দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনে। ছবির নাম ‘সেভেন ইয়ার্স ইচ’। দৃশ্যটি ছিলো বাথটাবে স্নানের। শুটিং হয়ে গেলো। কিন্তু মেরিলিন মনরোর শরীরী আবেদনের উত্তাপ বোধ করি এতটাই ছিলো যে পরিচালক মহাশয় শেষতক সে দৃশ্য রিলে রাখতে পারলেন না। কেটে বাদ দেয়া হলো সেই স্নানদৃশ্য। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে কিম কারদেশিয়ান কিন্তু নগ্ন হয়ে নিজের বাথটাবে বসে হাতের সেলফোন দিয়ে তুলে নিতে পারেন আগুনে ছবি। আর সেগুলো পোস্ট করে দিতে পারেন ইনস্টাগ্রামে। তারপর? তারপরের ইতিহাস তো উত্তপ্ত সেইসব ছবির ভাইরাল হওয়া।

নিজের স্নানের দৃশ্য কিন্তু স্বয়ং রানী ক্লিওপেট্রাও ছবি এঁকে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। না, ক্লিওপেট্রার সেই ছবি ভাইরাল হয়নি। হাজার হাজার বছর আগে মিশরের অন্যসব রহস্যের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু এখন? এখন আর রহস্যের কোনো বালাই নেই, নেই সামান্য আড়ালও। একান্ত স্নানের দৃশ্য এখন সেলিব্রেটিরা প্রকাশ করছেন নানা মাধ্যমে।এটাই এই সময়ে হয়ে উঠছে নতুন ট্রেন্ড।  

এ ধরণের ছবি তোলার তালিকায় কে নেই? পর্ন তারকা সানি লিওন থেকে শুরু করে পুনম পান্ডে, ঔশ্বরিয়া রাই বচ্চন, সবাই বাথরুমের নির্জন বাথটবে আগুন ধরিয়ে দেয়ার কাজটা করেছেন।

ধারা অথবা ট্রেন্ড যাই বলি না কেন মনের বিজ্ঞানীরা কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে যারা ভাবেন তাদেরও চিন্তার বিষয় হয়ে উঠছে বিষয়টা। এ বিষয়ে নানা কথা নিয়েই এবার রইলো প্রাণের বাংলার ঈদ আয়োজনের প্রচ্ছদ কাহিনি।

‘তোমার কি মন নাই কুসুম, শুধুই শরীর?’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা উপন্যাসের শশী ডাক্তার প্রশ্ন করেছিলো কুসুমকে। সে প্রশ্নটাই আবার ফিরে এলো এই সময়ে। পত্রিকার পাতায় খবর হয়েছেন বলিউডের যৌন উত্তাপ বিলানো নায়িকা সুস্মিতা সেনের প্রেমিক প্রবর। তিনি বাথরুমে বাথটবে বসে সুস্মিতার বিষ্ফোরক ছবি দেখে উচাটন হয়ে পড়েছেন। সেই প্রেমে আপ্লুত হয়ে পড়ার কথা মিডিয়ার সামনে প্রকাশও করেছেন। এই প্রেম, এই ভালোবাসার চাপ কি তাহলে শুধুই শরীর? কুসুমদের কি মন নাই?

সেলিব্রেটিদের এই সময়ে বাথরুমে দাঁড়িয়ে উত্তেজক ছবি তোলার এই প্রবণতাকে সবচাইতে বেশি ধারণ করেছে ইনস্টাগ্রাম। কিম কারদেশিয়ান থেকে শুরু করে বলিউডের অভিনেত্রী রিতু চৌধুরী-সবাই আছেন এই তালিকায়। সমাজ গবেষকরা অবশ্য এই প্রবণতাকে একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট, আধুনিক মোবাইল ফোন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানা হাতছানির ভিড়ে মানুষের একা নিয়তি হিসেবেই চিহ্নিত করতে চাইছেন। মানুষ কি নিজেকে চিনতে পারে? সে তো তার নিজের চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা। তাই হয়তো নিজের বাথরুমে একান্ত নিজস্ব নির্জনতাকে প্রকাশ্যে এনে অন্যদের চমকে দিয়ে ঢাকতে চাইছে নিজের শূন্যতাকেই।

আসলে পুরো বিষয়টাই অন্যের মনযোগ আকর্ষণ। সেলিব্রেটিদের আলোচনার টেবিলে থাকার চেষ্টা।কারো কাছে আবার বাথরুমের এই নগ্ন নির্জনতা প্রকাশ্যে আনার কারণটা একেবারেই বাণিজ্যিক।ইন্টারনেটে এসব বাণিজ্য করে অনেক সেলিব্রিটি প্রচুর অর্থ আয় করছেন। এখন তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাইছেন অনেকেই।

কিন্তু এ ধরণের ছবি পোস্ট করে বহু তারকা বিপাকেও পড়েছেন। নেট দুনিয়ায় সমালোচিত হয়েছেন।গালাগালের ঝড় সহ্য করতে হয়েছে তাদের। বলিউডের একদা আলোচিত নায়িকা আমিশা প্যাটেল। ‘কহোনা পেয়ার হ্যায়’ ছবিতে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন ভক্তদের। কিন্তু বহুদিন হলো বলিউডের র‌্যাট রেসে অনেক পিছিয়ে আছেন আমিশা। সম্প্রতি তিনিও নিজের বাথরুমে স্বল্পবসনা হয়ে ছবি তুলে পোস্ট করেছেন টুইটার অ্যাকাউন্টে।ব্যাস, হৈচৈ শুরু হয়ে গেছে। সমালোচকদের প্রথম কথাই ছিলো-এরকম পোশাকে কি কেউ স্নান করে? হাস্যকর।

এমনি সমালোচনার তীর নিক্ষিপ্ত হয়েছে বলিউডের আরেক তারকা অভিনেত্রী দিপীকা পাডুকনের বিরুদ্ধেও। তিনি অবশ্য সমালোচকদের উড়িয়ে দিয়েছেন তুড়ি মেরে।

বাথটবে এই আগুন ধরানো সেলফি আসলে এক ধরণের আত্নপ্রতিকৃতি।

গত মার্চে লন্ডনের ‘স্যাচি’ গ্যালারীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে আত্নপ্রতিকৃতির প্রদর্শনী। সেখানে শিল্পী রেমব্রান্টের আঁকা বিখ্যাত আত্মপ্রতিকৃতিও জায়গা পেয়েছিলো এই যুগের আগুনে সব সেলফির পাশাপাশি। হয়তো কয়েক শতক ধরে মানুষের বদলে যাওয়া চেতনার পথের ওপর আলো ফেলতেই একই প্রদর্শনীতে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন রেমব্রান্ট আর কিম কারদেসিয়ান।

এই উত্তপ্ত সেলফিকে কী বলা যায়? উত্তপ্ত আয়না? আয়নার জন্ম না হলে তো মানুষ নিজেকে উন্মুক্ত করে দেখতে পেতো না। তখন জলের আয়নায় মুখ দেখতে হতো। আয়নাও এক ধরণের সেল্ফি তো বটেই। সেই যে রূপকথার গল্পে হিংসুটে রানী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইতো-তার চেয়ে কে বেশি সুন্দর? এখন বোধ হয় তারকারাও এমন ছবি তুলে নিজেরে রূপ আর মোহনীয়তার পরীক্ষা দিতে চান ভক্তকূলের কাছে। তাদের পালে উত্তেজনার হাওয়া লাগিয়ে পরখ করতে চান নিজের জনপ্রিয়তা।

নাইজেল হার্ট স্যাচি গ্যালারীর পরিচালক। তিনি অবশ্য মনে করেন রেমব্রাঁর আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে আজকের সেলফির কোনো মিল নেই। রেমব্রাঁ সেই বিখ্যাত চিত্রকর্মে নিজেকেই উল্টেপাল্টে খুঁজতে চেয়েছিলেন। জোনাতে চেয়েছিলেন মানব জন্মের সার্থকতা। আর এখন রূপের হাটের বিকিকিনির পালায় শুধু বিক্রি হওয়ার সময়। বাথরুমে একান্ত সময়টুকুও টেনে নিয়ে যাওয়া হাটের মধ্যে।

মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে থেকে। সে সময় সমাজে যৌন অবদমনের মাত্রা ছিলো প্রচণ্ড।

নারী এবং পুরুষকে যতটা সম্ভব পৃথক থাকতে হতো। যৌন আকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন ছিলো লজ্জার ব্যাপার। আর যৌনতা উপভোগ ছিলো আরো লজ্জার।

তিনি সে সময়ে ভিয়েনার অভিজাত সমাজের নারী রোগীদের ওপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখেছিলেন তাদের অনেকে একধরণের 'অস্থির মানসিক-পক্ষাঘাতে' ভুগছেন। আর এ কারণে তারা সহজ ভাবে হাঁটাচলাও করতে পারছেন না। কারণ খুঁজতে খুঁজতে তিনি বের করলেন, এই মহিলাদের মনে তৈরি হয়েছে এক ধরণের অদ্ভুত ক্ষেদ। তারা ভাবছেন তাদের হাঁটা যদি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ নাই করলো, তাহলে হেঁটে লাভ কি? মানুষের মনের অদ্ভুত চলাচল দেখে অবাক হয়েছিলেন সেই বিজ্ঞানী। আজ সেই দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয়টাই প্রকট হয়ে আমাদের সামনে উঠে এসেছে। দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজনে খোলামেলা কিছু সেলফি পোস্ট করা অন্য কোনো পথে হাঁটার চাইতে সহজ।

যৌন বোধকে উসকে দেয়া এমন ছবি অনেক আগে থেকেই তোলা হতো। তবে সেগুলো সেলফি নয়। এসব ছবির নাম দেয়া হয়েছে ‘ইরোটিকা’।ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এ ধরণের কিছু ছবি ‘দ্য প্লেজার প্রিন্সিপ্যাল’ নামে একটি অনলাইন কালেকশন প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। নতুনভাবে ডিজিটাইজ করা এসব ছবির সময়কাল ১৮৯৬ সাল থেকে এই শতকের শুরু পর্যন্ত। সংগ্রহে আছে ভিক্টোরিয়ান যুগের নারীদের ফ্রিল দেয়া পেটিকোট পরা ছবি। আছে সমুদ্রতীরে একেবারে নগ্ন নারীর প্রতিকৃতি। ইন্সটিটিউটের প্রধান কিউরেটর বলেছেন, ‘ইতিহাসের একটা সময়কে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি এই সংকলনে। এই ছবি আমাদের নিজেদের চেনাবে। এসব ছবি দেখলে বোঝা যায় আমাদের সমাজ কীভাবে বদলেছে। আবার কতকিছুই বদলায়নি।’

এ ধরণের দৃশ্যের নিজস্ব ধারণ প্রক্রিয়াই এখন প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবণতাকে গবেষকরা বলছেন আত্নপ্রেম, বলছেন দৃষ্টি আকর্ষণ করার রাস্তা। নিজেকে তুলে ধরে প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা। সে প্রয়োজন অর্থের, সে প্রয়োজন খ্যাতির, সে প্রয়োজন সাফল্যের সংক্ষিপ্ত পথ খুঁজে ফেরা।

তথ্যসূত্র ও ছবিঃ দ্য গার্ডিয়ান, টাইমস অফ ইন্ডিয়া   

মন্তব্য করুন

Share Article

আরো পড়ুন

আরো পড়ুন

স্বত্ব © ২০১৬ - ২০২৩ প্রাণের বাংলা।

সম্পাদক ও প্রকাশক: আবিদা নাসরীন কলি।

Email: Article: [email protected], Avertising: [email protected]

Phone: +8801818189677, +8801717256199